সৈয়দ শামসুল হকের অসমাপ্ত রচনা
গতকাল ছিল সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর দুটি অসমাপ্ত ও অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে আয়োজন
অসমাপ্ত লেখা দুটির ভূমিকা
আনোয়ারা সৈয়দ হকসৈয়দ শামসুল হক নেই—দুই বছর হয়ে গেল। কিন্তু তিনি নেই—এটা আমার কখনোই মনে হয় না। বরং তাঁর নানান লেখাজোখার মাধ্যমে তিনি আগের চেয়ে আরও বেশিভাবে নেই কি আমার জীবনে? আছেন। অবশ্যই আছেন। তবে তিনি চলে যাওয়ার পর আমার মধ্যে একটা আফসোস তৈরি হয়েছে। সেই আফসোসটি কী, একটু পরই তা বলব। আগে একটি গল্প বলি: আমাদের গুলশানের বাড়ি—হক সাহেব যার নাম দিয়েছিলেন ‘মঞ্জুবাড়ি’—সেখানে একটি ইপিলইপিলগাছ ছিল, বিরাট লম্বা। আমি একদিন সেই গাছ কেটে ফেললাম। গাছ কেটে ফেলার পর ওটি যখন বাড়ির উঠোনে ভূপাতিত হলো, দেখলাম, সেই গাছের মাথায় কী সুন্দর ফুল! মনে হলো, গাছটি অনেক লম্বা হওয়ায় এত দিন ফুলগুলো আমার চোখেই পড়েনি।
এই গল্প বলার কারণ আছে। সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যুর পর অনেকবারই আমার মনে হয়েছে, ওই ইপিলইপিলগাছের মতো তাঁর মাথায়ও বিচিত্রনামা ফুল ছিল, ক্ষুদ্র মানুষ বলে আমি তাঁর সবটা দেখতে পাইনি। কিন্তু এখন চেষ্টা করছি তাঁর কোথায় কী আছে, সেগুলো দেখার। বলা যায়, এখানে পত্রস্থ হওয়া সৈয়দ হকের এই লেখা দুটির উদ্ধারও সেই চেষ্টার অংশ।
দুটি লেখাই অসমাপ্ত এবং তাঁর শেষজীবনের রচনা—ভ্রমণকাহিনি ও কাব্যনাটক। নিজের যে ব্যক্তিগত ল্যাপটপে হক সাহেব নিয়মিত লিখতেন, তাঁর রোগশয্যা ও মৃত্যুর পর নানা ঝঞ্ঝা পার করার কারণে সেটি আমার আর খোলা হয়নি। আর ওতে যথেষ্ট ধুলো জমে যাওয়ায় ধারণা করেছিলাম, ওটি আর ঠিক নেই। কিন্তু হঠাৎ সেদিন একজনের সহায়তায় ল্যাপটপটি খুলে আবিষ্কার করলাম সৈয়দ হকের একগুচ্ছ লেখা। কোনো কোনোটি প্রকাশিত, কোনো কোনোটি অসমাপ্ত—কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমরা একবার বহরমপুর ভ্রমণ করেছিলাম। সেটিকে কেন্দ্র করে একটি ভ্রমণকাহিনি লিখতে শুরু করেন তিনি। প্রাথমিকভাবে নাম দেন ‘বহরমপুর ভ্রমণ’। তবে লেখাটি তিনি শেষ করতে পারেননি। আর শেষ যোদ্ধা কাব্যনাটকের কাহিনিটি মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু লিখতে শুরু করেন জীবনের একদম অন্তিমে পৌঁছে। ফলে এটিও অসমাপ্ত রচনা। তথাপি কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে অনেকগুলো চরিত্রের নাম থাকলেও কোনো কোনো চরিত্রের বিস্তার কেবল শুরু হয়েছিল। অন্যদিকে এ নাটকে ‘কন্যা’ ও ‘কন্যার প্রেমিক’ চরিত্র দুটি শুধু নাম উল্লেখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। যদিও অসমাপ্ত, তবুও এই দুটি লেখাতেই আছে সৈয়দ শামসুল হকের লেখনশৈলীর মুগ্ধকর জাদু।
হ্যাঁ, আমার কাছে এগুলো যেন ইপিলইপিলগাছের মাথার সেই ফুল, যা এত দিন অচেনা ছিল!
