নয়নতারাদের মৃত্যুর পরে
সহকর্মী রশিদুল হকের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল আসাদুল্লা। আতঙ্কও হলো, কেননা তার মনে সংশয় জেগেছিল, এবার তবে মন খুলে কার সঙ্গে একটু কথাটথা বলা যাবে? এদিকে রশিদুল হকের অকালমৃত্যু নিয়ে অফিসে কথা উঠছে নানা ধরনের। কেউ দুঃখ করছে, মাত্র তেপ্পান্ন বছর বয়সে চলে গেলেন মানুষটা, বিয়েশাদিও করলেন না! শোকপ্রকাশের সঙ্গে কেউ যোগ করছে, সবই ভালো। তবে তার মেজাজটা একটু চড়া ছিল এই যা! ক্যাটক্যাট করতেন সারাক্ষণ। আড়কথাও বলছে কেউ কেউ, আর তিনি কাউকেই পাত্তা দিতেন না। অযাচিতভাবে হলেও কি তার সামনে বসে কোনোদিন চা-বিস্কুট খাওয়া গেছে? বেশির ভাগ সময়েই তিনি নেগেটিভ ভাইব ছড়াচ্ছেন, যেন ইচ্ছে করেই! এমন সব আলোচনায় যোগ দেয়নি আসাদুল্লা। রশিদুল হকের মৃত্যু নিয়ে সে কোনো কথা বলতে চায়নি কারও সঙ্গেই, এমনকি তার যত্নশীল স্ত্রী রেবেকার সঙ্গেও নয়।
এখন থেকে চৌদ্দ বছর আগে পরিকল্পনা কমিশনে প্রবেশনারি পদে মুখ ভার করেই যোগ দিয়েছিল আসাদুল্লা। চাকরিবাকরি করে খাওয়ার মতো জটিল একটা কাজের মানসিক চাপ নেওয়ার আগ্রহ বা মনের জোর—কোনোটাই তার ছিল না। সে যখন অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন তার বাবা—ওয়াসার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা—অবসরে চলে যায়। বাবার পেনশনের যৎসামান্য টাকায় ছয় সদস্যের সংসার টেনে নিয়ে যাওয়াটা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছিল তখন। তার ওপরে তাদের চার ভাইবোনের পড়াশোনা বাবদ খরচ তো ছিলই। তাই কোনো রকমে একটা চাকরি জোগাড় করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সে কারণেই উনতিরিশ বছর বয়সে আসাদুল্লার চাকরিতে ঢোকা। মুখ বেজার করে সে সকাল নয়টায় অফিস ধরে, বিকেল পাঁচটায় বেরিয়ে যায়। এভাবে পাক্কা এক বছর চলে গেল, জলে গেল। অফিসে কোনো সহকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হলো না তার। তারপর একদিন তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তার চেয়ে বয়সে ১০ বছরের বড় রশিদুল হকের। প্রায় মধ্যপর্যায়ের কর্মকর্তা রশিদুল হককে সে এর আগে কয়েকটা দাপ্তরিক সভায় দেখেছিল বটে। তখন সদাগম্ভীর রশিদুল হকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেনি।
সেদিন ফার্মগেট ছেড়ে আসা টেম্পো থেকে আসাদুল্লা নেমে গিয়েছিল বাংলামোটরে। সারা দিন ধরে নানা উদ্ভট কাজের ক্লান্তি কাটানোর জন্য একটু হাঁটতে চেয়েছিল সে। তাই আউটার সার্কুলার রোডের ফুটপাত ধরে পা চালিয়েছিল মগবাজার মোড় বরাবর। দিলু রোডের মুখে আসতেই সে খেয়াল করল যে তার পাশে পাশে হাঁটছে রশিদুল হক। অফিসের মানুষের সঙ্গে পথে দেখা হয়ে গেলে দু–চারটে কথা তো বলতেই হয়! এমন একটা ভদ্রতাবোধ থেকে স্মিত হাসিতে আসাদুল্লা রশিদুল হককে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কই যান এই দিকে?’
