ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, লাভ দিস ফ্লাওয়ার।
কতকাল পর কথাটা মনে পড়ল! আর তার মুখটাও।
ফুলটির নাম নীলিমা। আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম। মনে মনে বহুবার বলেছি, ভালোবাসি। কিন্তু মুখে বলতে পারিনি।
নীলিমা কলেজে আমার কাছ থেকে অ্যাকাউন্টিং খাতাটা নিয়েছিল। প্রায় দুই সপ্তাহ পর গেলাম বড় আপার শ্বশুরবাড়ি। তখন ফেরত দিল। ফেরত দেওয়ার সময় তার মুখটা ছিল রাঙা। কিছু কি বলতে চেয়েছিল?
দেশে তখন একটার পর একটা লাশ পড়ছে। স্বৈরাচারের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। রাজধানী উত্তাল। সেই উত্তাপ আমাদের এলাকায়ও ছড়িয়েছে। আমার মনে তখন একটাই জপ: স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। তাই বুঝতে পারিনি তার ভাষা।
একদিন খাতা উল্টে দেখলাম, শেষ পৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় লেখা, অপু, গপু, তপু...এরপর মার্কার পেনে লেখা: পি.টি.ও.। পৃষ্ঠা উল্টে দেখলাম, গাম দিয়ে সাঁটা ইয়া বড় কাগজের গোলাপ। ফুলটা পুরোপুরি ফোটেনি। গোলাপের ওপরে লেখা: ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, লাভ দিস ফ্লাওয়ার।
আজ থেকে ২৭ বছর আগে কথাটা লিখেছিল। আমি ফুলটার গন্ধ পেলাম। বুক ভরে নিলাম তরুণবেলার গন্ধ। তবে ফুলের একটা হাওয়া থাকে। মনে হয় তা আমার গায়ে লাগেনি।
ক্যালেন্ডারে নীল-সাদা পাহাড়। পাহাড়ের নিচে গাছের সারি। তারও নিচে উঁচু-নিচু ভূমি। সেখানে ভেড়া চরছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। কানে আসছে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি। একেকটা ফুঁতে যেন সাগরের ঢেউ। ঢেউয়ে উল্টে-পাল্টে যেতে যেতে মনে পড়ল নীলিমার কথা।
অনেক বছর দেখিনি। দুষ্টুমিভরা সেই চোখমুখ দেখার ইচ্ছে হলো খুব। আমাকে কখনো অপু ডাকত না। এর বিপরীতে যত নাম বানানো যায়, বানাত। আমি ডাকতাম নী।
সে জিজ্ঞেস করত, নী মানে কী?
মনে মনে বলতাম, নী মানে হলো, তোমাকে আমি যা বলতে চাই। মুখে কিছু বলতে পারতাম না। শুধু মৃদু হাসতাম।
আমার মনে হাহাকারের পাতা ওড়ে। একটু পর বুঝতে পারি, পাশের রুমে আমার মেয়ের ল্যাপটপে বাঁশি বাজছে। মনে হলো, ক্যালেন্ডারের ওই পাহাড়ের পাশে কোনো গ্রামে আমি থাকতাম।
মেয়ে এখন শুনছে আমজাদ আলী খানের সরোদ। সরোদ শুনে আমার মনে দুটি ডানা যুক্ত হয়। আমি উড়ি। উড়তে উড়তে নীলিমার কথা ভাবি।
বড় আপার বিয়ের দিন তার সঙ্গে প্রথম দেখা। দুলাভাইয়ের চাচাতো বোন। উজ্জ্বল দুটি চোখ; সারাক্ষণ যেন হাসছে। ব্যস্ততার মধ্যেও বুঝলাম, আমার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে।
বিয়ের দিন রাতে আপার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। ঘোর বর্ষা। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। ওদের বাড়ির লোক এল নৌকা নিয়ে। ছোট খাল দিয়ে নৌকায় আমাদের যেতে হবে।
ঘরে ঢোকার মুখেই শুনতে পেয়েছিলাম তার হাসি। নৌকায় উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার কাপড়চোপড় ভেজা। লগির আঘাতে পানিতে যেমন ঢেউ ওঠে, তার হাসি অবিকল তেমন। আমার আশ্চর্য রকম শান্তি শান্তি লাগল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলাম। সে-ও তাকাল। তারপর দৌড়ে গিয়ে আমার জন্য তোয়ালে নিয়ে এল। তোয়ালেতে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিলাম। তার হাসির গন্ধ পাচ্ছি। মনে মনে বললাম, তুমিই আমার প্রথম।
হাসির রিনিঝিনি শুনতে পেলাম, তোয়ালের প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?
মুখ সরিয়ে দেখলাম, তার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
বলল, আসেন আমার সঙ্গে।
এখন পৌষের বিষণ্নœবিকেল। আকাশজুড়ে মেঘ। রোদগুলো গেছে শীতের বাড়ি।
আরেক পৌষের কথা মনে পড়ল। ওই দিন আপার শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। গভীর রাতে ‘আগুন, আগুন’ চিৎকারে ঘুম ভাঙে। বাইরে গিয়ে দেখি, কিছুটা দূরে ঘরবাড়ি জ্বলছে। আমরা উঠানে দাঁড়িয়ে দেখছি। আগুনের আভায় দেখলাম, সবার মুখে শঙ্কা। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে আমার দিকে তাকাল। বলল, আমরা পুরুষ হলে দৌড়ে আগুন নেভাতে যেতাম।
এভাবেই চলছিল, কত আড্ডা, হাসি, ইশারা, ঠাট্টা। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। স্বৈরাচারের পতনের পরের দিনের কথা। তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর হাসি, ইশারায় ভরসা করেই কি যাওয়া!
