গোপাল ভাঁড় কে ছিলেন?
মিষ্টির দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে সন্দেশ, পানতোয়া, রসগোল্লাসহ হরেক মিষ্টান্ন। এমন রসাল মিঠাই দেখে কার না জিবে জল আসে! ছোট্ট গোপালেরও এল। মামাবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। পথিমধ্যে দোকানে মিষ্টি দেখে জিবে জল আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খিদেও গেল বেড়ে। পেটে যেন শুরু হলো ছুঁচোর কেত্তন। কিন্তু হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। কী করা যায়? গোপাল দেখলেন, দোকানে বসে আছে ময়রার ছেলে। আর তার বাবা দুপুরের খাবার খাচ্ছে পেছনের ঘরে বসে। অমনি থালায় সাজানো মিষ্টি টপাটপ করে খেতে শুরু করলেন তিনি। আকস্মিক এই কাণ্ডে ময়রার ছেলে তো অবাক। ‘কে রে তুই? বলা নেই, কওয়া নেই, দিব্যি মিষ্টি খেয়ে চলেছিস? কী নাম তোর?’ বলল সে। একের পর এক মিষ্টি পেটে চালান দিতে দিতেই গোপালের জবাব, ‘আমার নাম মাছি। আমি তো রোজই মিষ্টি খাই। তুই কি নতুন দেখলি আমাকে?’
ছেলেটি এরপর তার বাবাকে ডেকে বলল, ‘বাবা, মাছি মিষ্টি খাচ্ছে।’ বাবা বলল, ‘খাগগে। ও আর কত মিষ্টি খাবে। রোজই তো খাচ্ছে। তুই কোনো দিন ওকে আটকাতে পারবি না।’
শেষমেশ ছেলে আর কী করে! চুপ হয়ে গেল। গোপাল ততক্ষণে দোকানের সন্দেশগুলো শেষ করে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বাড়ির পথ ধরেছেন।
ঢোল-শোহরত করে কাউকে আর বলে দেওয়ার দরকার নেই, ওপরের গল্পটি গোপাল ভাঁড়ের। যিনি ভাঁড়, আমাদের কাছে তিনিই তো গোপাল। ভাঁড়ের অবয়ব মনে এলে তাই অবধারিতভাবে টাকমাথায় টিকিওয়ালা পেট মোটা দারুণ এক রগুড়ে লোকের চেহারাই ভেসে ওঠে বাঙালির চোখে। তাঁর নাম অবশ্যই গোপাল ভাঁড়। কালপরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত তাঁর গল্প শুনে হাসেনি এমন গোমড়ামুখো বাঙালের দেখা পেতে গেলে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো ঘটনা ঘটবে। কেননা, এখন অব্দি গোপাল ভাঁড়ই রসপ্রিয় বাঙালির মৌখিক ঐতিহ্যের যথাযোগ্য প্রতিনিধি। লোকমুখে পল্লবিত তাঁর গল্পগুলোতে চমৎকার হাসির রেখা আছে বটে, তবে ওই হাসির নেপথ্যে গুপ্তঘাতকের মতো রয়েছে মিছরির ছুরিও—এক সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে সমালোচনার মাধ্যমে কেটে উদোম করে দেয় সেই ছুরি। আছে লোকশিক্ষা, নীতিশিক্ষা ও মোটাদাগে সমাজসংস্কারের ব্যাপার-স্যাপার। এত কিছুর পরও গোপাল বাঙালির কাছে ভাঁড় বই বেশি কিছু নয়, হাস্যরসিক এক কৌতুকপ্রিয় চরিত্র। তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এর মধ্যেই নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও অ্যানিমেশন ছবি। এ ছাড়া কে না জানে, উনিশ শতকের শুরুতে সদ্য গঠিত নগর কলকাতায় বিপুল পসার জমানো বটতলাকেন্দ্রিক সাহিত্যের অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই গোপাল ভাঁড়ের গালগল্প।
আজকের বাংলাদেশে গোপাল ভাঁড়ের জয়জয়কার আগের মতো নেই। তার পেছনে সামাজিক কিছু কারণ নিশ্চয়ই আছে। পাশাপাশি এ-ও ঠিক যে বাঙালির হৃদয় থেকে হাস্যরসিক এই চরিত্রটিকে মুছে দেওয়া অত সহজ নয়। কেননা, কালে কালে গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে গঙ্গা-পদ্মা-যমুনায় কম জল ঘোলা হয়নি। গোপাল ভাঁড় কে? আদতেই কি এই নামে কেউ ছিল? নাকি গোপাল একাধিকজনের সমষ্টি?