‘নয়াটোলা যাই। আম্মার ওইখানে।’ গম্ভীর স্বরে উত্তর দিয়েছিল রশিদুল হক।
‘আপনি কি নয়াটোলাতেই থাকেন?’
‘গ্রিন রোডে থাকি সরকারি অফিসারদের ডরমিটরিতে। আপনেদের বাসা কোথায়?’
‘এই তো সামনেই, পেয়ারাবাগ রেলগেটের ওই পারে।’
তারপর আটকে গেল কথোপকথন। মগবাজার মোড় পার হয়েই বাঁয়ে পেয়ারাবাগে ঢোকার সরু গলিটার মুখে জোরকদম থামাল আসাদুল্লা। নিস্পৃহ স্বরে রশিদুল হককে বলল, ‘আবার দেখা হবে।’
‘চা খাইতে আইসেন। আমি ব্লক ১০-এ বসি। আপনার ব্লক ১৪ থেকে খুব বেশি দূরে না।’ আগ্রহ নিয়েই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল রশিদুল হক।
অফিসে যেহেতু কোনো সামাজিকতার বালাই নেই, আসাদুল্লার তাই আর চা খেতে যাওয়া হয় না রশিদুল হকের ওখানে। রশিদুল হকের কথা কালক্রমে ভুলেও যায় সে। তার প্রায় মাস চারেক পরে আসাদুল্লার রুমে এসেছিল রশিদুল হক এবং হাসতে হাসতে আসাদুল্লাকে বলেছিল, ‘তুমি তো আমারে দেখতে গেলা না মিয়া! তাই আমিই আইসা পড়লাম! চা-শিঙাড়া লও অহন!’ এতে খুশিই হয়েছিল আসাদুল্লা, কেননা, তার মন তখন বেশ ভার হয়েই ছিল বাজে একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সাতসকালে গৌণ কোনো বিষয় নিয়ে তাদের বিভাগের সচিব তার শরীর লক্ষ্য করে ফাইল ছুড়ে দিয়েছিল। এমনভাবে অপমানিত হওয়ার পরে সে ভাবছিল, শালার এই দুই পয়সার সরকারি চাকরিই ছাইড়া দিব! চা আর সিগারেট খেতে খেতে তাই সেদিন অফিস-প্রধানদের মুন্ডুপাত করেছিল আসাদুল্লা। তার সঙ্গে সানন্দেই যোগ দিয়েছিল রশিদুল হক। মনটা হালকা হয়ে উঠেছিল আসাদুল্লার।
তারপর থেকে আসাদুল্লা প্রায়ই গেছে রশিদুল হকের অফিস রুমে চা-বিড়ি খেতে, অফিস থেকে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মগবাজার চলে গেছে তারা, গ্রিন রোডে রশিদুল হকের একার ঘরে বসে তারা আড্ডাও দিয়েছে মাঝেমধ্যে। এভাবে রশিদুল হক সম্পর্কে যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছিল তখন, তার তালিকাটা এমন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছিল রশিদুল হক, তার জন্ম নারিন্দার ভূতের গলিতে, তার মাতা–পিতা দুজনেই সিরাজগঞ্জের মানুষ, তারা চার ভাই আর চার বোন এবং সে অকৃতদার। এই উনচল্লিশ বছর বয়সে অকৃতদার? উত্তর এসেছিল, ব্যাটে-বলে মিলল না আরকি! তাহলে তো পরিবারের সঙ্গে নয়াটোলায় থাকলেই হয়! তা হয়। তবে একাকী থাকার ভেতরে একটা মজা আছে, কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিজেই রান্নাবান্না করেন নাকি? নাহ্! রাজাবাজার এলাকা থেকে ছুটা বুয়া এসে পাকশাক করে দেয়, ঘরদোর সাফসুতরা করে, কাপড়চোপড় ধুয়ে দিয়ে যায়। ছুটা বুয়ার কাছে একটা চাবি থাকে ঘরে ঢোকার। কথায় কথায় আরও জানা গেল, গ্রিন রোডে আসার আগে রশিদুল হক আগারগাঁও কলোনির ৭৬ নম্বর বাসায় সাবলেট থাকত। সেটা ছিল পরিকল্পনা কমিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল বাসেতের বাসা। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরপর তাদের নিজেদের নয়াটোলার বাসা থেকে আগারগাঁও কলোনিতে উঠেছিল রশিদুল হক। সেখানেও ছুটা বুয়া আসত। কাজেই তেমন একটা অসুবিধা হয় না।