কাব্যনাটক
শেষ যোদ্ধা
কাল: বর্তমান
কুশীলব: লোক ১, লোক ২, প্রৌঢ়, স্বামী, স্ত্রী, কন্যা, কন্যার প্রেমিক যুবক ও কোরাস
(মঞ্চ: তিন স্তরে তিনটি স্থান—পার্ক, বসবার ঘর, রেস্তোরাঁ)
দৃশ্য: ১
পার্কের অংশ ভোরের মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত।
আবহধ্বনি: মোটা বাঁশিতে ভৈরবী রাগ, দূর থেকে আগত।
দুটি লোক এসে মঞ্চে দাঁড়ায়।
লোক ১: সন্ধ্যায় যে সূর্য ডুবে যায়
ভোরে সে আবার ওঠে।
আজও সে উঠেছে।
কিন্তু আমাদের যা কিছু
বিদায় নেয়
সূর্যের মতো কি
সব ফিরে আসে?
ধরা যাক, ফেরে।
তাই যদি! আবার প্রথম
থেকে? মুক্তিযুদ্ধ?
হঠাৎ এ কথা কেন? তবে
আবার বিজয়? পরাজয়?
মানুষের মানচিত্র দেখি
দেখা যাক মানুষকে তবে।
আবহ ধ্বনির ওই ভৈরবী সুর হঠাৎ শ্বসিয়ে ওঠে পূর্ণনাদে। তারপরই একেবারে থেমে যায়।
লোক ২: কাচ ভেঙে পড়ুক জানলার।
দরজার পাল্লা খসে যাক।
দরজা তো বন্ধ করা যায়,
সত্য রোধ করে রাখা যায়।
বহুদিন বন্ধ হয়ে আছে।
কাচ মানে সবই দেখা যাচ্ছে,
কিন্তু এক আবরণে ঢাকা।
সে-ও তো অনেক দিন থেকে!
খসে যাক! ভেঙে যাক! ভাঙো!
শুরু হোক নাটকের পালা।
ইতিহাসও আসলে নাটক।
কুশীলব আমাদেরই মতো
জন জাতি সাধারণ লোক।
কিন্তু পুরোভাগে একজন
স্বপ্নের সোনালি জামা গায়ে
যিনি এসে সমুখে দাঁড়ান
আমাদের মুক্তি যাঁর হাতে।
লোক ১: এ নাটক! হতে পারে আমাদেরই! ধরা যাক,
এখন বিকট কাল
আমাদের দেশে,
দেশপ্রেমিক ফাঁসিতে,
আর, শত্রু রাষ্ট্রক্ষমতায়,
মুক্তির উজ্জ্বল দিন অস্ত গেছে
জাতির আকাশে,
উদয়ের আশা নেই,
বসন্তের বাগান নিহত,
মানুষ তো ভীত হয়
সহজেই সামান্য মানুষ।
লোক ২: ওদিকে এমন কেউ নেই
আশা দেবে,
ডাক ভেঙে একবার
বলবে যে জাগো!
চলো যাই আবার মুক্তির
যুদ্ধে, এসো!
ইতিহাস রক্ত যদি চায়,
রক্ত দেব!
রক্তে গোলাপ ফোটাব,
মাঠে এসে নামো,
রক্তরাজপথ করো মানবিক কৃষির জমিন।
লোক ১: দিগন্ত পর্যন্ত শুধু হতাশ্বাস
শোঁসায় ফোঁসায়।
দলে দলে দেশত্যাগ
আরও একবার,
আমাদের অনেকেই
পরবাসে উদ্বাস্তু এখন।
নিস্তাপ সুদীর্ঘ দিন,
যান্ত্রিক জীবন।
উদ্বাস্তু সকল আজ অভ্যস্ত
প্রবাসে।
দিন আসে, দিন যায়।
রাতে চাঁদ বিষাদ-জ্যোৎস্নায়।
সূর্য ওঠে পান্ডুর মলিন।
লোক ১: ধরা যাক, আমাদের সীমান্তের ওপারে উত্তরে
প্রান্তবর্তী কোনো এক
অখ্যাত শহরে,
ওই আলো আকাশে ফুটছে। ভোরের
প্রথম আলো।
একজন ওই এসে দাঁড়ালেন—
দেখা যাক তবে!