কেউ বলেছেন, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে বাস্তবেই ছিলেন তিনি। কারও কারও কথা, গোপাল ভাঁড় নামে একক কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব খোঁজা বৃথা। কারণ, ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না।
গোপালের অস্তিত্বের পক্ষে-বিপক্ষের এসব প্রশ্নে যাঁরা জোর তর্ক-বিতর্ক করেছেন, সবাই বিদগ্ধজন। ফলে জল ক্রমাগত ঘোলাই হয়েছে। সেই তুলনায় বিশিষ্টদের পাশে আমরা বরং ‘অবশিষ্ট’মাত্র। অবশিষ্টরা অনেক অকাজের ওস্তাদ। সঙ্গতকারণে গোপাল ভাঁড় ছিলেন কি নেই—প্রশ্নের তদন্তে ইতিহাসের ঘোলা জলে আরেকবার সাঁতার দেওয়া যাক। তাতে হয়তো পানি আরেকটু অধিক ঘোলা হবে, এর বেশি কিছু নয়।
বাঙালের গোপাল ভাঁড়-দর্শন
নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দরবার। তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (কৃষ্ণচন্দ্রই ভারতচন্দ্রকে রায়গুণাকর উপাধি দিয়েছিলেন) অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘বিদ্যাসুন্দর’ অংশ লিখে শেষ করেছেন। এখন সেটি পড়া হচ্ছে। রচনাটি দুহাতে ধরে পাঠ করছেন স্বয়ং ভারতচন্দ্র। এমন সময় দরবারে প্রবেশ করলেন গোপাল এবং কেউ কিছু বলার আগেই ভারতচন্দ্রকে উদ্দেশ করে হইহই করে উঠলেন তিনি, ‘ও হে কবিমশায়, করছেনটা কী, খাতাটা অমন কাত করে রেখেছেন কেন? রস যে গড়িয়ে পড়বে!’
উজ্জ্বলকুমার দাস সংকলিত গোপাল ভাঁড়ের সেরা ১০০ গল্প বইয়ে স্থান পাওয়া এই গল্পটি অবশ্যই রসে টইটম্বুর, তবে এখানে গোপালের তত্ত্ব-তালাশের প্রাথমিক একটি সূত্র হাজির আছে। সূত্রটি হলো কৃষ্ণচন্দ্র।
বাংলা অঞ্চলের প্রবল প্রতাপশালী চরিত্র নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০-৮৩) রাজত্বকাল ৫৫ বছরের। ১৮ বছর বয়সে তিনি যখন সিংহাসনে বসেন, তখন ১৭২৮ সাল। শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও শিল্প-সাহিত্যানুরাগী। যদিও ১৭৫৭-তে পলাশীর প্রেক্ষাপটে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের দায়ে ইতিহাসে তিনি ‘বেইমান’ হিসেবে চিহ্নিত, তবু এতে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের কাহিনি মুছে যায় না। তাঁর সভাসদ ছিলেন মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ।
এই কৃষ্ণচন্দ্রের সভার অনেক রত্নের এক রত্ন ছিলেন গোপাল ভাঁড়—এমন বক্তব্য পণ্ডিতদের। এ বিষয়ে তাঁরা স্থির সিদ্ধান্তে না এলেও এই মতের পক্ষেই রয়েছে অধিকাংশের সায়। যেমন বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা বইয়ে অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন, ‘গোপাল রসিক-চূড়ামণি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভার ভাঁড় ছিলেন।’
১৯৫২ সালে হোমশিখা পত্রিকা গোপাল ভাঁড়ের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে নতুনভাবে বোঝাপড়াই ছিল পত্রিকাটির উদ্দেশ্য। সেখানে ‘গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচলিত গল্পসংগ্রহ’ নামের প্রবন্ধে অধ্যাপক মদনমোহন গোস্বামী লেখেন একই কথা, ‘শোনা যায়, মহারাজের (রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের) সভায় আরেকটি রত্ন ছিলেন—তিনি স্বনামখ্যাত রসসাগর গোপাল ভাঁড়।’