আগারগাঁও কলোনি সূত্রে আসাদুল্লার মনে পড়ছে তার লেখকবন্ধু শরিফের কথা। একদিন শাহবাগের সিনোরিটায় আড্ডা দিতে দিতে শরিফ তাকে বলেছিল, শহীদুল জহির নামের একজন খুব পাওয়ারফুল লেখক আছেন। সরকারি অফিসের এক কেরানির নিস্তরঙ্গ, ক্লান্তিকর জীবন নিয়ে একটা ছোট কাগজে সম্প্রতি দুর্দান্ত সুন্দর একটা গল্প লিখেছেন তিনি। ‘পইড়ো!’ বলে শরিফ আসাদুল্লার হাতে ছোট কাগজটার একটা কপি ধরিয়ে দিয়েছিল। রাতে বাসায় ফিরে একটানে গল্পটা পড়ে ফেলেছিল আসাদুল্লা। আগারগাঁও কলোনির জরাজীর্ণ একটা ফ্ল্যাটে বসবাসরত কোনো এক কেরানির মৃত্যুর পরে কলোনির সব নয়নতারাগাছ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে এবং প্রতিবাদে আত্মহত্যা করে বসে তারা। গল্পটার কথা পরদিন সে বলেছিল রশিদুল হককে। রশিদুল হক তাকে জানিয়েছিল যে গল্পটা পড়া আছে তার, সুন্দর গল্প। শহীদুল জহিরের গল্পটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রশিদুল হককে তখন প্রশ্ন করেছিল আসাদুল্লা, ‘আচ্ছা! এমন কি হতে পারে না যে আগারগাঁও কলোনিতে আবার কোনো দিন নয়নতারাগাছ জন্মাল, গোলাপি-বেগুনি সব ফুল ফুটল, পুরাতন বিমানবন্দর এলাকা থেকে ছুটে এল হলুদ প্রজাপতিরা?’
প্রত্যুত্তরে রশিদুল হক মৃদু হেসে বলেছিল, ‘নাহ্! সেইটা আমার মনে হয় না।’
ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে রশিদুল হকের মৃত্যুর মাস দুয়েক পরে আসাদুল্লার অফিস রুমে আসে আঠাশ-উনতিরিশ বছরের সুদর্শন এক যুবক। আসাদুল্লার কাছে সে একটু বসার অনুমতি চাইলে তাকে বসতে বলতেই হয়। আসাদুল্লা তখন ব্যস্ত ছিল বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের সমস্যার ওপরে একটা ব্রিফ লেখা নিয়ে। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পরও যুবকের মুখে কোনো রা নেই। কাজের ফাঁকে আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করেও যখন কোনো কথা বলছে না যুবক, তখন তার দিকে তাকিয়ে আসাদুল্লা জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
এবার মুখ খোলে যুবক, ‘আমি রাসেল। আমার আব্বা এখানকার একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তার নাম আবদুল বাসেত। আগারগাঁও কলোনিতে থাকি আমরা। আব্বা আপনার কথা খুব বলেন।’
রাসেলের টানা টানা চোখে রাজ্যের বিষণ্নতা লক্ষ করে ভাবিত হয় আসাদুল্লা, ব্যাপারটা কী? একটু থেমে রাসেল তাকে বলে, ‘রশিদুল হক ভাই আপনার খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন জেনে আপনাকে দেখতে এলাম।’
‘ও! হ্যাঁ! বাসেত সাহেবকে চিনি আমি। রশিদুল হক স্যার তো আপনাদেরই বাসার নিচতলাতে থাকতেন?’
