কাজী আনোয়ার হোসেনের ভুবনে
>
পাঠকনন্দিত মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। প্রায় এক হাতেই আমাদের দেশে দাঁড় করিয়েছেন রহস্য–রোমাঞ্চ গল্পের জনপ্রিয় সাহিত্যধারা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনী পাঠক তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে এখানে। কিন্তু কাজী আনোয়ার হোসেন, পাঠকদের কাছে যাঁর পরিচয় কাজীদা নামে, তিনি কি কেবলই একজন জনপ্রিয় লেখক? বছরের শুরুতে এই আয়োজনে থাকছে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিভিন্ন ভুবনের খোঁজখবর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিবব্রত বর্মন ও রওশন জামিল
প্রশ্ন: থ্রিলারধর্মী সাহিত্যকে অনেকে সাহিত্য হিসেবে খুব গুরুত্ব দিতে চান না, লঘু মনে করেন। মনে করেন এগুলো শুধুই জনচাহিদা মেটায়। এ ব্যাপারে আপনার কী মত?
কাজী আনেয়ার হোসেন: থ্রিলার আমার ভালো লাগে। সেই কৈশোরে, আজ থেকে ৭৩ বছর আগে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত শ্রী হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখা ঘটোৎকচ, যকের ধন, আবার যখের ধন, নৃমুণ্ডু শিকারী ইত্যাদি থ্রিলার বইগুলো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। তার পরপরই হাতে পেলাম রবিন হুড। লেখকের নাম জানি না, সেসব খেয়াল করার বয়স ছিল না সেটা—বইটি অনেক খুঁজেও হাতে পাইনি আর। অপূর্ব লেগেছিল। রবিনের মৃত্যুতে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলাম; তার বীরত্ব, সাহস, নেতৃত্ব, বিপদগ্রস্ত ও ভাগ্যাহতদের প্রতি দুর্বলতা, গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতা, নারীর প্রতি সম্মান—এই সব গুণের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এই বইগুলো আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে আজও সে মোহের জাল কেটে বেরোতে পারিনি, চির কিশোর রয়ে গেছি। লঘু বলেন বা বলেন অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য; আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন।
প্রশ্ন: প্রবল জনপ্রিয় মাসুদ রানার স্রষ্টা আপনি। ৫০ বছরেরও বেশি আগে লিখতে শুরু করেছিলেন এই সিরিজ। এখন তো দুনিয়া পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আজ থেকে ৩০ বছর পর মানুষ কি আর মাসুদ রানা পড়ব? পড়লে কেন পড়বে বলে আপনার মনে হয়?
কাজী আনোয়ার হোসেন: সুদীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে পাঠক মাসুদ রানা পড়েছে এবং মজা পেয়েছে। এখনো সেই প্রথম বই কুয়াশা-ধ্বংস পাহাড়–এর মতোই নতুন বইগুলো যারা সাগ্রহে কিনে পড়ছে, তাদের মধ্যে নিত্যনতুন কিশোর আছে, তাদের স্বপ্নের বাগান ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী; আগামী ৩০ বছরেই তাদের সব আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না। নিজে থাকব না, কিন্তু যাদের গড়ে-পিটে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, আমি জানি, তারা আরও বহুদিন টিকিয়ে রাখবে সেবা ও তার সিরিজগুলোকে। তা ছাড়া, আমার খাতিরে বা আমার মুখ চেয়ে পাঠকেরা এসব বই কিনে পড়ছেন, ব্যাপারটা তা তো নয়, নিশ্চয়ই এসব কাহিনির ভেতর অন্তর্নিহিত বিশেষ কিছু আকর্ষণ ও আবেদন রয়েছে, যেগুলো সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে গেছে। তা না হলে যেসব সুসাহিত্যিক এত দিন মাসুদ রানার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে নিজেদের অনেক উঁচুতে তুললেন, এতগুলো বছর চেষ্টা করেও তাঁরা কি পাঠকদের এসব বাজে লেখা থেকে সরিয়ে নিজেদের লেখার প্রতি টানতে পেরেছেন? না। তাঁদের বিচরণক্ষেত্র ভিন্ন, কৈশোর পেরিয়ে তবেই না পরিণত বয়সে পৌঁছাবে মানুষ। আমিই কি কিশোর পাঠকদের চিরকৈশোরে ধরে রাখতে পারছি, ঠেলে দিচ্ছি না তাদের দিকে? ৩০ কেন, আগামী ৬০ বছরেও সেবার প্রয়োজন ফুরাবে বলে মনে করি না।
প্রশ্ন: শুরুর কয়কেটি উপন্যাস বাদ দিলে আপনার মাসুদ রানার কাহিনিগুলো সবই ধার করা। বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বন। মৌলিক মাসুদ রানা লিখলেন না কেন?