তাহলে কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের সময় থেকে আমাদের এই সময়ের দূরত্ব ১৭০০ থেকে ২০০০—৩০০ বছরের। কিন্তু মাত্র ৩০০ বছরের আগেকার মানুষ গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে এত ধোঁয়াশা থাকবে কেন, যেখানে তাঁর সমসাময়িক কৃষ্ণচন্দ্র, ভারতচন্দ্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব নেই? এর কারণ, একেক মুনির একেক মত।
সুকুমার সেন, পরিমল গোস্বামী, অতুল সুর কি অজিতকৃষ্ণ বসু প্রমুখ পণ্ডিত গোপাল ভাঁড়ের বিভিন্ন প্রসঙ্গে যখন দ্বিধাবিভক্ত, তখন ১৯২৬-এ (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) বঙ্গভূমিতে মৃদু কম্পন জাগাল নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড় নামের একটি পুস্তক। লেখক শ্রীনগেন্দ্রনাথ দাস। তিনি নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর দাবি করলেন। শুধু কি দাবি? তাঁর বক্তব্যে প্রথমবারের মতো সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হলেন গোপাল ভাঁড়। আগে কেউ কেউ গোপালের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাঁর বংশের ঠিকুজি মেলে ধরতে পারেননি। নগেন্দ্রনাথের মতে, গোপালের প্রকৃত নাম গোপাল চন্দ্র নাই। তিনি ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ অন্তঃপুরের ভান্ডারের তত্ত্বাবধায়ক। তাই গোপাল চন্দ্র নাই থেকে তাঁর পদবি হয়ে গেল ভান্ডারি। ভান্ডারি থেকে আরও পরে ভাঁড়। তাঁর বাবার নাম দুলাল চন্দ্র নাই। প্রপিতা আনন্দরাম নাই। জাতিতে তাঁরা নাপিত। তবে দুলাল চন্দ্র ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁর শল্যচিকিৎসক বা বৈদ্য। ‘তৎকালে অস্ত্র-চিকিৎসা নাপিত জাতির অধিকৃত ছিল’ মন্তব্য করে নগেন্দ্রনাথ দাস নবদ্বীপ কাহিনীতে তথ্য দিয়েছেন, গোপালরা ছিলেন দুই ভাই। বড় ভাই কল্যাণ আর ছোট ভাই গোপাল। তাঁর জন্ম অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি, মুর্শিদাবাদে। নগেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় গোপালের গুণে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরে লইয়া যান। গোপাল অতি সুপুরুষ ও বাল্যকাল হইতে সুচতুর ও হাস্যোদ্দীপক বাক্যাবলী প্রয়োগে বিশেষ পটু ছিলেন। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের ন্যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের একটি পঞ্চরত্নের সভা ছিল। মহারাজ কৃষ্ণ গোপালের প্রত্যুৎপন্নমতি ও বাকপটুতা দেখিয়া তাঁহাকে স্বীয় সভায় অন্যতম সদস্য পদে নিযুক্ত করেন।...গোপালের একটি পুত্র ও রাধারাণী নামে একটি কন্যা ছিল। রাধারাণীর দুই পুত্র রমেশ ও উমেশ। বহুদিন হলো সে বংশ লোপ পাইয়াছে।’
এসব বলে শেষে নরেন্দ্রনাথের ভাষ্য এমন: গোপালের বংশ লোপ পেলেও তিনি তাঁর ভাই কল্যাণের নবম অধস্তন পুরুষ।
খটকার রাজ্য ও গোপাল
গোপাল সম্বন্ধে এটুকু জানার মধ্য দিয়ে সব মিটমাট হয়ে গেলে এবং নরেন্দ্রনাথ মহাশয়কে এককথায় গোপালের বংশধর মেনে নিলে কথা ছিল না। কিন্তু খটকা পিছু ছাড়ল না পণ্ডিতদের। তাঁরা বললেন, কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাসদ কবি ভারতচন্দ্র ও সংগীতজ্ঞ রামপ্রসাদ দুজনকেই জমি দান করেছিলেন। গোপাল যদি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয়পাত্র ও ওই আমলের লোক হবেন, তবে নদীয়া বা কৃষ্ণনগরে তাঁর কোনো ভূসম্পদ থাকার প্রমাণ নেই কেন? এমনকি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহাফেজখানায় গোপালের অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো দালিলিক প্রমাণাদি নেই। তাঁর কোনো ছবিও নেই।