লোক দুটি আড়ালে চলে যায়।
দৃশ্য: ২
এক বৃদ্ধ পার্কে আসে। ধূসর স্যুট পরিহিত। হাতে বেড়ানোর ছড়ি। বৃদ্ধ স্থাণু দাঁড়িয়ে থাকে। এখনো মঞ্চের আলো আগের মতোই অতি মৃদু।
কিছুক্ষণ পরে ধীরে বৃত্তাকার আলো সমপাতিত হয় বৃদ্ধের ওপরে।
বৃদ্ধ হলেও ব্যক্তিটির মেরুদণ্ড এখনো সতেজ ও টানটান। ভঙ্গিতে যৌবনের দৃপ্তি।
বৃদ্ধ জ্যাকেটের পকেট থেকে একটি ঠোঙা বের করে বীজদানা মুঠোয় ঢালে। আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখিদের স্মিত চোখে কিছুক্ষণ দ্যাখে। তারপর তাদের ডাকে
বৃদ্ধ: আয় আয় আয়।
আবহধ্বনি: পাখিদের কিচিরমিচির।
বৃদ্ধ দানা ছড়িয়ে দেয় মাটিতে। পাখিরা নেমে এসে দানা খাচ্ছে দেখে ভারি খুশি হয়।
আবহধ্বনি: শ্রবণ বধির করে দিয়ে অকস্মাৎ গোলাগুলির আওয়াজ ফেটে পড়ে, যেনবা যুদ্ধের ময়দানে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শব্দ থেমে যায়। ঘোর নীরবতা নেমে আসে।
আবহধ্বনি: তুমুল কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘ফা-য়া–র’।
সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ হাতের লাঠিকে বন্দুক হেন তুলে ধরে তাক করে, যেন গুলি ছুড়তে থাকে।
আবহধ্বনি: উচ্চারিত হয় ‘চা-আ–র্জ’।
বৃদ্ধ তার হাতের লাঠি বন্দুকের মতো বাগিয়ে ধরে এগোতে থাকে। তুমুল গোলাগুলির শব্দের ভেতরে হঠাৎ সে থামে। নামিয়ে নেয় লাঠি। যেন কী সে করছিল, নিজেই জানে না। গোলাগুলির শব্দ থেমে যায় অকস্মাৎ। হতভম্ব বৃদ্ধ সচকিত হয়ে ভাবে, কেউ কি তার এই পাগলামো দেখে ফেলল? সে চারদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিপাত করে। তারপর আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভঙ্গিতে লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে মঞ্চ ছেড়ে চলে যায়।
শূন্য মঞ্চ পড়ে থাকে কিছুক্ষণ।
আবহধ্বনি: ফিরে আসে বাঁশিতে ভোরের করুণ ভৈরবী।
দৃশ্য: ৩
আলো পরিস্ফুট হওয়ার আগেই মঞ্চে এক প্রৌঢ় আসে। উৎসুক চোখে সে দূরে বাইরে কিছু দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই তার স্ত্রী আসে চায়ের পেয়ালা হাতে।
স্ত্রী: কী দেখছ? কই, কথা বলছ না!
চা জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল।
প্রৌঢ়: দাঁড়াও! দেখছি। ওই লোকটিকে।
স্ত্রী: এত দেখবার কী আছে! বুড়ো একটা।
লাঠি হাতে ঠুকঠুক—ভোরে বেরিয়েছে!
এ রকম কত ভোরে কত লোক
হাঁটাহাঁটি করে।
প্রৌঢ়: আমি তাকে আগেও দেখেছি—রেস্তোরাঁয়
মাঝে মাঝে আসেন, সামান্য কিছু
আহার করেন।
একটা স্যুপের সঙ্গে একখানা কড়া টোস্ট—ব্যস।
প্রতিবার একই অর্ডার। তাই স্পষ্ট
মনে আছে।
ওয়েটার ছোকরাদের হাতে তাঁকে পড়তে
দিই না।
বরাবর আমিই তাঁকে সার্ভ করি ক্যাশ
থেকে নেমে—
শুধু যে উদার হাতে বকশিশ দেন,
তার জন্য নয়।
কী যেন রয়েছে তাঁর—আভিজাত্য,
নিঃসঙ্গতা, আর?