কাজী আনোয়ার হোসেন: মূল কারণ, আমার অভিজ্ঞতার অভাব। মাসুদ রানা বইয়ে যেসব দেশের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, ঘটনার কথা, জটিল পরিস্থিতির কথা থাকে, সেসব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিদেশি কাহিনির সাহায্য আমাকে নিতেই হয়েছে। কিন্তু বিদেশি সবকিছু আমাদের এখানে মানায়ও না।
মাসুদ রানার ৪৫৭তম সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে এখন। ৪৫৭! ভাবুন একবার। প্রথম দিকে মৌলিক রানা লেখার চেষ্টা করেছি। তারপরেই বুঝে গেলাম, বিদেশি কাহিনির ছায়া না নিয়ে কোনো উপায় নেই। সবটা নেওয়া যাবে না; রগরগে যৌনতা আমাদের সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য নয়, যে বিষয়গুলো চলবে, ততটুকুর ছায়া নিয়ে নিজের মতো করে রচনা করতে হবে বাঙালি মাসুদ রানার চরিত্র। এই একই সমস্যায় পশ্চিম বাংলার বড় বড় সাহিত্যিকও পড়েছিলেন বলে অকাতরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, লেসলি চার্টারিসের দ্য সেইন্ট, অ্যান্থনি হোপের দ্য প্রিযনার অভ—এমন আরও অসংখ্য বিদেশি লেখকের বই আত্তীকরণে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।
প্রশ্ন: অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডার বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরার কাজ দীর্ঘদিন ধরেই করছে আপনার সেবা প্রকাশনী। এর অনুবাদগুলোর ঝরঝরে ভাষা। কিন্তু অনেকে বলেন, এখন সেবা প্রকাশনী থেকে ভালো অনুবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ কী?
কাজী আনোয়ার হোসেন: আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না। সেবা আর অনুবাদ ছাপছে না? নাকি, ছাপছে কিন্তু সেগুলো ভালো হচ্ছে না? যাকগে, এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আমি তো ভালো জেনেই ছাপছি। যাঁরা এ কথা বলেন, কারণটাও নিশ্চয়ই আমার চেয়ে তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। ব্যাপারটা বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ গল্পের মতোও হতে পারে। যাঁরা আগে একসময়ে মুগ্ধ হয়েছেন, এখন তাঁদের কাছে ভালো না লাগারই তো কথা। তাঁরা তো আর সেই মানুষটি নেই, বয়স হয়েছে, মন-মানসিকতা ও বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে, বদলে গেছেন। তিনি কেন এখন পড়তে যাবেন এসব?
প্রশ্ন: স্পাই থ্রিলার ঘরানায় ইংরেজি ভাষায় অনেক সফল লেখকের দেখা মেলে। যেমন: ইয়ান ফ্লেমিং, জেমস হেডলি চেজ, টম ক্লেনেসি, ল্যাডলাম বা কিছু পরিমাণে জন লে কারে। কিন্তু বাংলায় কাজী আনোয়ার হোসেন ছাড়া আর সফল কাউকে দেখা যায় না। কারণ কী?
কাজী আনোয়ার হোসেন: কী বলব। মনে হয় আমাদের লেখকেরা ঘাপটি মেরে থাকেন ভ্রুকুটির ভয়ে। সুসাহিত্যিকেরা যদি এসব লেখাকে ছোট নজরে না দেখতেন, তাহলে হয়তো ইতিমধ্যেই আরও কয়েকটা কাজী আনোয়ার হোসেন গজিয়ে যেত।
প্রশ্ন: একজন প্রকাশক হিসেবে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজটিকে আপনি কতটা গুরুত্ব দেন? সেবা প্রকাশনী এই কাজটি কীভাবে সম্পাদন করে?
