করোনাকালে সীমিত পরিসরে...

নতুন সকাল। নতুন দিন। যদিও এত দিন সব সকাল আর সব দিনই একই রকম লাগত। কিন্তু এবার অন্য রকম। বেশ মুক্তি মুক্তি ভাব। কারণ, সবকিছুই এখন উন্মুক্ত, তবে সরকারি ভাষায় ‘সীমিত আকারে’।

তাই সকাল থেকেই মনে উঁকি দিচ্ছিল রবি ঠাকুরের গান, ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…’। বের হলাম বাসা থেকে। জরুরি কাজেই। কিছু কেনাকাটা ছিল। বের হয়ে বুঝলাম, মানুষের ঘনত্ব অনেক। আগের চেয়ে অনেক বেশি। মানুষের মধ্যে সন্ত্রস্ত ভাবও কমে গেছে। একটা শপিং মলের সামনে মানুষের ভিড় দেখে তো ভিড়মি খাওয়ার জোগাড় আমার। মাস্ক ও গ্লাভস কেউ ব্যবহার করছেন, তো কেউ ধারেকাছেও যাননি।

এর পর থেকেই ‘সীমিত’ শব্দের ব্যবহার ও অর্থ নিয়ে আমি ধন্ধে পড়ে গেছি। ওপরওয়ালারাও শব্দের অর্থ নির্ধারিত করেননি। ফলে আমজনতার বুঝতে সমস্যা হতেই পারে। শাব্দিকভাবে সীমিত বলতে সীমাহীন হতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সীমা কতটুকু, সেটা জানতে পারলে আসলে সুবিধে হতো। ওই গণ্ডির মধ্যে তাহলে থাকার চেষ্টা করা যেত আরকি! অন্তত লঞ্চের ভিড় দেখে তো সীমার মাত্রা বোঝার উপায় নেই।

বাঙালির সীমাজ্ঞান বুঝতে শেষে শরণাপন্ন হলাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘ভানু এল কলকাতায়’ নামের তাঁর একটি কৌতুক নাটিকায় মাত্রা নিয়ে বক্তব্য ছিল। ভানু গিয়েছিলেন কলকাতায় চাকরির খোঁজে। চাকরির সন্ধানদাতার সঙ্গে আলোচনার সময় লেগে গেল গণ্ডগোল। কারণ বাঙাল ভানু কিছু উচ্চারণ ভুল করেছিলেন। তিনি ‘পেন্নাম’, ‘ভ্যাম’, ‘পেত্যেক’ বলেছিলেন। আর চাকরির সন্ধানদাতা বলেছিলেন, সব কটিতেই র-ফলা লাগবে। তো কড়কে গিয়ে ভানু জানালেন, ‘ব্রেশ, ব্রেশ’। এতে আপত্তি তুললে ভানু সাফ জানিয়ে দেন, ‘দ্রিমু যখন, ত্রখন সবট্রাতেই দ্রিমু।’

অর্থাৎ হয় আমরা একেবারেই নিরস্ত থাকি, না হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি। সীমার হিসাব বিবেচনায় কোনোটাই আদর্শ নয়।

>‘সীমিত’ শব্দের ব্যবহার ও অর্থ নিয়ে আমি ধন্ধে পড়ে গেছি। ওপরওয়ালারাও শব্দের অর্থ নির্ধারিত করেননি। ফলে আমজনতার বুঝতে সমস্যা হতেই পারে। শাব্দিকভাবে সীমিত বলতে সীমাহীন হতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সীমা কতটুকু, সেটা জানতে পারলে আসলে সুবিধে হতো।


আদর্শ শব্দটা যখন এলই, তখন তা বিস্তৃত করা যাক। সবকিছু খুলে দেওয়ার পক্ষে বারবারই তোলা হচ্ছে জীবন বনাম জীবিকার প্রশ্নটি। এটা ঠিক মুরগি আগে, নাকি ডিম আগে ধরনের প্রশ্ন। জীবিকা না থাকলে জীবন রইবে না। আবার জীবন না বাঁচলে জীবিকা দিয়েই-বা হবেটা কী? এই দুই ধারওয়ালা তলোয়ারে সব দিকই কাটে। তাই সবচেয়ে ভালো হয়, যেদিকে আপনার সুবিধা হয়, সেই দিকে অবস্থান নেওয়া। হ্যাঁ, নিন্দুকেরা আপনাকে কিঞ্চিৎ সুবিধাবাদী বলতে পারে, বলতে পারে শুধু নিজের পক্ষেই যুক্তি দিচ্ছেন। তবে ওসবে কান দেবেন না। এত কিছুতে যদি কান দেন, তবে নিজের যুক্তিগুলো কীভাবে শুনবেন?

আর কেউ সীমিত শব্দ নিয়ে জ্ঞান দিতে এলে পাল্টা ঝাড়ি দিন। বলে দিন, নির্দেশদাতারাও তো এই শব্দের সংজ্ঞা জানাননি। তাঁরা আপনার বিবেক-বুদ্ধির ওপরই আস্থা রেখেছেন। সুতরাং আপনি স্বীকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। যদিও আপনি ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে আরাম পান, অন্যায় হতে দেখলেও চুপ করে থাকেন, যেখানে-সেখানে কফ-থুতু না ফেললে মনে শান্তি পান না, মাস্ক থুতনিতে রেখেই ভাবেন ভাইরাস ভয় পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি, তবু সবাই আপনার ওপরই আস্থাশীল।
সুতরাং নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ান। আর কেউ কিছু বোঝাতে এলে, মনে করুন ওই ব্যক্তি অজানা ভাষায় কথা বলছেন।

একটা গল্প বলি। নিজের অভিজ্ঞতা আরকি। তখন উচ্চমাধ্যমিকে উঠি উঠি করছি। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় তুমুল তর্ক শুরু হলো। একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে এক বন্ধু তাঁর ভাবনায় অটল। অন্যরা সবাই মিলে বুঝিয়েও তাঁর মত পরিবর্তন করাতে পারছে না। তিনি এতই অনমনীয় ছিলেন যে নিজের ভাবনায় কিঞ্চিৎ ছাড় দিতেও রাজি ছিলেন না।

শেষে তিনি দিলেন এক মোক্ষম জবাব। বললেন, ‘আমি বুঝমু না। দেখি তোরা আমারে ক্যামনে বুঝাস।’

ওপর থেকে নিচ—আমরা সবাই এই ধারাতেই চলছি। সুতরাং তালগাছটি নিজের করে নিন। প্রয়োজনে জড়িয়ে ধরে বসে থাকুন। ভাইরাসও ভুরু কুঁচকে ভয় পেতে বাধ্য!


অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]