বুক চাপা কথা কিছু? যেমন বালির নিচে
নদীর নিশ্বাস?
পড়ে যাওয়া পাখির ডানার নিচে
দুরন্ত আকাশ!
ঠিক ঠাহর হয় না। আমাদেরই মতো
এক শরণার্থী কি না
বহুদিন থেকে এই দেশে, হয়তো বা
আরেক শহরে এসে
বহুদিন, তারপর এইখানে—সীমান্তের এ শহরে
কিছুদিন হলো এসেছেন। মাঝে মাঝে
মনে হয়
হয়তো দেখেছি তাকে, যেন তাঁর
যৌবন বয়সে।
কবে? বা কোথায়? ধন্দ লাগে।
যেন জ্যোৎস্নার ভেতরে কাউকে
হঠাৎ দেখে—চেনা।
অদ্ভুত তাই না?
স্ত্রী: অদ্ভুত বলে কীই অদ্ভুত!
আমিও দেখেছি ওই বুড়োটাকে।
একদিন আলাপও হয়েছে।
প্রৌঢ়: পরিচয় পেলে কিছু? নামধাম?
বলেনি কিছুই?
স্ত্রী: না, ঠিক আলাপ নয়। অদ্ভুত শোনো না!
পার্কের মালির কাছে যাচ্ছিলাম ভোরে—
সেদিন গোলাপ বেশ পার্কে ফুটেছিল—
দু-একটা যদি দেয়—দিল
ফিরছি গোলাপ হাতে, পথে দেখা—
ঠিক ওই লাঠি হাতে,
ঠিক ওই বন্দুকের মতো লাঠি তাক করে ধরা,
তারপর হঠাৎ নামিয়ে নিয়ে চারদিক দেখা—
যেন ধরা পড়ে গেছে, যেন
কেউ কি দেখল, যেন
বাচ্চা ছেলে চুরি করে বাবার
কলম নিয়ে লিখছিল,
পায়ের শব্দেই তার পিলে চমকে গেছে।
দূর থেকে দেখছিলাম। কাছে আসতেই
বুড়োটা আমাকে দেখে হে হে করে হেসে
হঠাৎ বলল কী জানো?—অদ্ভুত ভুতুড়ে স্বর!
কী লাল গোলাপগুলো—রক্ত
কিন্তু এ রকমই লাল।
প্রৌঢ়: রক্ত? লাল?
স্ত্রী: আমি তো অবাক। হঠাৎ রক্তের কথা?
ছনমন করে উঠি। আরে, আচ্ছা তো পাগল!
বুড়োটা আমার দিকে ভালো করে
দেখে তারপর—
ম্যাডাম কি এখানে থাকেন?
হঠাৎ তখন আমি ভাবলাম, কেন?
এতগুলো বছর এখানে আছি—এই দেশে—
এখনো কি মনে হয় শরণার্থী
দেখলে আমাকে!
এখানে আমরা সেই কবে চলে আসি
দেশ ছেড়ে, মার খেয়ে, সীমান্ত পেরিয়ে—
যখন দেশের সেই গৌরবের দিন গেছে
মুক্তির যুদ্ধের,
স্বাধীনতা অর্জনের, তারপরে
একে একে সব শেষ,
মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ধরে ফাঁসিকাঠে,
তুমিও তো যুদ্ধ করেছিলে—গণতন্ত্র?
সাম্যবাদ?
মনে পড়ে? আমাদের একে একে
সব শেষ হলো।
জঙ্গিবাদ মৌলবাদ দেশের দখল নিল,
পালিয়ে এলাম
সীমান্তের এপারে এই দেশের শহরে।
প্রৌঢ়: ভেবেছি দুদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে,
গণতন্ত্র ফিরে এলে দেশে ফিরে যাব।
কিন্তু দেশ জাগল না, মানুষ নিথর।
যেন ব্রহ্মপুত্র ছিল, আজ মরাখাত!
