কাইয়ুম চৌধুরীর অমর হরফ

আজ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রয়াণ দিবস। তিনি ছিলেন প্রথম আলোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, এর দৃশ্যসজ্জার প্রাণপুরুষ। পত্রিকাটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। প্রথম আলোর স্বপ্ন ছিল, তাঁর অনুপম হস্তলিপি দিয়ে একটি টাইপফেস তৈরি হবে। কাজটি শুরুও হয়েছিল। প্রতিবার অফিসে আসার সময় তিনি পাঁচ–সাতটি করে হরফ লিখে নিয়ে আসতেন। ২০১৪ সালে তাঁর হঠাৎ প্রয়াণে কাজটি থেমে যায়। মার্কিন-সুইডিশ টাইপ ডিজাইনার জেকব টমাসের সঙ্গে প্রথম আলোর চমকপ্রদ যোগাযোগে সে অসম্ভব সম্ভব হলো। কাইয়ুম চৌধুরীর হস্তাক্ষরে তিনি প্রথম আলোর জন্য তৈরি করলেন অনন্য টাইপফেস ‘কাইয়ুম ফন্ট’। জেকব টমাস শোনাচ্ছেন সেই ফন্ট তৈরির গল্প।

কাইয়ুম চৌধুরী
ফাইল ছবি

এই লেখা পড়ার সময় এর হরফগুলোর দিকে আপনি কতটা মনোযোগ দিয়েছেন?

ঘটনাচক্রে লেখাটি ছাপা হয়েছে সূর্য ফন্টে, আর কাইয়ুম ফন্টে এর শিরোনাম। প্রথম আলোর জন্য আমিই এই টাইপফেস পরিবারটির নকশা করেছি। এর নকশায় এবং নকশার উন্নয়নে আমার শত শত ঘণ্টা খরচ হয়েছে। আমাদের চারপাশে এ রকম অসংখ্য টাইপফেস আছে। প্রতিদিন হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেসবের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি। কিন্তু খুব কম মানুষই এসব নকশা তৈরির প্রক্রিয়া আর তার পেছনের ইতিহাস নিয়ে ভাবি।

এ পরিস্থিতির অবশ্য দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। তরুণ বাঙালি নকশাকারদের মধ্যে বাংলা টাইপফেস ও অক্ষরচিত্রণ নিয়ে আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে। বিশ্বজুড়েই এ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু প্রকাশক ও করপোরেট ব্র্যান্ড এখন স্বতন্ত্র দৃশ্যগত পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজস্ব টাইপফেস তৈরির বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা পশ্চিমের একজন নকশাকার হিসেবে বহু বছর ধরেই আমি কাইয়ুম চৌধুরীর অতুলনীয় হস্তলিপি দেখে আসছি। বইয়ের দোকানগুলো যেন তাঁর নকশা করা হস্তলিপির এক অনুপম প্রদর্শনী। বইয়ের প্রচ্ছদ নকশায় বহু বছর ধরে কাইয়ুম চৌধুরী বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসেছেন। আর তার মধ্য দিয়ে একটি পরিণত হস্তলিপির শৈলী তৈরি করেছেন। তাঁর সে হস্তাক্ষর যেন বাংলা বর্ণলিপির সৌন্দর্যের সারমর্ম প্রকাশ করছে। যদিও ঘটনাটি এক অর্থে তার বিপরীত। তাঁর হস্তলিপি ছিল আসলে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, অনন্য।

২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর কাইয়ুম চৌধুরীর প্রয়াণ হয়। সে বছরেরই শুরুর দিকে আমি তাঁর হস্তলিপির একটি ফন্ট তৈরির জন্য বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করতে শুরু করি। ২০১৬ সালের শেষ দিকে সে গবেষণা আমাকে প্রথম আলোর সংস্পর্শে নিয়ে আসে। কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলো প্রকাশের শুরু থেকেই এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক একটি দীর্ঘ সময়ের যৌথ যাত্রার সূচনা করে। তার ফল প্রথম আলোর সঙ্গে আমার নানা প্রকল্প। কাইয়ুম ফন্টের যাত্রা শুরুও সেই সূত্রেই। এ ফন্টের কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের শেষ দিকে।

বাংলা ক্যালিগ্রাফিক বা হস্তলিপি ফন্ট নকশা করার প্রধান চ্যালেঞ্জ এর মাত্রা—জটিল বাঁকা মাত্রা নিখুঁতভাবে তৈরি করার জন্য অ্যালগরিদম বা গাণিতিক পরিভাষা তৈরি করা। যে কয়েক ডজন বাংলা ফন্ট এর আগে প্রচলিত ছিল, সেগুলো বাংলা হস্তাক্ষরের নিছক অনুকরণ মাত্র। প্রায় ক্ষেত্রেই মাত্রাগুলো তাতে যুক্ত থেকেছে বেমানানভাবে। হরফগুলো বহু ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক ও বেখাপ্পা হয়ে থেকেছে। এ ছাড়া হরফগুলোর মাঝখানে ব্যবধানের সামঞ্জস্যহীনতা তো ছিলই।

এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমি আরবি নাস্তালিক ও লাতিন বঙ্কিম ফন্টের বৈশিষ্ট্য নিয়ে পড়াশোনা করি। বাঁকা বাংলা ফন্টগুলোর প্রোগ্রামিং তৈরির জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতিতে সেই ফন্টগুলোর বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয়। কাইয়ুম টাইপফেস একটি অনন্য অ্যালগরিদমের অগ্রদূত। পূর্বাপর সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে ডজন ডজন মধ্যবর্তী বাঁকা মাত্রা থেকে এটি সুকৌশলে বাছাই করা হয়েছে। এ ছাড়া কাইয়ুম ফন্ট সেই গুটিকয় বাংলা ফন্টের একটি, যাতে ওপেনটাইপ ফন্টের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে এক হাজারের বেশি স্বতন্ত্র ক্যারেক্টার সৃষ্টি করতে হয়েছে। এর পরিমাণ যেকোনো বাংলা ফন্টের তুলনায় বেশি।

জেকব টমাস

বাংলা ছাপা টাইপফেস ও ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তারপরও বলতে হবে, বাংলা ফন্টে এ ক্ষেত্রে এখনো মানের ঘাটতি আছে। অতীতের নকশাকারদের ইতিহাসের অনেকটাই সবাই বিস্মৃত হয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, ১৭৭৮ সালে প্রথম যে অপরিপক্ব বাংলা হরফ ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল, তার নকশা করেছিলেন চার্লস উইলকিনস। বাংলা টাইপোগ্রাফির প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর পাশাপাশি ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষানুরাগী উইলিয়াম কেরিকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। একই সঙ্গে আজকের চিরায়ত বাংলা টাইপের জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে মিশনারি প্রেস টাইপ ফাউন্ড্রিকেও।

সে ঘটনার দুই শতাব্দী পর এখন আমরা ডিজিটাল টাইপের দিকে এগোচ্ছি। আপনারা কি লক্ষ করেছেন, ইংরেজিতে যেখানে ফন্টের অজস্র ধরন, বাংলায় সেখানে টাইপফেস মাত্র একটি। একই কাঠামোর ওপর তৈরি বলে সুতন্বী, সোলায়মানলিপি ও কালপুরুষ নামের ভিন্ন ভিন্ন ফন্টের আদল প্রায় অভিন্ন। এটা স্পষ্ট যে এগুলো আদতে পুরোনো নকশারই ধারাবাহিক অনুকরণ। বছরের পর বছর আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, এ নকশার রূপকার কে? প্রায় এক দশক আগে আবিষ্কার করেছি, এ নকশা বিখ্যাত ব্রিটিশ টাইপ ইঞ্জিনিয়ার ফিওনা রস ও আনন্দবাজার পত্রিকার যৌথ সৃষ্টি। এ তথ্য আমাকে ২০১৬ সালে লন্ডনে ফিওনা রসের অধীনে পড়তে উৎসাহিত করে তোলে। সে পড়াশোনাই আমাকে লাতিনবহির্ভূত লিপির নকশা নিয়ে ভাবতে শেখায়।

লাতিন ফন্টের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। অথচ আমার ধারণা, বাংলায় মৌলিক ও সুন্দর ফন্ট ১০০টির কম হবে। এর মধ্যে আবার মানসম্পন্ন মাত্র কয়েক ডজন। এর কারণ, এসব ফন্টে গ্রাফিক ডিজাইনের উপাদানের মূল উৎস হলেও এগুলোর পাইরেসি হয়েছে প্রচুর। টাইপ ডিজাইনারদের সম্মানীও দেওয়া হয়েছে খুব কম। আমার লক্ষ্য হলো, সমন্বিতভাবে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তোলা, যেখানে বাংলা টাইপ ডিজাইন ও ফন্ট অর্থের বিনিময়ে কেনার মতোই মূল্যবান হবে।

পাশ্চাত্য নকশার নকল এবং লাতিন ফন্টের ব্যবহার বাংলা নকশার জগতের চালু প্রবণতা। তবে বাঙালি তরুণদের মধ্যে অক্ষরচিত্রণ ও ফন্টের বিষয়ে আগ্রহ দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তা রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো।

বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা পশ্চিমা দুনিয়ার একজন মানুষ হিসেবে পশ্চিমা টাইপের তুলনায় বাংলা লিপির উদ্ভাবন ও উন্নয়ন অনেক বেশি বলে আমার মনে হয়। বাংলা একটি সুন্দর ভাষা। এর লিপিও বড় অপূর্ব। এই লিপির নান্দনিক উৎকর্ষের জন্য নিজের পুরো জীবন ব্যয় করে দেওয়াটাও কম উপভোগ্য নয়।

জেকব টমাস: [email protected]