>শুরু হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট। এই সাহিত্য উৎসব নিয়ে লিখেছেন এর অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ
লেখাটি যখন লিখছি, তখন ঢাকায় বসেছে সাহিত্যের হাট, ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। এবারে অষ্টমবারের আয়োজনে এসেছেন পুলিৎজারজয়ী লেখক, অস্কারজয়ী তারকা ও দেশ-বিদেশের বরেণ্য লেখক-চিন্তকেরা। সাহিত্যের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর সমাজের সংস্কৃতিমনা অংশে এর মধ্যেই জেগে উঠছে ঔৎসুক্য। আবার কেউ কেউ তুলছেন প্রশ্ন। বিভিন্ন মহল থেকে যে প্রশ্নগুলো আমরা শুনে এসেছি, তার একটু নমুনা দিই: লিট ফেস্টে বাংলা কতখানি জায়গা পাচ্ছে? বাংলা একাডেমির চত্বরে ইংরেজির ব্যবহার কেন? অনুষ্ঠানটি কি কেবলই উচ্চকোটির মানুষের জন্য? এখন এই প্রশ্ন তিনটিকে আরও বৃহৎ আঙ্গিকে এভাবে সাজাতে চাই: ১. বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে বাংলার অবস্থান কোথায়? ২. সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজন কী? ৩. সাহিত্য কখন সবার?
প্রশ্ন তিনটির মীমাংসা স্বল্প পরিসরে বা একক প্রয়াসে সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ণয়ে একজন লেখক, বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের অনুরক্ত পাঠক এবং লিট ফেস্টের একজন পরিচালক হিসেবে আমি খানিকটা ইঙ্গিত দিতে পারি। অতএব, সাংস্কৃতিক সত্তা যাচাইয়ের জায়গা থেকে এই তিন প্রশ্নের দিকে এবার একটু তাকানো যাক।
বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে বাংলার অবস্থান কী?
উত্তরের পরিবর্তে বিষয়টি এভাবে বোঝাই—কেবল ইংরেজি ভাষার দুই শীর্ষ রাজধানীর যেকোনো বইয়ের দোকানে গেলে ইউরোপের অনেক ভাষার অনূদিত বই যেমন দেখতে পাব, তেমনি সাহিত্যসমৃদ্ধ অন্য ভাষার বই—জাপানি, কোরিয়ান, তুর্কি, আরবি ইত্যাদিও পাওয়া যাবে। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সোমালিয়ার লেখক নুরুদ্দিন ফারাহ বা অনুন্নত ও ক্ষুদ্র ইউরোপীয় দেশ আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারের বইও পাওয়া যাবে এখানে। কিন্তু পাওয়া যাবে না বাংলাদেশের কোনো লেখকের বই। একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহির কি তবে ফারাহ বা কাদারের তুলনায় এতই ‘দুর্বল’ যে, কেউ তাঁদের লেখা পড়তে চাইবে না? অবশ্যই না। দুর্বল অনুবাদই এই পরিচিতির ঘাটতির অন্যতম কারণ।
এই ঘাটতি পূরণে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অনুবাদকেন্দ্র থেকে এখন শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অনুবাদের কাজ। লন্ডন, ফ্রাংকফুর্টসহ বিশ্বের বড় বইমেলাগুলোতে সরকারি উদ্যোগে যাওয়া শুরু করলে একদিন বাংলাদেশও ‘ফোকাস দেশ’-এর মর্যাদা পাবে এবং বাংলা ভাষার লেখালেখি বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে তার উপযুক্ত স্থান করে নিতে পারবে।
আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে—সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজন কী?
উত্তর: কী করলে বিশ্বদরবারে বাংলা যথাযথ সম্মান পাবে, তা নাহয় বোঝা গেল। লিট ফেস্টের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি আরও অনেক উদ্যোগের মাধ্যমে সে রকম জায়গায়ও পৌঁছানো যাবে। কিন্তু এত ঝামেলার কী দরকার? সুদূর যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার কেউ আমাদের জীবনানন্দ দাশ বা শামসুর রাহমান পড়ল-বুঝল কি না, তাতে কী আসে–যায়? হয়তো কিছুই না! তবে বনলতা সেনের চুল অন্য কেউ না জানলে সে বিদিশার নিশার মতোই অন্ধকার থেকে যাবে। শামসুর রাহমান নাম কোনো ভিন ভাষার মানুষ না জানলেও তো দুঃখ অবিরাম কড়িকাঠে লিখে যাবে তাঁর নাম। বাংলা গল্প-কবিতা বাঙালি পাঠকের মনে যে অনুরণন তোলে, তার পূর্ণতা হয়তো তাতেই সম্পন্ন হয়, হবে। অনুবাদের মাধ্যমে বা অবাঙালি পাঠকের তারিফ দিয়ে তাকে তেমন সমৃদ্ধ করা যায় না। তাহলে অনুবাদের কী দরকার? সীমানা পেরিয়ে আদান-প্রদানেরই–বা চেষ্টা কেন?
প্রশ্নটির উত্তর পেতে আমাদের এখন তৃতীয় ও শেষ জিজ্ঞাসাটিও ছুঁতে হবে—সাহিত্য কখন এবং কীভাবে সবার?