সেদিন আমার কী হয়েছিল, জানি না। নিজেকে এ রকম শূন্যও কখনো মনে হয়নি। মনে হলো, আমার কিছু একটা পাওয়া দরকার,Ñকারও ছোঁয়া কিংবা তারও চেয়ে বেশি কিছু। নাহয় বাঁচব না। নিজেকে ফিরে পেতেই হবে। হয়তো সে আমার আমাকে খুঁজে দেবে।
অনেকবার তার মুখোমুখি হলাম। বুক এমন কাঁপছে, আরেকটু হলেই হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে পড়ে যায় আরকি। জীবনের সব সাহস একত্র করে একসময় বললাম, তোমাকে চুমু খেতে চাই।
সে অদ্ভুতভাবে তাকাল। তার চাহনি দেখেই আমি ‘নাই’ হয়ে গেলাম। কী বোকা! ধিক্কার দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কথাটা কেন বললাম?
মনে করতাম, ভালোবাসার প্রার্থীর মধ্যে অপার্থিব, নিরবয়ব, গভীর কোনো আলো থাকে। সম্পর্কের মধ্যে তা প্রাণ সঞ্চার করে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে যে ঐক্য, তা তো আমি গড়ে তুলতে পারিনি। আত্মার জ্যোতি মুছে গিয়ে অন্ধকার জমল। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।
কাউকে চুমু খেতে চাওয়ায় যে কত অপরাধ, সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। শরীরের আগে মন পাওয়াটা কনফার্ম করে নিতে হয়। তার চাহনিতে ছিল, ছি ছি, তুমি এত নীচ!
নীচই তো, নাহয় তাকে চুমু খাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব কেন? সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা ছিল কি না, আজও জানতে পারিনি।
এরপর অনেকটা পালিয়েই এসেছিলাম। পরে শুনেছি ওই দিনের ঘটনার আগেই তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
তারপর অনেকবার তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। হলো না। সে চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। আমার জীবনও গেল পাল্টে।
আজ আমি তাকে খুঁজছি। একটা কথা বলব। নীলিমা, যে কথা আমার অন্তর ছাড়া আর কেউ জানে না, সেই কথা একবার তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে, আজ, এই মুহূর্তে। তুমি কি আসবে? একবার অন্তত আমার প্রাণের কাছে এসো।
আমার হাহাকার আমার কাছেই থাক। তোমার মনে যদি আমার প্রতি কোনো ঘৃণা থাকে, তা-ও থাক।
জানো? মানুষ এখন আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। হিংস্রতা একটু একটু মুছে, ঘৃণা মুছে আমি যাব তোমার কাছে। হয়তো কথাটা বলব। আমাকে বলতেই হবে। ওটা ছাড়া যে পৃথিবী আরও বর্বরতার জায়গায় পরিণত হবে!
ভালোবাসা আগুন কিংবা পানির মতো। জ্বালিয়ে, ডুবিয়ে শুদ্ধ করে দেয় একেবারে। সেই কথা তাকে বলব। সে হয়তো শুনবে না। কিন্তু পৃথিবীর যে শ্বাস-প্রশ্বাস, অণু-পরমাণু, সেখানে কোথাও কথাটা পৌঁছে যাবে। কেউ হয়তো তা শুনবে।
কথাটা আমি বলব কোনো এক বিকেলে। কেননা, ওই একটি শব্দে ছোঁয়া যায় হৃৎপিণ্ড। ভাবতে ভাবতে মেয়ের রুমে যাই। দেখি, সে কাঁদছে।
কী হলো, মা! আজ কলেজে যাসনি?
সে কিছু বলে না। বাবা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমি দেয়ালের দিকে তাকাই। দেয়ালে ওর মায়ের ছবি। আজ প্রায় তিন বছর হলো সে নেই। ওর মা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। অদ্ভুত এক কান্না আমাকেও ছুঁয়ে যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরি। মায়ের কথা মনে পড়ছে?
সে কিছু বলে না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
মনে পড়ে, আজ নীলিমার জন্মদিন। ওর এই একটি ব্যাপারই আমার মনে আছে।
বাংলা ক্লাসে শহীদুল স্যার একবার বিখ্যাত এক শিল্পীর কথা বলেছিলেন। পোপ শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি পাথর এত ভালোবাস, রং ভালোবাস না কেন?
শিল্পী বলেছিলেন, এক রং আরেক রঙের সঙ্গে মিশে গেলে তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যায়। কিন্তু পাথরের বদল নেই।
আমি কি তাকে পাথরের মতো অন্তরে রেখেছিলাম! জানি না। হয়তো কাছে টানার নয়, দূরে সরিয়ে দেওয়ার বোকামিই করেছি।
আজ মনে হলো, আশ্চর্য এক রং আমি দেখছি। সেই রং ছড়িয়ে পড়ছে। মনে মনে বলি, হারিয়ে ফেলা, না হারানো সবকিছুই আমি ভালোবাসি। আমি একটি গাছের মতো তাকে ছুঁতে চাই।