এই প্রজন্মের অনুপম প্রতিনিধি
বাংলাদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁদের একজন। সম্প্রতি ভারত সরকার পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেছে তাঁকে। তাঁর এই অর্জন আমাদের সবার জন্যই গৌরবের। তাঁকে নিয়ে আজকের আয়োজন
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের যেসব শব্দ ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার হিসেবে এ দেশবাসীর সাংস্কৃতিক কথামালায় স্থান করে নিয়েছে, তার মধ্যে ‘স্যার’ শব্দটি সদা উজ্জ্বল। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে শব্দটি ব্যবহূত হয়। ফুটপাতের পানওয়ালা আর রাস্তার পুলিশ, কনিষ্ঠ সামরিক অথবা বেসামরিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং তাঁদের জ্যেষ্ঠরা; আর সবচেয়ে বেশি এই শব্দটি প্রচলিত ছাত্র-শিক্ষকের ক্ষেত্রে। শেষোক্ত ক্ষেত্রে প্রথম দুটি ক্ষেত্রের মতো তা সাময়িক নয়, সম্পর্কটি সাধারণত আজীবনই স্থায়ী হয়ে থাকে। শৈশবে স্কুলে আমরা যে শিক্ষককে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করি, পৌঢ়ত্ব অথবা বার্ধক্যেও তাঁর উদ্দেশে আমরা ‘স্যার’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় জিনিসটি এই যে, যাঁরা তাঁর সরাসরি ছাত্র নন, শুধু তাঁরা-ই নন, যাঁরা অন্য বিদ্যালয় অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যেখানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অধ্যাপনা করেননি, তাঁরাও অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। আনিসুজ্জামান যেন এই প্রজন্মের সর্বজনীন ‘স্যার’। এই ‘স্যার’ পদাধিকার সামাজিক উঁচু-নীচ অবস্থানের বিভেদাত্মক ‘স্যার’ নয়, বরং হূদয় থেকে উত্থিত ভালোবাসামাখা এক অনির্বচনীয় সম্বোধন। আমাদের সমাজে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এই অবস্থান একান্তই তাঁর জন্য সংরক্ষিত।
আনিসুজ্জামানকে ভারত ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে যে মহৎ কর্তব্যটি সম্পাদন করেছে, তার একটি বড় তাৎপর্য এখানে যে এটি শুধু আনিসুজ্জামানের একার প্রাপ্তি হয়ে থাকেনি। তাঁর ‘পদ্মভূষণ’-এর পদ্মের রেণুর দাবিদার আমাদের দেশবাসী। এই পুরস্কার সাধারণভাবে বিদেশিদের দেওয়া হয় না। কৃতী ভারতসন্তানদেরই এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। কিন্তু মনীষা ও জ্ঞানের সাধনায় আনিসুজ্জামানের অসামান্য কীর্তিগাথা রাষ্ট্রীয় সীমানাকে অতিক্রম করে গেছে। চাণক্য-কথিত সংস্কৃত সেই সুভাষণটি তাঁর বেলায় যথার্থই সত্য হয়ে উঠেছে: ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।’ বিদেশের মাটিতে তাঁর এই সম্মান ও সংবর্ধনা আমাদের মনেও গভীর সন্তুষ্টি এনে দিয়েছে। বস্তুত, আনিসুজ্জামানের এই গৌরব আমাদের সবারই গৌরব।
এই দেশ ও জাতির পরম সৌভাগ্য যে আনিসুজ্জামান আমাদের চেতনালোকের এক অনন্য সারথি হিসেবে তাঁর অবস্থান নির্মাণ করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয়ের লগ্নেও তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্রের জোগান দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য রচনা করে তিনি আমাদের ইতিহাসে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সাবলীল ভাষান্তরে তিনি এই সুকঠিন কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলা ভাষার এই প্রথম ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি আমাদের ভাষাকে দিয়েছেন এক নতুন মর্যাদা। বাংলা ভাষার প্রকাশক্ষমতাকে তিনি দিয়েছেন অনন্য স্বীকৃতি। সাহিত্যক্ষেত্রে মৌলিক ও অত্যন্ত মূল্যবান গবেষণা তিনি করেছেন। এ ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের সুকৃতি ও সাধনার পরিচয় তিনি উদ্ভাসিত করেছেন এক স্বচ্ছ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি নিয়ে। পুরোনো বাংলা গদ্যের গবেষণায় তাঁর অসামান্য কৃতি। এই কার্য তাঁকে আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনে একটি বিশিষ্ট আসন প্রদান করেছে। এটি অনায়াসেই বলা যায় যে আনিসুজ্জামান যদি তাঁর মূল্যবান গবেষণা ও অনুসন্ধান পরিচালনা না করতেন, তাহলে বাংলা ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকই অনুদ্ঘাটিত থেকে যেত। আমরা তাই তাঁর কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
আনিসুজ্জামানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে জ্ঞানসাধনার নিভৃতলোকে তিনি জনতার কোলাহলকে সাদরে আমন্ত্রণ জানান, দেশ ও জাতির যেকোনো দুর্যোগে এগিয়ে যান যোদ্ধার মতো। জ্ঞান ও মনীষার অঙ্গনেই যে তাঁর মূল পদচারণ, তখন সে কথা হয়তো তিনি নিজেই ভুলে যান। তিনি তখন হয়ে ওঠেন শতভাগ সমাজকর্মী। নানা দিক থেকে নানা ধরনে আজ যখন আমাদের সমাজ আক্রান্ত, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর অকুতোভয় যোদ্ধার রূপ তখন আমাদের সাহস জোগায়, নাগরিক সমাজের সেনাপতি রূপে তাঁর অগ্রবর্তী অবস্থান আমাদের বিমোহিত করে। আমরা জানি যে প্রয়োজনে সর্বজনীন হয়ে উঠতে তাঁর একটুও সময় লাগে না। অবলীলায় তিনি জনতাসঙ্গমে মিশে যান। অতি সম্প্রতি আমরা তাঁর এই পরিচয় প্রত্যক্ষ করেছি, দেখেছি তাঁর অগ্রসর ভূমিকার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, চারদিকে ঘনায়মান তমসার মধ্যেও তিনি চলে গেছেন নিপীড়িত মানুষের কাছে, তাদের দুর্ভোগ ও মর্মযাতনায় সমব্যথী হতে। বস্তুতপক্ষে আনিসুজ্জামানের পদ্মভূষণপ্রাপ্তি একদিকে যেমন তাঁর বৈদগ্ধ্য ও মনীষার প্রতি স্বীকৃতি, অন্যদিকে মানবকল্যাণের জন্য তাঁর সংগ্রাম আর সাধনার পুরস্কার।
সাহিত্য অথবা সমাজকর্ম—দুই ধারাতেই রয়েছে তাঁর বক্তব্য ও চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রকাশ। সেই প্রকাশ তিনি ভাষার অতিরেক না ঘটিয়ে সংক্ষেপে, সুস্পষ্ট, প্রাক্তন ও গোছানো আঙ্গিকে ব্যক্ত করেন। আমরা দেখি যে সময় যতই এগিয়েছে, জ্ঞানসাধনা ও মানবিক কল্যাণব্রতে তিনি ততই অটল হয়েছেন। আমরা উপলব্ধি করি যে আমাদের উত্তাল ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে যথোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ক্রমিক উত্থানের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে তিনি জাতির বিবেকে পরিণত হচ্ছেন।
তাঁকে অভিবাদন।