গোপালের অস্তিত্ব নিয়ে যাঁদের খটকা বেশি, তাঁরা আরও বেশি মাত্রায় যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন ভারতচন্দ্রের কাছ থেকে। মধ্যযুগের বিশিষ্ট এই কবি অন্নদামঙ্গল কাব্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর সভাসদদের অনেকের সম্পর্কে লিখলেও লক্ষণীয়ভাবে এতে গোপাল ভাঁড় বিষয়ে টুঁ শব্দটিও নেই। গোপাল যদি তাঁর সমসাময়িক এবং একই সভার সদস্য হতেন, তবে ভারতচন্দ্রের লেখায় তাঁকে পাওয়া যেতই—এই তাঁদের ফয়সালা।
খটকা আরও আছে। গোপালের অনেক গল্পে তাঁর মা ও স্ত্রীর প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু গোপালের মা আর বউ সম্পর্কে ইতিহাস বিস্ময়করভাবে নীরব। তাঁরা বেঁচে আছেন কেবল গল্পেই।
ফলে নগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা নবদ্বীপ কাহিনী কিতাবটিকে গোপালের একক ব্যক্তি অস্তিত্বে সন্দিহান পণ্ডিতেরা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। উপরন্তু প্রশ্ন তুলেছেন, গোপালের উত্তরাধিকারী বিষয়ে লেখকের দাবি নিয়েও: গোপালের বড় ভাই কল্যাণের বংশ-পদবি ‘নাই’ হলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম নগেন্দ্রনাথের পদবি ‘দাস’ কেন?
এ সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ নিরুত্তর। তবে তাঁর বর্তমান প্রজন্ম—যাঁরা এখন বাস করছেন কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাধাপ্রসাদ লেনে—তাঁদের বক্তব্য, ‘নরেন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর পারিবারিক পদবি পরিবর্তন করেছিলেন।’
বছর চারেক আগে (২০১৪) গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে নামে সুজিত রায় প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। নগেন্দ্রনাথ দাসের বর্তমান বংশধরদের বক্তব্য ওই বই থেকে উদ্ধৃত। গোপাল ভাঁড় প্রসঙ্গে বইটিতে সুজিতের অনুসন্ধান বিস্তর। বিভিন্নজনের বিচিত্র লেখাপত্রের সঙ্গে ইতিহাসকে মিলিয়ে তিনি গোটা পুস্তকে খুঁজেছেন হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ব। বলা ভালো, নানা রকম প্রশ্ন ও যুক্তি খণ্ডন করে গোপালকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত করার দিকেই তাঁর বেশি ঝোঁক। এ ক্ষেত্রে ওপরে লিপিবদ্ধ খটকাগুলোর জবাবও দিয়েছেন তিনি।
গোপালের ভূসম্পত্তির সন্ধান না পাওয়া বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘গোপাল সম্ভবত হাত পাততে জানতেন না। হয়তো সে কারণেই গোপাল মহারাজার দাক্ষিণ্য বঞ্চিত হয়েছেন।’ তা ছাড়া বলার মতো একটি তথ্য আছে বইয়ে: রমেশ-উমেশের মৃত্যুর মাধ্যমে যেহেতু ‘গোপালের প্রত্যক্ষ বংশধারা লুপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং জমিজায়গার নথিপত্র তারপর কি হয়েছে কে বলতে পারে!’ একইভাবে ভারতচন্দ্রের লেখায় গোপালের উল্লেখ না থাকা নিয়ে তাঁর পাল্টা যুক্তি, ঈর্ষা আর ‘আত্মপ্রচারের বাগাড়ম্বরে তিনি (ভারতচন্দ্র) গোপাল ভাঁড়ের মতো বিরল প্রতিভাকে নিঃশব্দে বর্জন করেছেন।’
গোপাল ভাঁড়ের সন্ধান করতে গিয়ে সুজিত রায়ের কিছু কথায় যুক্তির জোর আছে সন্দেহ নেই; তবে গায়ের জোরও যে আছে!