খরস্রোত মরে গিয়ে দিগন্ত পর্যন্ত
এক বালির পাহাড়।
পনেরো বছর পার হয়ে গেল, তবু
দেশে আর ফেরাই হলো না।
স্ত্রী: দেশ আমি ভুলেই গিয়েছি।
এখানেই কখন শেকড় গেঁথে গেছে!
তুমিও কেমন দ্যাখো, সেদিনের
যোদ্ধা তুমি আজ
রেস্তোরাঁর ম্যানেজার! কেটে গেল
একটা জীবন!
কেমন বুড়িয়ে গেলে! ঠান্ডা! নিরুত্তাপ!
দ্যাখো, চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রৌঢ়: দাও দিকি। সত্যিই বলেছ ঠান্ডা
কিছু ভালো নয়।
এ দেশে এসেছি আজ পনেরো বছর,
পাহাড়ের কোলে দেশ—এখানে ঠান্ডাটা—
কিছুতেই—এখন পর্যন্ত কিছু ধাতস্থ হলো না।
স্ত্রী: আমারও আমারও।
কবে যে এখান থেকে দেশে ফিরে যাব।
কোনো দিন ফিরতে পারব?
প্রৌঢ়: সে আশা কোরো না। মৃত্যু হলে এখানেই!
স্ত্রী: এ কথা তোমার মুখে? তুমি তো কখনো
বলোনি মৃত্যুর কথা! চিরকাল তুমি
বলেছ—অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো ধরো—
একদিন ফের যুদ্ধ হবে
আমাদের দেশ থেকে নিশ্চিত
উৎখাত হব দেখো
মৌলবাদী স্বৈরশাসনের।
একদিন গণতন্ত্র ফিরে আসবেই
একদিন তরুণেরা আবার উঠবে জেগে, তারা
আবার সোনার দেশ যুদ্ধ করে
ফিরিয়ে আনবে।
প্রৌঢ়: কিন্তু—ওই ওখানে কিন্তুটা।
স্ত্রী: খুলে বলো। মনে হচ্ছে এতদিনে তুমি
অন্য রকম ভাবছ।
প্রৌঢ়: ভাবনা কি চিরকাল এক জায়গায় থাকে?
ভাবনা বদলে যায়, দিন হয়ে যায় রাত,
রাত ফিরে ভোর হয়, এ তো জানা কথা।
নদীও পাল্টে নেয় তার গতিধারা।
স্ত্রী: যদি ভূমিকম্প হয়। তখন হঠাৎ
নদী তার গতিমুখ মাছের লেজের মতো
দেয় যে আছাড়—বদল তো তাতেই হয়।
কী এমন?—যে তোমার এত দিন পরে
ভাবনায় বদল আসছে?
(কাব্যনাটকটি অসমাপ্ত)
ভ্রমণ
বহরমপুর ভ্রমণ
হেমন্তের পাতলা কুয়াশা জড়ানো ভোরে আমি আর আমার জীবনসঙ্গী আনোয়ারা সৈয়দ হক ঢাকা থেকে রওনা হয়েছি সীমান্তের ওপারে বহরমপুরের দিকে। ওখানে অনেক দিনের এক নাট্য সংস্থা ঋত্বিক আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বছর পনেরো থেকে ওঁরা দেশ-বিদেশের নাট্যমেলা করে আসছেন। ২০১৫-এর ওই উৎসবে ওঁরা আমাকে ডেকেছেন উপস্থিত থাকবার জন্যে। ওঁদের মনে আছে আমার আশি বছর হতে যাচ্ছে এবারেই, ওদের ইচ্ছে, আমাকে ওঁরা সংবর্ধিত করবেন। আমি মোটে সে লোভে নয়, বরং ওঁদের সঙ্গে, কলকাতার বাইরে পশ্চিমবঙ্গের একটি শহরে সেখানকার কৃতি নাট্যজনদের সঙ্গে সহমর্মী দু-একটি দিন কাটাতে পারব, সেই টানেই মঞ্জুকে নিয়ে এবার এই যাত্রায় বেরিয়েছি। মঞ্জু আমার স্ত্রীর ডাকনাম। বস্তুত তিনি আমার জীবনটাকেই মঞ্জুমণ্ডিত করে রেখেছেন বিবাহের আজ এই পঞ্চাশটি বছর।