কাজী আনোয়ার হোসেন: সম্পাদনার কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ, একটি বই কেবল আনন্দই দিচ্ছে না, পাঠককে নানা ধরনের শিক্ষাও দিচ্ছে। তবে সম্পাদনা যিনি করবেন, তাঁর সে কাজের যোগ্যতা থাকা অপরিহার্য। প্রায় সব লেখকের লেখাতেই ভুল থাকে। বিদেশের মতো আমরাও যদি সুশিক্ষিত, উপযুক্ত সম্পাদক নিয়োগ দিতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের বাজার ছোট বলে পারি না। শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন সাহা তাঁর প্রকাশনী মুক্তধারায় এই চেষ্টা করে দেখেছেন, কিন্তু তেমন ভালো ফল পাননি। একজন উপযুক্ত সম্পাদককে যে পরিমাণ সম্মানী দেওয়া উচিত, তার দশ ভাগের এক ভাগও তো আমরা দিতে পারি না।
প্রশ্ন: আপনার বাবা বিখ্যাত সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। আপনাদের পরিবার মূলত গানের পরিবার। আপনি নিজেও একসময় গান করতেন। সিনেমায়ও গান করেছেন আপনি। আপনার সংগীতজীবনের এই পর্বটি সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
কাজী আনোয়ার হোসেন: শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা আমাদের পরিবারের মজ্জাগত। বাবা শিক্ষক ছিলেন, আমার বেশির ভাগ বোনই শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে চলেছে গানবাজনার চর্চা। বোনেরা গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত; আমার বাবা, সেজ কাকা আর ছোট ভাই কাজী মাহবুব হোসেন বাজিয়েছেন সেতার।
প্রশ্ন: গানের ক্ষেত্রেও দেখা গেল, পরিবারের অন্যদের চেয়ে ভিন্নপথে হাঁটলেন আপনি। রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন না। গাইলেন সিনেমার গান।
কাজী আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ, একটু ভিন্ন পথই আমার পছন্দ। রেডিও-টিভিতে আমি গেয়েছি আধুনিক, নজরুলগীতি ও পল্লিগীতি; সিনেমার প্লেব্যাকে গেয়েছি বাংলা ও উর্দু গান।
প্রশ্ন: সংগীতজীবন থেকে সরে গেলেন কেন?
কাজী আনোয়ার হোসেন: ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল—১০টা বছর তো গান গাইলাম, আর কত? তা ছাড়া, তত দিনে লেখালেখি ও প্রকাশনা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিয়ে ফেলেছি—দুটোই পূর্ণাঙ্গ চাকরির মতো। একজীবনে সবকিছু তো আর হয় না।
প্রশ্ন: সিরিয়াস বনাম পপুলার কালচার—বাংলা দেশের বাস্তবতায় বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কাজী আনোয়ার হোসেন: আমি এ নিয়ে তেমন একটা ভাবনার সুযোগ বা অবকাশ পাইনি। আমার যা ভালো লাগে তা-ই পড়ি। যা ইচ্ছে করে তা-ই করি। আমার মনে হয়, এই দুই ধারা মোটেই সাংঘর্ষিক নয়, সব রকম কালচারেরই প্রয়োজন আছে।
প্রশ্ন: আপনার পরিবারে বরাবর ছিল সিরিয়াস সাহিত্যের চর্চা। আপনি গেলেন পপুলার সাহিত্যের দিকে। সিরিয়াস বনাম পপুলার কালচার পরিবারের মধ্যে কি এই বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল?
কাজী আনোয়ার হোসেন: না, কখনোই না। আমার বাবা কাজী মোতাহার হোসেন প্রবন্ধ রচনা করতেন, বোন সন্জীদা খাতুন আত্মজীবনীমূলক সরস লেখার পাশাপাশি কঠোর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ধাঁচের বইও লিখেছেন, বড় বোন যোবায়দা মির্যা আত্মজীবনীর মতো করে লিখেছেন সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। আমার ভাই আর আমি লিখেছি রহস্য-রোমাঞ্চের বই। এ নিয়ে কারও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি আমাদের। বাবা তো রীতিমতো উৎসাহ দিয়েছেন। সন্জীদা খাতুনও আমার প্রথম রচনা কুয়াশা ১ ও ২-এর পাণ্ডুলিপি পড়ে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে থ্রিলার সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী?
কাজী আনোয়ার হোসেন: সব মিলিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ খুব ভালো—এমনটি বলতে পারছি না, দুঃখিত। শুধু থ্রিলার সাহিত্য কেন, এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, নাচ-গান-বাজনা-সিনেমা-ছবি-ভাস্কর্য, অর্থাৎ যা কিছু সুন্দর, সব ধরনের শিল্পসৃষ্টির ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ক্রমে। কিসের করাল গ্রাস গিলে খাচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধ, সেটা বাঙালিকে বুঝতে হবে। আমি তো চলেই যাব, যাঁরা এখানে থাকবেন তাঁদের সতর্ক হওয়ার কিন্তু এখনই সময়।
প্রশ্ন: আপনার এপিটাফে কী লেখা দেখতে চান?
কাজী আনোয়ার হোসেন: কিছু না। লাশটা ঢাকা মেডিকেল কলেজকে দিয়ে যেতে চাই। নিয়মকানুন জানার চেষ্টা করছি।