গোপাল ভাঁড় নস্যাৎ হয়ে গেছেন?
সত্যি সত্যিই গোপাল ভাঁড় নেই! সুকুমার সেনের মত আমলে নিলে ঘটনাটি তেমনই দাঁড়ায়, ‘গোপাল ভাঁড় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক ছিলেন, এই আধুনিক জনশ্রুতি এখন প্রায় ঐতিহাসিক সত্য বলে গৃহীত হতে চলেছে। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি সত্তর-আশি বছর আগে জনশ্রুতিতে কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ গোপাল ভাঁড়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।’ (‘গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে’, হোমশিখা, ১৩৬১)। কিন্তু সেকালের বিখ্যাত এই ইতিহাসবিদের কথাগুলো একেবারেই মানতে চায় না মন। বরং বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো মনে হয় তখন, যখন একালের আলোচিত ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রও একই সুরে কথা বলেন। বলেন যে গোপাল ভাঁড় শহুরে লোকসংস্কৃতির সৃষ্টি। (দ্য টেলিগ্রাফ, ১১ মে ২০১৪)। বাঙালির আদরের এই ধনটি তাহলে বাস্তবে নেই? গোপাল ভাঁড় নস্যাৎ হয়ে গেছেন? অগত্যা এ বিষয়ে আরেক প্রস্থ ঘাঁটাঘাঁটি করতেই হয়। গোপালকে নিয়ে আরও যেসব বিষয়-আশয় মাথার মধ্যে গোলমাল পাকায়, সেগুলো তাঁর জাতি, বাসস্থান, পড়ালেখা, পদবি প্রভৃতি তথ্যের বিভিন্নতা।
‘জাতিতে নাপিত’-এর বিপরীতে কোনো কোনো গবেষক গোপালকে কায়স্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকের মতে, তিনি বাস করতেন কৃষ্ণনগরে। বাঙ্গালা ক্ষিতীশ বংশালী গ্রন্থের ভাষ্য, গোপাল ছিলেন শান্তিপুরের বাসিন্দা। কথিত আছে, তাঁর বাড়ি ছিল ঘূর্ণীতে। আবার নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষ-এপাওয়া যাচ্ছে, গোপালের বাড়ি গুপ্তিপাড়া। কারও ভাষায়, তিনি পড়ালেখা জানতেন। কেউ বলেছেন, জানতেন না। আর এই মহাত্মার পদবি নিয়েও আছে যথেষ্ট ধন্দ—নাই, বিশ্বাস, হাস্যার্ণব, ভান্ডারি, ভাঁড়—তবে কোনটি সঠিক?