ঋত্বিকের ডাকে বহরমপুরে এর প্রায় বছর ন’য়েক আগে একবার গিয়েছিলাম, বড় সুন্দর দুটি দিন কেটেছিল সেবার। ওঁদের নাট্যমেলার উদ্বোধন করেছিলাম সেবার, আর মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলাম প্রথমবারের মতো, পলাশী আর সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতিময় আবহে উত্তোলিত হয়েছিলাম। মনে পড়ে, সেই আবহ এতটাই আমার ভেতরে কাজ করেছিল যে আমি নারীগণ নামে একটি কাব্যনাটক লিখে উঠেছিলাম, যার বিষয় ছিল, যে-রাতে সিরাজ নিহত হন, সেই রাতে তাঁর জেনানামহলের নারীদের পরিস্থিতি। ওই নাটকে আমি যুদ্ধকালে—বস্তুত যেকোনো যুদ্ধকালেই ও বিশেষ করে পরাজিত পক্ষের নারীদের পরিস্থিতি ও এক চূড়ান্ত বিচলিত সময়ে তাদের অবস্থান-চিত্র আঁকবার চেষ্টা করি।
কিন্তু এখন সে কথা থাক, এখন আমরা বহরমপুরের পথে। বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে সড়কপথে বহরমপুর যাব, তার আগে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া বাংলাদেশের যশোরের প্রান্ত পর্যন্ত আমাদের পৌঁছাতে হবে। মঞ্জু যশোরের কন্যা, শহরেই তাঁর পৈতৃক বাড়ি। অতএব আমরা ঠিক করি, বিমানে যশোর যাব, সেখান থেকে সড়কপথে বেনাপোল, তারপর সীমান্তের ওপারে আমাদের নেবার জন্যে ঋত্বিকের পাঠানো গাড়িতে আমরা উঠব। ঋত্বিকের দুই প্রাণপুরুষ মোহিতবন্ধু অধিকারী আর বিপ্লব দে আগেই ফোনে জানিয়েছেন যে গাড়ি তো থাকবেই, এগিয়ে নেবার জন্যে কর্মীও তাঁরা পাঠাবেন।
ডিসেম্বরের ৭ তারিখ, বিমানে যশোর পৌঁছেছি, মঞ্জুর ছোট ভাই টুকু চৌধুরীর বাড়িতে দুপুরের রাজকীয় ভোজ শেষে বেড়াতে বেরিয়েছি, ঘুরে ঘুরে দেখেছি মঞ্জুর পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিজিরেত, আর সেই একখণ্ড জমি, যেটি মঞ্জু নিজে কিনেছেন ছোট্ট একটা বাংলোবাড়ি তুলবেন বলে। স্বপ্নের সেই বাড়িটির নাম আমি দিয়ে রেখেছি— মঞ্জুনীড়।
পরদিন ভোরে টুকুর গাড়িতে যশোর রোড ধরে বেনাপোলের পথে আমরা বেরিয়ে পড়ি। তার আগে যশোর শহরের চৌরাস্তায় আমরা এক দোকানে বসে প্রভাতী জলযোগ সেরে নিই এলাকার বিখ্যাত পুরি-ডাল আর মিষ্টান্ন সহযোগে। মঞ্জুকে আমি হাসতে হাসতে বলি,তোমার মনে কি আছে বিয়ের পর প্রথম যখন তোমাদের বাড়ি আমি আমাকে ভোরের জলযোগ তোমরা করিয়েছিলে দোকানের কেনা পুরি ডাল দিয়ে? আমি খুব অবাক হয়েছিলাম—কী! কেনা খাবার দিয়ে জামাই আপ্যায়ন? পরে শুনেছি, যশোরে এটাই তোমাদের রীতি, দোকানের খাবারে ভোর ও বিকেলের জলযোগ করানো!
