কেন এই হননযজ্ঞ?
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত ফল, আমাদের রক্তাক্ত স্বাধীনতা। এটি নিছক একটি দিন বা নয় মাসের যুদ্ধযাত্রার ফলে এসেছে, এমনটি বলা যায় না। দেশভাগের পর বহুদিন ধরে এই লড়াইয়ের জমি প্রস্তুত করতে হয়েছিল নানাভাবে, নানা দিক থেকে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-তাজউদ্দীন আহমদের মতো প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার রাজনৈতিক নেতারা যেমন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি তাঁদের প্রধান সহযোগী-সহায়ক ছিলেন এ দেশের মূলধারার বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীরাই; তা সক্রিয় সম্মুখভাবে হোক, কিংবা অন্তর্গত প্রান্ত থেকে। বস্তুত রাজনৈতিক নেতাদের শক্তির সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের এই শক্তি যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতালাভ এক বাড়তি দুরন্ত মাত্রা এবং গতি পেতে সক্ষম হয়।
বুদ্ধিজীবীদের কেউ লড়াই করেছেন পত্রিকায় লিখে, কেউ বা হাটে-মাঠে জনমানুষের গণসংগীত গেয়ে। আবার কেউ ক্লাসরুমে পাঠদানের সময় ছাত্রদের বুঝিয়ে দিয়েছেন মেকি রাষ্ট্র পাকিস্তানের ফাঁক ও ফাঁকি। উদ্দেশ্য ছিল সর্বদা একটিই—জনগণকে সংগঠিত করা। যেন তাঁরা রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে, মাঠে নামে জঙ্গিশাহি সেনাশাসনকে অচল করে দিতে। পত্রিকার কলাম, ক্লাসরুমের পাঠ কিংবা ময়দানের গণসংগীত—সবকিছু একই সুরে মিলিত হয়ে জনগণের মনে যে বিদ্রোহী অনুরণন তুলেছিল, তা ঠেকানোর সাধ্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের ধর্মান্ধ দেশীয় সমর্থকদের ছিল না। ভাষা আন্দোলনের স্রোতধারা বেয়ে একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামে পৌঁছানো—এ ব্যাপারটি বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার অভিঘাতে উল্টো ত্বরান্বিত হয়েছিল। ইত্তেফাক–এ ক্ষুরধার কলামের মাধ্যমে যেমন সিরাজুদ্দীন হোসেন, তেমনি বিদ্রোহী সুরের ধারায় একটু একটু করে বাংলাদেশের ভিত্তিভূমি তৈরি করছিলেন আলতাফ মাহমুদ। মেহেরুন্নেসা বা সেলিনা পারভীনের মতো সাংবাদিকেরা লিখেছিলেন বাংলার জনমানুষের পক্ষে। বাঙালিত্বের পক্ষে ভরসা জোগাচ্ছিলেন ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর মতো চিকিৎসক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরম্ভ করে সুদূর উত্তরের রাজশাহীতে পর্যন্ত কত না শিক্ষক–ছাত্রদের মনে পাকিস্তানি একদেশদর্শিতার বিপরীতে জাগিয়ে দিচ্ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও বাঙালিত্বের আলো। গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমদ থেকে শুরু করে হবিবুর রহমান—কত কত উজ্জ্বল নাম মনের কোণে বাজতে থাকে অনিঃশেষ! অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও আমরা তৈরি করিনি আজতক, এ শূন্যস্থান পূরণের দায় আমাদের সবার।
চতুর ও চরম নৃশংস পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও বিষয়টা বুঝেছিল হাড়ে হাড়ে। তাই এ দেশের রাজনৈতিক শক্তিকে তারা যেমন নিঃশেষ করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকেও বিনাশ করতে উদ্যত হয়। দেশের বাছাই করা মানুষদের, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হলো। এ কাজ তো পাকিস্তানি বাহিনী একাই করেনি। তাদের সঙ্গে আর কারা এই অপকীর্তি ঘটাল? অপরিসীম ঘৃণা আর ক্রোধে মাথা ছিঁড়ে যেতে চায়, যখন জানি, আগাগোড়া মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নানা স্থানে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে যারা, তাদেরই একটা অংশ ঢাকায় এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিকল্পিত এই ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে অন্যতম এ দেশেরই কিছু দোসর, ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরের পুরোটা সময়েই চলে স্বাধীনতাকামী মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে নৃশংস হননযজ্ঞ। চূড়ান্ত আঘাত এল ১৪ ডিসেম্বর। একদিনে যেন পুরো জাতি নিঃস্ব হয়ে গেল। সহায়-সম্পদে নিঃস্বতার চেয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নিঃস্বতা কম ক্ষতির নয়। আমাদের সেই চরম ক্ষতি হলো। আগেই বলেছি, নয় মাসজুড়ে গোটা দেশেই অনেক গুণী প্রতিভাবান মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু রাজধানী ঢাকাতেই তাঁদের ওরা এক জায়গাতেই প্রায় সবাইকে খুঁজে পেয়েছিল। এই ক্ষতিটা সে জন্য পূরণ হওয়ার নয়।
তাদের হত্যাযজ্ঞ শেষ হয় না দেশ মুক্ত হওয়ার পরও, জহির রায়হানের মতো আরও অনেকেও তখন হারান খুনিদের করালগ্রাসে। নগরের কথা না হয় বাদই দিলাম, গহিনের কত গ্রাম ও গঞ্জে সংস্কৃতিমনা-উদার স্কুলশিক্ষক, চিকিৎসক বা সংস্কৃতিকর্মীও মানুষদের মনে বুনে দিচ্ছিলেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্র—তাঁদের অনেকেই তখন নিহত হলেন পাকিস্তানি হানাদার ও দেশীয় রাজাকারদের হাতে।
এখন, এই মুহূর্তে, কীভাবে স্মরণ করব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের? তাঁদের ছিল সরাসরি সত্যিটা বলার ক্ষমতা, তা নিয়ে জনতার কাছে যাওয়ার মতো অভিগম্যতা। আমরা যেন এ পথ ধরে হাঁটতে পারি। যেন নিরপেক্ষতার নামে বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে না থাকি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের কণ্ঠ যেন কখনো রুদ্ধ না হয়। যেন ধর্মান্ধ ও নিপীড়কদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেন অটুট থাকে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এটাই হোক আমাদের একান্ত প্রার্থনা।