শুধু তথ্যের পর তথ্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, গোপালের বিয়ে ও মৃত্যু নিয়ে ইতিহাস ভীষণ চুপচাপ। তো, বহুচর্চিত এই রসিক সম্বন্ধে ইতিহাসের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম কী বলেছেন, এবার টুকে নেওয়া যাক সেটুকু, ‘কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দেহরক্ষক হিসেবে শঙ্কর তরঙ্গ নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।...হয়তো তিনিই পরবর্তীকালে গোপাল ভাঁড় হিসেবে কল্পিত হয়েছেন।’ (বাংলাপিডিয়া)।
ধন্দের পর ধন্দ। মুশকিল আসানের কোনো বার্তা নেই।
গোপাল ভাঁড় আছেন
বাস্তব চরিত্রের শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে গোপাল ভাঁড়ের আকারে-গড়নে বেশ খানিকটা খামতি হয়তো আছে, সে ক্ষেত্রে তিনি সামষ্টিক মানুষের কল্পিত কোনো অবয়ব, না বাস্তব একটি চরিত্র—এ বিতর্ক অনিঃশেষ। গোপাল ভাঁড় কোনো বই লেখেননি। তাঁর প্রতিটি গল্পই মানুষের মুখে মুখে ঘুরে জনপ্রিয় হয়েছে। তাই মৌখিক সাহিত্য যে প্রক্রিয়ায় বাহিত হয়—কোনো ব্যক্তি যখন চমকপ্রদ কোনো গল্প শোনেন, তাঁর মধ্যে সেই গল্পটি পুনরায় বলার ইচ্ছা তৈরি হয় এবং পুনঃকথনকালে তাঁর অজান্তেই গল্পটি কিছুটা বদলে যায়—এভাবেই কি গোপাল জনমানসে পৌঁছেছেন? অলোক কুমার চক্রবর্তী তো বলেছেনই, ‘নদীয়ার হাস্যরসিক মানুষই কাল্পনিক হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের সৃষ্টিকর্তা। হয়তো গোপাল ভাঁড়—এই ছদ্মনামের অন্তরালে তাঁরা তাঁদের হাস্যরস প্রকাশ করেছেন।’ (‘গোপাল ভাঁড়: কল্পনা বনাম বাস্তব’, দৈনিক বসুমতী, ১৯৮২) এই কথায় অতঃপর শান্তি আসে, ধড়ে পানি আসে। শেষ পর্যন্ত তাহলে গোপাল ভাঁড় আছেন। রয়েছেন নিম্নবর্গের বাঙালির প্রতিনিধি হয়ে, তাঁদের হাস্যরসে, দুঃখেও। এই বাংলার সামন্ততান্ত্রিক সমাজে একদা যখন ছিল নগরসভ্যতার উন্মেষকাল, তিনি ছিলেন সেই সমাজের রাজনৈতিক চেতনা। বিবেক। আর গোপালের রাজনৈতিক চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছিল ভাঁড়ামির ছদ্মবেশে। কিন্তু বিবেক গোপাল কি শুধুই ভাঁড়?
তাঁরই একটি গল্পের ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রশ্নটির উত্তর।
কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে একবার বললেন, ‘আমি সত্য-মিথ্যার মধ্যে দূরত্ব অনুমান করতে পারছি না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে একটু সাহায্য করলে ভালো হয়।’
গোপাল বললেন, ‘এ আর এমন কী কঠিন সমস্যা, মহারাজ! চোখ আর কানের মধ্যে যতটা দূরত্ব, সত্য ও মিথ্যার মধ্যেও ততটা।’
গোপালের কথার মাজেজা বুঝলেন না কৃষ্ণচন্দ্র। বললেন, ‘বুঝিয়ে বলো। আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না।’
এবার গোপাল বললেন, ‘মহারাজ, যা শুনবেন, তা যদি চাক্ষুষ প্রমাণ করতে পারেন, তবে তা-ই হলো সত্যি। আর কানে শুনলেন, চোখে দেখলেন না, এটা কখনো সত্যি নয়। সে জন্যই সত্য-মিথ্যার সঙ্গে চোখ-কানের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং চোখ-কানের মধ্যে দূরত্ব যতটা, সত্য-মিথ্যারও দূরত্ব ততটা।’
এরপর ভাঁড়ামি অর্থে গোপালকে শুধু ‘ভাঁড়’ বলে পার পেয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ হবে!