সায় দিল রাসেল, ‘সেটা এখন থেকে বিশ-বাইশ বছর আগের কথা।’
জানা গেল, রশিদুল হকের মৃত্যুর পরে অনেক কেঁদেছে রাসেলের মা আর তার বড় বোন মালেকা বাহার, তাদের বাবা স্তব্ধ হয়ে গেছে শোকে।
একটু থেমে তারপর রাসেলকে জিজ্ঞাসা করে আসাদুল্লা, ‘আপনাদের কলোনিতে কি এখনো নয়নতার গাছ আছে? শহীদুল জহির নামের একজন লেখক আপনাদের আগারগাঁও কলোনির নয়নতারা নিয়ে গল্প লিখেছেন একটা।’
সে কথা জানে না রাসেল। তবে নয়নতারা প্রসঙ্গে রাসেল আসাদুল্লাকে জানায়, একদা আগারগাঁও কলোনিজুড়ে বিস্তর নয়নতারাগাছ ছিল বাসাগুলোর সামনের চিলতে মাটিতে, শেওলাধরা হলুদ দেয়ালের ফাটলগুলোতে, জবুথবু ছাদের কোনায় কোনায়, এমনকি পাতাবাহার আর বিভিন্ন ফুলগাছের টবের ভেতরে লুকিয়ে কোথাও। আগারগাঁও কলোনিতে এখন আর কোনো নয়নতারাগাছ জন্মায় না। এটুকু বলার পর রাসেল নিজে থেকেই আসাদুল্লাকে কিছু তথ্য দিতে শুরু করে: রাসেল যখন ৯ বছরে পড়ল আর মালেকা বাহার ১৬–তে, তখন রশিদুল হকের সঙ্গে ভীষণ খাতির গড়ে উঠেছিল তাদের দুই ভাইবোনের। সেই সময়টায় অফিস থেকে ফিরে কখনো সখনো ছাদে পায়চারি করত রশিদুল হক। আর মালেকা বাহার রোজকার মতোই ছাদে খোলা হাওয়ায় মোড়া পেতে বসে গল্পের বই পড়ত তখন। কলোনির মাঠে বা সামনের রাস্তাটায় ফুটবল বা ক্রিকেট খেলত রাসেল। মাগরিবের আজানের পরপর খেলা শেষ করে ছাদে গিয়ে সে প্রায়ই গল্প জমিয়েছে মালেকা বাহার আর রশিদুল হকের সঙ্গে। আর ফাল্গুন মাস এলে ছাদে ঘুড্ডি ওড়াতে উঠত রাসেল। তার কাছ থেকে নাটাই নিয়ে প্রায়ই ঘুড্ডি–কাটাকাটি খেলেছে রশিদুল হক।
রাসেল আরও জানায়, সেই সময়টায় রশিদুল হক বিদেশ গেলে মালেকা বাহার আর তার জন্য অজস্র চকলেট নিয়ে আসত। এমনও হয়েছে, তাদের দুই ভাইবোনের জন্মদিনগুলোতে নিউমার্কেট থেকে ক্যাপিটাল কনফেকশনারির কেক নিয়ে এসেছে রশিদুল হক, সঙ্গে মোমবাতি। একবার টাইফয়েড হয়েছিল রশিদুল হকের। প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিল সে। তখন রাত জেগে তার মাথায় বালতিকে বালতি পানি ঢেলেছে, জলপট্টি করে দিয়েছে আর ওষুধপথ্যি খাইয়েছে রাসেলের মা আর মালেকা বাহার। স্মৃতিবিষয়ক এসব কথা বলতে বলতে একসময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে রাসেলের দুচোখ।
রাসেলের আমন্ত্রণে পরদিন সন্ধ্যাবেলায় অফিস লাগোয়া আগারগাঁও কলোনির ৭৬ নম্বর বাসায় যায় আসাদুল্লা। পাশাপাশি লাগানো ১০-১২টা ছোটখাটো দোতলা বিল্ডিংয়ের একটা রাসেলদের বাসা। সেই লাইনের এবং উল্টো দিকের লাইনের প্রতিটা বাসার চেহারা একই রকমের হলুদ রঙের শেওলাধরা দেয়াল; উদ্গত ইটের ফাঁকে ফাঁকে জন্মেছে অনাহূত অশ্বত্থ বা বট বা পাকুড়ের চারা; ঘরগুলোর পুরোনো জানালায় রং উঠে