এই যে বেনাপোলের দিকে এখন চলেছি, পথের দুপাশে সারি সারি প্রাচীন গাছ আমাদের মনে করিয়ে দিল নড়াইলের সেই রাজার কথা, যিনি তাঁর মায়ের গঙ্গাস্নানে কলকাতা পর্যন্ত পালকিতে যাবার এই সড়কটির দুপাশে এত বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, মা যেন ছায়া পান তাঁর চলতি পথে। আমরাও এখন পথের সেই মাতৃছায়া অনুভব করে উঠলাম চলতে চলতে।
আর, এটাও আমাদের দুজনেরই মনে পড়ে গেল, একাত্তরে যখন বর্বর পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করে দেয়, তখন বাংলার ভীত মানুষেরা এই পথ দিয়েই তো ত্রস্ত দীর্ঘ মিছিলে ভারতে গিয়েছিল আশ্রয় নিতে। উদ্বাস্তুদের সেই মিছিল মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে তিনি কালির বদলে তাঁর গলিত অশ্রু দিয়ে লিখে উঠেছিলেন ‘যশোর রোড’ নামে অসামান্য এক কবিতা। সেই কবিতার বাংলা অনুবাদটি ভারতীয় গায়ক মৌসুমী ভৌমিক যে বেদনা ও চেতনা লয়ে, তাঁর মর্মস্পর্শী গায়নে গেয়ে ওঠেন, তা এত বছর পরেও আজ এই যাত্রাপথে মঞ্জু ও আমি যেন আবার কানে শুনে উঠলাম, আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
আমাদের মনে প্রার্থনা জেগে ওঠে, আর যেন পৃথিবীর কোনো জাতি কোনো দেশকে পাকিস্তানি সৈন্যদের অমন বর্বরতা ও বিকটতার শিকার হতে না হয়। কৃতজ্ঞতায় আমরা আপ্লুত হয়ে যাই ভারতের প্রতি—এক কোটি মানুষকে তারা আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সহায়তা দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী গঠন করে পরাজয় ঘটিয়েছে বর্বর ওই বাহিনীর।
সড়কপথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আমরা পৌঁছে যাই বেলা এগারোটা নাগাদ। সীমান্ত-লাগোয়া সেই বিশাল বৃক্ষটি দূর থেকেই আমার চোখে পড়ে, যার নিচে মঞ্চ বাঁধা হয় প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে, আর সেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে হয় অনুষ্ঠান, সে অনুষ্ঠানে সেদিন পশ্চিমবঙ্গ থেকেও মন্ত্রী ও সুধীজনেরা আসেন, ওপার থেকে কত মানুষই আসেন, ওই একটি দিনে উঠে যায় সীমান্তের রাষ্ট্রীয় বাধা, বাঙালির মিলনমেলা বসে যায় প্রতিবছরই সেদিনটায় এই বৃক্ষতলে, তারপরে এপারের এই বাঙালিরা যায় ওপারে, ভারতখণ্ডে, সেখানেও হয় অনুষ্ঠান, আমি নিজেই তো একবার এমন এক একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে এসেছিলাম আমন্ত্রিত হয়ে। আমিও সেদিন এপার-ওপার ভুলে এমনই ভ্রাতৃবন্ধন অনুভব করে উঠেছিলাম সকল বাঙালির ভেতরে, যে-বাঙালি ভাষা আর সংস্কৃতির একসূত্রে গাঁথা। আমাদের পথ ভিন্ন, ইতিহাস ভিন্ন, কিন্তু সকলেই যে আমরা একই মাটির সন্তান, সেই বোধ আমাকে ও মঞ্জুকে এতটাই আপ্লুত করে রাখে যে আমরা সীমান্ত পেরোবার আনুষ্ঠানিকতার সমুখে কিছুক্ষণের জন্যে বেপথু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
