চলে গেলেন বাংলাদেশের শেষ উর্দু গল্পকারদের একজন সিন মিম সাজিদ
১০ এপ্রিল ঢাকায় মারা গেলেন বাংলাদেশের শেষ উর্দু গল্পকারদের একজন সিন মিম সাজিদ। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন আরেক উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াস। উর্দু থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন।
সৈয়দ মুহাম্মদ সাজিদ বাংলাদেশের সেই গল্পকার, যার ব্যাপারে আমার একটা নিজস্ব মত আছে। তা হলো এই যে, যেখানে তিনি গল্প লেখা থামিয়েছেন, তারপর আর কোনো গল্পকার সেই মাইলফলক পার হয়ে যেতে পারেননি। সাজিদ গল্প লেখা শুরু করেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয় ১৯৭০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক 'চিত্রালি'তে। সে গল্পের নাম ছিল 'আরমানোঁ কা চারাগ'। মানে আশার প্রদীপ। সাজিদের গল্প সেই সময় পাঠকদের চমকে দিয়েছিল। সাজিদের জন্ম বেড়ে ওঠা সৈয়দপুরে। তাঁর বাবা আবদুল মুক্তাদির ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে সেখানে স্থায়ী হন। তিনি তখনকার পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে উঁচু পদে চাকরি করতেন। সাজিদের জন্ম সৈয়দপুরে। এই শহর একসময় উর্দু সাহিত্যের বিশেষ করে ছোটগল্পের নামজাদা কেন্দ্র বলে মান্য ছিল।
দেশভাগের পর এই শহরে যে উর্দু কবি, গল্পকাররা এসে সমবেত হন তাঁদের মধ্যে আহমদ সাদি আর আদিব সুহেইলের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁদের পর যে উর্দু গল্পকার সৈয়দপুর থেকে সামনে আসেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নওয়াব মুহিউদ্দিন, হায়দার সফি, হিদায়েত আনওয়ার, শেহজাদ আখতার, জয়নাল আবেদিন, জাকির আযিযি, শাহিদ কামরানী, ফরিদ শাহযাদসহ আরও অনেকে। এঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই দেশেই গল্প লিখে গেছেন। ১৯৭১ সালের পর সৈয়দপুর থেকে সাজিদ ছাড়াও উঠে আসেন আজিয নুমানিও। তবে নুমানি পরে আদিব সুহেইল, নওয়াব মুহিউদ্দিন, শাহজাদ কামরানির মতো পাকিস্তানে চলে যান। সাজিদের আবির্ভাব ঘটল সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গল্প সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে। ততদিনে এই ভূমিতে আরও কয়েকজন গল্পকার নিজেদের পরিচিতি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। তাদের মধ্যে আছেন গুলাম মুহাম্মদ, আইউব জওহর, শাম বারিকপুরি, কাজি মুহিউদ্দিন, খলিলুর রহমান যখমি, ইয়াওর আমান, কাসিম আনিস, এম কুলসুম, এম সলিমি প্রমুখ। কলিম আহমদ আর এম নয়িম সম্ভবত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হন। সাজিদ আগে কবিতা লিখতেন। তবে শীঘ্রই নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা গল্পকার সত্ত্বাকে খুঁজে পেয়ে যান। ১৯৭১-এর পর তিনি বাংলাদেশের উর্দুভাষীদের দুর্দশাকেও নিজের লেখা গল্পের উপজিব্য করে তুললেন। তিনি এই মানুষদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির প্রেক্ষাপটে কথাসাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন।তাঁর প্রথম দিকের গল্পগুলোর মধ্যে 'মামু সি বাত' (মামুলি কথা), 'বুঢ়ি আঁখে' (বুড়ি চোখ), 'সলিব কি সায়ে' (ফাঁসিকাঠের ছায়ায়), আর 'কাহানি কি কতল' (নিহত গল্প) পাঠকদের চমকে দিয়েছিল। বাংলাদেশের বাইরের পাঠকরাও তাঁর পাঠক হয়ে গেলেন। ১৯৯৭ সালে শাহজাদ মনযর একটা বই লিখলেন। নাম, 'পাকিস্তানে উর্দু গল্পের পঞ্চাশ বছর'। সেই বইয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশের উর্দু গল্প নিয়ে একটা অধ্যায় ছিল। সেখানে ছিল সাজিদের তিনটি গল্প নিয়ে বিশদ আলোচনা। বাংলাদেশের প্রথম দিকে একটা সমস্যা ছিল উর্দু লেখা মুদ্রণ। অফসেট আর লিথোগ্রাফে ছাপার মতো আধুনিক প্রযুক্তিগুলো উর্দু বই বা পত্রিকা ছাপায় কাজে লাগানোর উপায় ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে সাজিদ 'শাহকার পাবলিকেশন্স' নামে নিজেই এক ছাপাখানা খুললেন।
তাঁর প্রথম দিকের গল্পগুলোর মধ্যে 'মামু সি বাত' (মামুলি কথা), 'বুঢ়ি আঁখে' (বুড়ি চোখ), 'সলিব কি সায়ে' (ফাঁসিকাঠের ছায়ায়), আর 'কাহানি কি কতল' (নিহত গল্প) পাঠকদের চমকে দিয়েছিল। বাংলাদেশের বাইরের পাঠকরাও তাঁর পাঠক হয়ে গেলেন।
সেখান থেকে ছাপা শুরু হলো উর্দু পত্রিকা 'শাহকার'। সন ছিল ১৯৮০। এই পত্রিকা যখন ইসমত চুগতাইয়ের হাতে পৌঁছালো, উনি বিশ্বাস করতে পারলেন না যে এত সুন্দর ছাপার পত্রিকাটি বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে। ১৯৮৪ সালে শাহকার পাবলিকেশন্স থেকে ছেপে বের হলো আহমদ সাদি আর সাজিদের গল্প সংকলন 'দুদে চারাগে ম্যহফিল' (আসর শেষের প্রদিপের ধোঁয়া)। সেখান থেকে ১৯৮৯ সালে ছাপা হলো আহমদ সাদির গল্প সংকলন 'মিট্টি কি খুশবু' (মাটির সুগন্ধ)। সাজিদের ছাপাখানা থেকেই আমার প্রথম কবিতার বই 'আয়িনা রেযে' ছাপা হলো। এই দুটো বইয়ের প্রকাশনা উৎসব আয়োজন করল 'আলমি আদবি মরকয' (আন্তর্জাতিক সাহিত্য কেন্দ্র)। সারা বাংলাদেশ থেকে উর্দু সাহিত্যিক-কবিরা এলেন। তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সাজিদ। তাঁদের আসা-যাওয়া, আবাসসহ সব ব্যবস্থা তিনি নিজেই আয়োজন করলেন। ১৯৯৪ সালে সাজিদ আরেবকটি সাহিত্য পত্রিকা বের করলেন।
নাম 'দস্তক', মানে কড়া নাড়া। এই ছিল সাজিদের শেষ সৃজনশীল সাহিত্য-কীর্তি। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের উর্দু ছোট গল্পের সবচাইতে উজ্জ্বল নাম সিন মিম সাজিদ।
সাজিদ খুব কম বয়সেই বাস্তব অনুসারী ছোটগল্পের আধুনিক কৌশলগুলো প্রয়োগ করা শুরু করেন। বাংলাদেশের প্রথম সারির ছোটগল্পকার হয়ে উঠতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। 'সলিব কে সায়ে', 'কাহানি কা কতল' বা 'পাগল'-এর মতো গল্প বাংলাদেশের বাইরে গল্পকার হিসেবে তাঁর উজ্জ্বল পরিচিতি দাঁড় করিয়েছে। যত দ্রুত তিনি গল্প লিখে নিজেকে পরিচিত করেছেন, ততই দ্রুত সরে দাঁড়ান গল্প লেখার জগত থেকে। তাঁর মতো গল্পকারের ফিরে আসার জন্য বাংলাদেশ আরও অনেক দিন অপেক্ষা করবে।