আলফ্রেড লর্ড টেনিসন

অলংকরণ: অশোক কর্মকার
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

প্রিয়মের জন্য
গ্রিক পুরাণে ঊষাদেবী অরোরার চোখে পড়ে ট্রয় নগরের এক সুদর্শন কিশোরকে, নাম তার টিথোনাস। দেবী তাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় পূর্বাচলের ঊর্ধ্বাকাশে তার মেঘালয়ে। দেবীর প্রেমে অভিভূত কিশোর তার কাছে বর চায় যেন দেবতাদের মতো সেও অমর হতে পারে। দেবী তার জন্য অমরত্বের ব্যবস্থা করে। কিন্তু টিথোনাস প্রেমের উত্তেজনায় অমরত্বের সঙ্গে চিরযৌবনও চাইতে ভুলে গেছে। অতএব আর কি, তার বয়স বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বাড়ে বার্ধক্যের রোগ-শোক-দুঃখ-জরা আর অন্যান্য যত বালাই। এখন সে মরতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কাহিনির অসহায়ত্ব এমনই যে একবার বর দিলে সেটার কোনো রকমফের করা দেবদেবীর পক্ষেও সম্ভব হয় না। এ রকম এক কাহিল অবস্থায় টিথোনাস অরোরার কাছে মিনতি করে নানা কথা বলছে। ঊনবিংশ শতকের ইংরেজ কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসন তাঁর কবিতায় দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন টিথোনাসের এই বিলাপ-কাহিনি।

বনভূমি ঝরে যায়, ধসে পড়ে ঝোপঝাড়, অরণ্য উদ্ভিদ
বিমারি লোকেরও কান্না শেষ হয় মাটির কন্দরে
জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে যায় চাষা
অতঃপর শুয়ে পড়ে ঘাসের চাপড়া গায়ে

জমিনেরই তলে। আর
বহুযুগ বেঁচে থেকে রাজহংসী মরে যায়
সাঙ্গ করে তার শেষ গান।

অথচ নিষ্ঠুর অমরতা এ আমাকে
তিলে তিলে গ্রাস করে।
ধরা থেকে বহু ঊর্ধ্বে মেঘের নিরালা পাড়ে
ক্ষয়ে যাই দেবী, আমি ক্ষয়ে যাই; তোমার বন্ধনে
আমি নিয়ত শুকাই।
শ্বেতমুণ্ড ছায়া হয়ে দুঃস্বপ্নের মতো হাঁটি
পূর্বাচলের তীরে চিরস্তব্ধ মহাশূন্য মাঝে।
কুয়াশার বিস্তীর্ণ পরলে ঢাকা প্রভাত প্রাসাদে
দিনের প্রথম সূর্যে আলোকিত অলিন্দে কোঠরে
হাঁটি আমি দুঃস্বপ্নের মতো—একা একা।

হায়, একদা মানুষ আমি, হয়েছি ধূসর কায়া আজ
রূপবান ছিলাম উদ্ভাসিত এতটাই যে দেবী
তাকেই করলে তুমি অমোঘ চয়ন। আর সে দুর্ভাগা এক
অন্তরে নিজেকে খোদ দেবতা বলেই জ্ঞান করল তখন।
চাইলাম বর, ‘দেবী, অমরত্ব দাও।’
অধমের আকাঙ্ক্ষাটুকু মৃদু হেসে করলে কবুল
যেমন ধনাঢ্য ব্যক্তি হেলাভরে দান করে—কী দিচ্ছে তা না দেখেই।
কিন্তু সুরী, তোমার সিদ্ধান্তে বিধিত্রয়ী খেপে ওঠে
কেঁচিয়ে কুঁদিয়ে করে বিধ্বস্ত আমায়
যদিও পারে না শেষ করে দিতে, তবু
পঙ্গু করে রেখে যায়। চিরযৌবনার সাথে
বাস করি সারাক্ষণ ছাইভস্মমাখা মাথা
চিরঞ্জীব মূর্তমান বুড়ো। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা। তোমার নির্মম প্রেম
তোমার সৌন্দর্য, দেবী, পারে না ফেরাতে এ দুর্ভোগ।
যদিও এখনো দেখি আমার এ দুঃখগাথা
শুনে শুনে তোমার দুচোখে
পথসখা শুকতারা জ্বলে ওঠে টলটলে অশ্রুবারিপাতে।

ও অরোরা, মুক্তি দাও, ফেরাও তোমার বর।
মানুষ মরণশীল, যেতে যেতে থেমে যাবে—সেটাই নিয়ম।
তবে আমি কেন হব ভিন্ন কেউ?
কেন হব সনাতন রীতির ব্যত্যয়?