উত্তর: সাহিত্য তখনই সবার, যখন তা কোনো না কোনোভাবে সর্বজনীনতার মাত্রা অর্জন করে। সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল বলতে আমরা সচরাচর তেমন লেখাকেই বুঝি, যা স্থান-কালের গণ্ডি পেরিয়ে বহুদূরের মানুষকেও নাড়া দেয়। যেমন তলস্তয় বা গার্সিয়া মার্কেজের লেখা। কিন্তু এখানে আমার একটু ভিন্নমত আছে। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির সীমানার মধ্যেও যে লেখা বহু মানুষকে আন্দোলিত করে, তা সর্বজনীনতা অর্জন করে বলেই সেটি বিশেষ শক্তিসম্পন্ন। নিজের ভাষার মধ্যে সবার অভিজ্ঞতাও তো এক নয়—কেউ শহুরে বা ধনী, কেউ নিম্নবর্গের বা সংখ্যালঘু। কেউ ভিন্ন লিঙ্গের বা অন্য ধর্মের। এরপরও এ ধরনের ভেদাভেদ কাটিয়ে একজন রবীন্দ্রনাথ বা হুমায়ূন আহমেদের লেখা কত মানুষের মনকে সিক্ত করে তোলে। সর্বজনীনতার এমন ঐশ্বর্যময় সম্পদ আমরা কেবল নিজের জন্য রেখে দেব? কেবল ভাষার ব্যবধানের কারণে অন্য সবাই এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে?
বাংলা সাহিত্যের মূল ধারা ও শ্রেষ্ঠ লেখকেরা কিন্তু এ ধরনের অনুদারতার জায়গা থেকে লেখেননি। আমাদের পাঠকেরাও সাংস্কৃতিকভাবে খোলামনের। খোলামন আছে বলেই আমরা লিট ফেস্টের মতো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এবং আরও বহুভাবে দেদার বিশ্ব সংস্কৃতির ভান্ডার থেকে নিচ্ছি। তবে শুধু নেওয়ার চর্চাতেই কি একটি সংস্কৃতি তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারে? সাহিত্যের পূর্ণতা অনুবাদের ওপর নির্ভর করে না, কিন্তু সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় আলাপে আমাদের সংস্কৃতিকেও নতুন বিবেচনায়, নতুন করে যাচাইয়ের সুযোগ ঘটে। আর যে সত্তা-চেতনা কোনো নিরেট জায়গায় স্থির তা কেবল সীমিত নয়, ক্ষয়িষ্ণু হতে বাধ্য। সত্তার বিকাশে তাই নিরন্তর যাচাই অপরিহার্য।
ঢাকা লিট ফেস্টের মতো একটি উদ্যোগ এই ‘যাচাই’-এর একটি তাগিদ তৈরি করতে পারে। কিন্তু তাগিদটিকে অধ্যবসায়ে পরিণত করতে প্রয়োজন আমাদের লেখক-পাঠকদের সবার আগ্রহ ও চেষ্টা। সেই সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলা নতুন করে যুক্ত হোক বিশ্বসাহিত্যের সন্তরণী প্রবাহে।
যাঁরা এবারের মূল আকর্ষণ
অ্যাডাম জনসন
যুক্তরাষ্ট্রের ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার অ্যাডাম জনসন। ২০১৩ সালে দ্য অরফান মাস্টারস সান উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার। উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি আলোচনা করবেন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। এ ছাড়া ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ফিলিপ হেনশারের সঙ্গে তাঁর আরেকটি আলোচনা আছে শেষ দিন, কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে সোয়া ১১টায়।
নন্দিতা দাস
ভারতীয় অভিনেত্রী নন্দিতা দাস। কান চলচ্চিত্র উৎসবের একজন বিচারক হিসেবে ২০০৫ ও ২০১৩ সালে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নির্মিত পাকিস্তানি সাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টোর জীবনভিত্তিক ছবি মান্টো এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। উৎসবের প্রথম দিন প্রদর্শিত হয়েছে মান্টো। নন্দিতা কাল একটি অধিবেশনে কথা বলেছেন। আজও সকাল সোয়া ১১টায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আলোচনায় থাকবেন মনীষা কৈরালার সঙ্গে।
জেমস মিক
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক জেমস মিক ২০০৫ সালে অরওয়েল পুরস্কার পেয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বর্ষসেরা সাংবাদিক মিক দ্য পিপলস অ্যাক্ট অব লাভসহ লিখেছেন বেশ কিছু বই। আজ বেলা দুটোয় শামসুর রাহমান মিলনায়তনে এড কামিংয়ের সঙ্গে ‘দ্য গ্রেট বিট্রেয়াল’ শিরোনামের আলোচনায় থাকবেন তিনি। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আলোচনা করবেন জয়শ্রী মিশ্র, আহসান আকবর প্রমুখের সঙ্গে।
টিল্ডা সুইনটন
২০০৭ সালে মাইকেল ক্লেটন চলচ্চিত্রেঅভিনয়ের জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয় করেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইনটন। মস্কো ও বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ছিলেন বিচারক। আজ বেলা দুটোয় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লাস্ট অ্যান্ড ফার্স্ট মেন থেকে পাঠ করবেন তিনি। পরদিন বেলা সোয়া তিনটায় একই স্থানে ব্যতিক্রমী একটি স্কুলবিষয়ক তথ্যচিত্র বিষয়ে আছে তাঁর আরেকটি আলোচনা।
মনীষা কৈরালা
বলিউড অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা নেপালের বিখ্যাত কৈরালা পরিবারের সন্তান। সমাজসচেতনতামূলক কার্যক্রমে সক্রিয় এই শিল্পীর ক্যানসার ধরা পড়ে ২০১২ সালে। আজ বেলা সোয়া ১১টায় তিনি কথা বলবেন আরেক অভিনেত্রী নন্দিতা দাসের সঙ্গে, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। তা ছাড়া শনিবার বেলা সোয়া ১১টায় একই স্থানে মনীষা কৈরালা বলবেন ক্যানসারের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ করার গল্প।