যাওয়া কাঠের ফ্রেম বসানো; জানালার কাচগুলো কোথাও কোথাও আবার ভাঙা, কোথাও কোথাও বসানো ময়লা কাগজ বা বাদামি বোর্ড; বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখে মরচেধরা জগদ্দল কলাপসিবল গেট। শরীরের সব শক্তি দিয়ে কলাপসিবল গেট খুলে রাসেল তাকে তাদের বাসার নিচতলায় নিয়ে যায় তখন। সেখানকার হাড় জিরজিরে ডাইনিং টেবিল পার হলে উত্তরের জানালা ঘেঁষে অপরিসর একটা জায়গাতে পুরোনো একটা সোফা পাতা আছে। সেই সোফাতে তাকে বসতে দেয় রাসেল। তাকে বলে, একদা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে রশিদুল হক এই ঘরেই থেকেছে। দক্ষিণের জানালার সঙ্গে তখন বসানো ছিল কাঁঠালকাঠের একটা ছোট্ট টেবিল। পশ্চিমের দেয়ালের সঙ্গে পাতা ছিল আমকাঠ দিয়ে তৈরি নড়বড়ে সিঙ্গেল খাটটা। উত্তরের জানালার কাছে ছিল গ্যাসের চুলা।
রাসেলের সঙ্গে গল্পের ফাঁকে ঘরটায় প্রবেশ করে রাসেলের মা আর তার বড় বোন শেষ তিরিশের মালেকা বাহার। মালেকা বাহারের পাশ থেকে উঁকি দেয় বছর আটেকের এক চঞ্চল বালক। তার হাতে ফুটবল। প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে পাঁচ সেকেন্ডের মতো সেখানে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় সে। মালেকা বাহারের পায়ে পায়ে ঘোরে চার বা পাঁচ বছর বয়সী একজন কন্যাশিশু। এবার রাসেলের মা আর তার বোন ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে। তাদের দুজনের সঙ্গে আসাদুল্লার পরিচয় করিয়ে দেয় রাসেল। তারপর ঘরে ঢোকে রাসেলের বাবা আবদুল বাসেত। ‘স্যার! আপনে আজ রাতে আমাদের সাথে খেয়ে যাবেন কিন্তু!’ বলে আসাদুল্লার কোনো প্রতিক্রিয়া না-শুনেই সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়, হয়তোবা পাকা মার্কেটে বাজারসদাই করতে। ঘরটায় তখন চারজন মানুষ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে যার যার মতো।
খুব অস্বস্তি হতে থাকে আসাদুল্লার। মনে হয়, এভাবে ঝোঁকের মাথায় নয়নতারাদের খোঁজে আগারগাঁও কলোনিতে চলে আসাটা মোটেই উচিত হয়নি! নয়নতারাদের খবর জেনে কীই–বা ফায়দা হবে! এক জীবনে সব রহস্য উন্মোচনের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি? তাই সে মনস্থির করে, উঠে পড়বে এবার। তার অস্থিরতা লক্ষ করেই হয়তোবা রাসেলের মা তাকে বলে, ‘আপনে একটু বসেন। আমি চা কইরা নিয়া আসিগা। অপিস থিকা সুজা আসছেন। ক্ষুধা তো লাগবই!’ ওপরতলায় চলে যায় রাসেলের মা। টলমল পায় তার পিছু ধায় মালেকা বাহারের কন্যাশিশু। ফের নিশ্চুপ বসে থাকে রাসেল, মালেকা বাহার আর আসাদুল্লা। দীর্ঘ নীরবতা ভাঙার জন্যই মালেকা বাহারকে অপ্রয়োজনীয় একটা প্রশ্ন করে আসাদুল্লা, ‘কোথায় থাকেন আপনি?’