মৃদুমন্দ সমীরণে পলকা মেঘের দল সরে যায়, দেখি
নিচের আঁধার বিশ্ব। সেখানে জন্মেছি আমি।
তোমার নিটোল চোখ থেকে দেখি পুনর্বার
জ্বলে ওঠে রহস্য আলোক।
তোমার সফেদ গ্রীবা থেকে, আর
নবতেজে দাপানো উরসে
হৃৎপিণ্ড জেগে ওঠে।
তোমার কপোল ধূম্র আবছায়া মুছে
রক্তিমাভ হয় ক্রমে, আর
এ বুড়োর চোখে ঝুঁকে থাকা মিষ্টি চোখ দুটি
ক্রমে পায় লাল আভা, নিভে দেয় তারাদেরও চোখ।
আর দ্যাখো সে মুহূর্তে প্রিয় অশ্বদল
রথের জোয়াল কাঁধে তুলে নিতে হয়ে পড়ে উতলা, অস্থির।
আলগা কেশর থেকে ঝেড়ে ফেলে আঁধারের ধুলো, আর
খুরাঘাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছোটে গোধূলির দিকে।
দেবী, তুমি এভাবেই হয়ে ওঠো নিয়ত সুন্দর। এবং তখন
আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে তুমি
বের হও কর্তব্যের টানে। শুধু রেখে যাও পিছে
এ বুড়োর কুঞ্চিত কপোলে টলোমলো
শীতল দুফোঁটা অশ্রুজল।

জানি দেবী কেন তুমি বারবার অশ্রুবিন্দু দিয়ে
আমার আশঙ্কা আরও দৃঢ় করো। বহুদূর অতীতে একদা
মাটির আঁধার বিশ্বে উচ্চারিত হয়েছিল
অমোঘ স্বর্গীয় বাণী: ‘দেবতা স্বয়ং তার প্রদত্ত আশীষ
পারে না ফেরাতে।’ সেটাই, ও দেবী, হাহ্
সেটাই রচিত হলো আমার ললাটে।

হা অরোরা, হায় দেবী, দূরতম অতীতে কখনো
অন্য এক মন নিয়ে, অন্য চোখে দেখতাম—
অবশ্য এ আমি যদি সে আমিই হয়ে থাকি—তো দেখতাম
তোমার দুপাশ ক্রমে আলোকিত হয়ে ওঠে,
দেখতাম এলোকেশে সূর্যকরোজ্জ্বল বেণী
মরমি আকার ধরে, পাল্টে দেয় দেবীকে আমার। আর
অনুভবে টের পাই আমার শোণিত সেই
সর্বব্যাপী আভা লেপে ধীরে উষ্ণ হয়ে ওঠে।
আমি শুয়ে থাকি দেবী তোমার সমুখে।
ক্রমে মুখ, অবয়ব, ললাট, চোখের পাতা
শিশির কবোষ্ণ হয় চুম্বনে তোমার।
বসন্তের অর্ধনিমিলীত পুষ্প-কোরকের
চেয়েও তা মোলায়েম। আর সে চুম্বনরত
ওষ্ঠ থেকে কী যে বাণী ঝরে পড়ে মৃদু স্বরে, বুঝি নাকো।
মনে হয় এ কোন অজ্ঞাত সুর বুনো ও সরেস; হয়তো এমন সুরই
বাজিয়ে আপোলো দেব নির্মাণ করেন ইলিয়ন নগরকে।
কুয়াশার বুক চিরে হয়তো এভাবে
ধীরে গড়ে উঠেছিল ট্রয়ের প্রাকার।

তবু দেবী, ইচ্ছাময়ী,
পূর্বাচলের এই প্রাসাদে তোমার
চিরকাল রেখো না আমাকে আর বেঁধে।
আর কত করবে পরখ, দেবী,
মেলাতে মানবরীতি তোমার স্বভাবে?
তোমার শীতল ছায়া গোলাপি রঙিন
সিক্ত করে আমার শরীর;
শীতল তোমার সব আলো, আর
হিম বলিরেখা পায়ে আমি হাঁটি মেঘালয়ে
আলো ঝলমলে অভ্রপথে।

তখনই তাকাই নিচে আবছায়া পৃথিবীর কোলে, দেখি
বাসাবাড়ি থেকে ওঠে উষ্ণ ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে।
সুখী মানুষের, আহা, সুখী সংসারী ধূম্ররাশি।
সুখী ওরা, কেননা ওদের
রয়েছে মরার শক্তি। আর দেখি গোরস্থানজুড়ে
ঘাসে ঢাকা সারি সারি আরও সুখী মৃতের কবর।

ও অরোরা, মুক্তি দাও, রেখে এসো ধূলির ধরায়।
তুমি তো দেখতে পাও সবই, দেবী,
দেখো তুমি আমার কবরও।
প্রতিটি প্রত্যুষে তুমি
নবায়িত করো নিজ রূপের বাহার
আমি মৃত্তিকার প্রাণী, মাটিতেই যাই ফিরে
ভুলে যাই মিথ্যা প্রেম প্রীতি প্রহসন।
তুমি ফিরে যাও চলে রুপালি চাকার রথে
যথারীতি অপরূপ রূপে সমাসীন।