কিন্তু বেপথু হয়ে থাকবার উপায় আছে? আমাদের দেখে কলরব করে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন অফিসার, কাস্টম কর্মকর্তা রাঙামাটির মহিলা, তাঁরাই নিমেষ না গত হতে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমাদের এগিয়ে দেন নো-ম্যানস ল্যান্ডের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। আমাদের ব্যাগ দুটো আন্তর্জাতিক কুলির হাতে দিয়েই চোখ তুলে দেখি সীমান্তের লৌহ ফটকের ওপারে কারা যেন হাত নাড়ছে। ওদের একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আমরা ঋত্বিক থেকে এসেছি। বলতে বলতে ফটক ঠেলেই যেন আমাদের ওরা ছুঁতে চায়, কিন্তু বাধা! আমরা এগিয়ে যাই। ফটকের মুখে দাঁড়ানো ভারতীয় প্রহরা পেরিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছাবার আগেই ঋত্বিকের ছেলেটি—সুমন তার নাম—কাছে আসে, আর এখানেও আমরা নিমেষ না গত হতেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ভারতীয় জমিতে, সড়কে পা রাখি।
বাংলাদেশে নাহয় আমার কিছুটা পরিচিতির কারণে সীমান্ত ওরা নিমেষে পার করে দেন, কিন্তু ভারতে? এখানেও যে মোটে সময় লাগল না, মোটে ঝুটঝামেলা হলো না, এইটে আমাকে মুগ্ধ করল। আগেও বহু বছর আমি এই পথে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পার হয়েছি, কিন্তু এর আগে কোনোবারই আমি এতটা সহজ ও এত সময় সংক্ষেপে পার হতে পারিনি। প্রশংসা করতে হয় উভয় প্রান্তেরই সরকারি ব্যবস্থাপনাকে, সীমান্তের দায়িত্বে নিয়োজিত ভারতীয় এবং বাংলাদেশি সকল কর্মকর্তা ও কর্মীকে। হ্যাঁ, দুই দেশের ভেতরে যাতায়াত তো এ রকমই সহজ ও ঝামেলামুক্ত হওয়া উচিত। আমরা নিকটতম প্রতিবেশী এবং মানবিক ও রাষ্ট্রিক উভয় দিক থেকে একে অপরের বন্ধুত্বের বন্ধনেই তো আবদ্ধ।
রওনা হওয়া গেল বহরমপুরের দিকে। প্রশস্ত সুমো গাড়ি। মঞ্জু বসলেন ড্রাইভারের পাশে আর আমি সুমনের ও ঋত্বিকের আরেকজনার সঙ্গে পেছনের সিটে। চাকদহ রানাঘাট পেরিয়ে থামলাম আমরা কৃষ্ণনগরে কিছু খেয়ে নেবার জন্যে। ভাত-মাছ শেষে সুমন আমাদের সমুখে ধরে দিল সরভাজা। বলল, কৃষ্ণনগরের সরভাজা খেলেন না তো খেলেন কী! খেলাম। মঞ্জু বললেন, আমি কিন্তু কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের কথা ভুলছি নে! ফেরার পথে কিনবই কিনব!
প্রায় পড়তি বিকেল, গাড়ি এসে দাঁড়াল বহরমপুরে, ভাগিরথী তীরে সরকারি সেচ-নিবাসে। বাহির প্রাঙ্গণেই দেখি দাঁড়িয়ে আছে এক ভিড় মানুষ। ভিড়ের ভেতরে মোহিত আর বিপ্লবকে লক্ষ করলাম। ফুলের স্তবক হাতে তাঁরা এগিয়ে এলেন। আর প্রণাম! এক ভিড় প্রণাম! ঋত্বিকের ছেলেমেয়ে নতুন-পুরোনো নাট্যজনদের! এঁদের ভক্তি আর ভালোবাসার প্লাবনে সাগরভাসা হয়ে উঠি আমরা দুজনে। আমার চোখে জল এসে যায়। সজল আমি মনে করে উঠি, এই ভিড়ের ভেতরে একজনাই শুধু আজ নেই। তিনি গৌতম রায়চৌধুরী—ঋত্বিকের নাট্যকার ও নির্দেশক, এখন প্রয়াত।
নিবাসের দোতলায় আমরা বসি, কফি পান করি সকলে মিলে, আমাদের বিশ্রামের অবকাশ দিয়ে মোহিত বিপ্লব আর-আর সকলে চলে যান ওঁদের নাটকের মহড়ায়। আজ ডিসেম্বরের ৮ তারিখ, ১০ তারিখে ওঁদের নাট্যমেলার উদ্বোধন, আর প্রথম দিনেই অভিনীত হবে ঋত্বিকের নতুন নাটক, তারই ব্যস্ততা, তারই মহড়া, উৎসবের অন্য আয়োজন তো সেই সঙ্গে আছেই।
(ভ্রমণ কাহিনিটি অসমাপ্ত)