টানা ঘন কালো চোখ মেলে দিয়ে খুব সাধারণ চেহারার সেই শ্যামলা মেয়ে উত্তর দেয়, ‘মিরপুর ১০–এ শ্বশুরবাড়িতে।’
একটু থেমে মালেকা বাহারকে সোজাসুজি প্রশ্ন করে আসাদুল্লা, ‘রশিদুল হক স্যার যখন এখানে থাকতেন, তখন কি আগারগাঁও কলোনিতে অনেক নয়নতারা ফুটত?’
‘হ্যাঁ! এখানে তখন হাজার হাজার নয়নতারাগাছ জন্মাত, আপনাতেই, কোনো যত্ন ছাড়াই। বর্ষাতে লালচে, বেগুনি আর গোলাপি রঙের নয়নতারা ফুলে ছেয়ে যেত সারাটা কলোনি। রশিদ ভাই নয়নতারা ফুল ভীষণ পছন্দ করতেন!’
‘কবে থেকে আর নয়নতারাগাছেরা জন্মেনি?’
জানা গেল, সেটা ১৯৮৯ সালের শেষ দিকের কথা। তার কিছুদিন আগেই মিরপুরে বিয়ে হয়ে গেছে মালেকা বাহারের। একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে কলোনিতে বেড়াতে এলে সে প্রথম লক্ষ করে, মরে যেতে শুরু করেছে আগারগাঁও কলোনির নয়নতারাদের দল। ১৯৯০ সালের পয়লাতে
রশিদুল হক গ্রিন রোডের সরকারি ডরমিটরিতে উঠে যাওয়ার পরে দেখা গেল, সব নয়নতারাই কালে কালে মরে গেছে।
তারপর মালেকা বাহার আনমনে তাকিয়ে থাকে নুন খসে খসে পড়তে থাকা পশ্চিমের সাদা দেয়ালের দিকে। হয়তোবা সে দৃষ্টি এড়ায় পরিকল্পিতভাবেই। আর চেয়ারে বসে উসখুস করে রাসেল। মাথা নিচু করে মোবাইলে ফেসবুকের পোস্ট দেখে চলে সে।
একটু থেমে মালেকা বাহারকে জিজ্ঞাসা করে আসাদুল্লা, ‘আপনার কি মনে হয় না যে দল বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল নয়নতারারা?’
‘রশিদ ভাই তো এ রকমই ভাবতেন। কি জানি!’
এর বেশি কিছু আর বলে না মালেকা বাহার। তারপর বিষণ্ন আর উৎক্ষিপ্ত মনের সব বিন্দুকে এক ঝটকায় একত্র করে নিয়ে মালেকা বাহারকে প্রশ্নটা করে ফেলে আসাদুল্লা, ‘মন খারাপ হয় আপনার?’
কোনো উত্তর আসে না। মালেকা বাহারের চোখের পাতা খুব দ্রুত বেগে উঠছে আর নামছে তখন।
আগারগাঁও কলোনির ৭৬ নম্বর বাসার নিচতলায় তখন ধ্বনিত হচ্ছে ঝরা পাতার আওয়াজ। আসাদুল্লার মনে পড়ে, একদা রশিদুল হক গ্রিন রোডের ডরমিটরিতে তার নির্জন ঘরটায় প্রায়ই মরা পাতা ঝরে পড়ার সকরুণ একটা আওয়াজ পেত। তেমনই একটা হাহাকার–জাগানো আওয়াজ পেল আসাদুল্লাও, যেনবা শান্তিদেব ঘোষ গান গেয়ে উঠলেন সহসাই!