‘আমার চলচ্চিত্রের সহিংসতা বিদ্যমান সমাজেরই প্রতিচ্ছবি’

কোরিয়ান নিউ ওয়েভ সিনেমার অন্যতম দিকপাল কিম কি দুক মারা গেছেন গত ১১ ডিসেম্বর। চলচ্চিত্র কিংবা শিল্পের কোনো মাধ্যমের ওপর প্রথাগত পড়াশোনা কিংবা ডিগ্রি কোনোটাই তাঁর ছিল না। ফ্রান্সের প্রবাসজীবনে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে গিয়ে এই মাধ্যমের প্রেমে পড়েন। পরে দেশে এসে প্রথমে চিত্রনাট্য লেখার কাজে যুক্ত হন এবং পরবর্তীকালে নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘ক্রোকোডাইল’ তাঁর নির্মিত প্রথম কাহিনিচিত্র। তাঁর সিনেমা কোরিয়ান বক্সঅফিসে তেমন সাফল্য লাভ না করলেও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সমাদৃত হয় এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক উৎসবে পুরস্কার অর্জন করে। ২০০২ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর নির্মিত ‘ব্যাড গাই’ প্রদর্শিত হওয়ার সময় জার্মানির ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ভলকার হুইমাল তাঁর এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সে সময়ে এটি ‘সেন্সেস অব সিনেমা’য় প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য আরিফ

কিম কি দুক ও তাঁর চলচ্চিত্রের ছবি অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

ভলকার হুইমাল: কিম, আপনি একসময় বলেছিলেন যে আপনার সব সিনেমা তৈরির নেপথ্যে একধরনের ঘৃণা বা বিদ্বেষ কাজ করে। আপনার নতুন সিনেমা ‘ব্যাড গাই’ নির্মাণের পেছনে কোনো ক্রোধ কাজ করেছে?

কিম কি দুক: আমি ‘ঘৃণা’ শব্দটিকে বৃহৎ পরিসরে ব্যবহার করতে চাই এবং ভাবতেই চাই না যে আপনি শব্দটিকে কোনো পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া বিবেচনা করেছেন। আমি আসলে ‘ঘৃণা’ ব্যাপারটি নির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাই না। আমি আসলে একটি বিষয় বা ব্যক্তিকে দিয়ে গোটা সমাজটাকে দর্শকদের কাছে নিরূপণ করাতে চাই। আমি প্রকৃতপক্ষে যে জিনিসগুলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং জীবনে চলতে গিয়ে দেখেছি, কিন্তু সেগুলোকে অনুধাবন করার জন্য সক্ষমতা অর্জন করিনি, সেই বিষয় নিয়েই সিনেমা বানাই। যেসব জিনিস দেখে বুঝে নিতে সক্ষম হই না, সেই না–বোঝার জায়গা থেকেই আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করি। তাই ‘ঘৃণা’র বদলে আমার না–বোঝার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

ভলকার হুইমাল: ‘ব্যাড গাই’-এর মধ্য দিয়ে সারা দুনিয়াকে কী বোঝাতে চাইছেন আপনি?

কিম কি দুক: আমি আসলে এই প্রশ্ন এখন উত্থাপন করতে চাইছি যে আমরা প্রত্যেকেই একই যোগ্যতা নিয়ে, একই অধিকার এবং একই গুণ নিয়ে জন্মানোর পর কেন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিভক্ত ও বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত হয়ে যাই। আমাদের চাহনি ও চেহারা দ্বারা নিরূপিত হই? এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে আমাদের চেহারা কুৎসিত কিংবা আমাদের অর্থ নেই? আমাদের জন্মের পর এবং বেড়ে ওঠার সময় এসব মানের ভিত্তিতেই আমাদের সামাজিক শ্রেণি কেন আরোপ করা হয় এবং আমরা সমানভাবে একে ওপরের সঙ্গে একীভূত হতে পারি না। আমি আসলে প্রশ্ন করতে চেয়েছি যে এই সব শ্রেণিকে একীভূত করা এবং একই ধরনের সাম্যের বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা কি একেবারেই অসম্ভব।

কিম কি দুক নির্মিত ‘ব্যাড গাই’ ছবির দৃশ্য।
ছবি: সংগৃহীত

ভলকার হুইমাল: আপনি কি আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন?
কিম কি দুক: আমার উত্তর হলো মানবজাতির সবার সবাইকে শ্রেণি, মুখশ্রী অথবা অর্থ ছাড়াই সম্মান করা উচিত। এটাই আমার উত্তর, কিন্তু আমার চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো দর্শকদের এই প্রশ্নের সম্মুখীন করা। আমি নিশ্চিত সবাই সবার উত্তর এর মধ্য দিয়ে খুঁজে পাবেন।

ভলকার হুইমাল: আপনার অনেক সিনেমার মতোই ‘ব্যাড গাই’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ব্যাভিচারী হাঙ্গ-গি একজন নির্বাক চরিত্র, সে কোনোভাবেই নিজেকে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে না। তার একটিই ভাষা, সেটা হলো সহিংসতা। এই নির্বাক থাকার কারণ কী?

কিম কি দুক: আমার বেশ কয়েকটি কাহিনিচিত্রে চরিত্রগুলোর অনেকেই নির্বাক থাকে, কেননা, কোনো কিছু তাদের গভীরভাবে আহত করেছে। অন্য মানুষের প্রতি তাদের বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যায়, কেননা, তাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করে না। তারা অন্যকে বলে যে ‘ভালোবাসি’, কিন্তু অন্যরা এটাকে ধারণ করতে চায় না। এই বৈরী আচরণের জন্য তারা তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তারা যে সহিংসতার আশ্রয় নেয়, আমি এটাকে তাদের দেহের প্রকাশভঙ্গি হিসেবে দেখাতে চাই। আমি আসলে দৈহিক কোনো ক্রিয়ার চেয়ে নেতিবাচক সহিংসতাকে গুরুত্ব দিতে চাই। আমি আসলে আমার চরিত্রগুলোর ভয় ও ক্ষতি হওয়ার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তরুণদের জীবনযাত্রাকে তুলে ধরতে চাই। তারা এই বয়সে এমন কিছু ভীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হয়, যার বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া তারা দেখাতে পারে না। তারা নিজেদের শারীরিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, তারা তাদের মা–বাবার নির্যাতন কিংবা বহিঃস্থ নিগ্রহ অথবা তাদের মাতা–পিতাকে লড়াই করতে দেখার মানসিক নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করেই একধরনের প্রতিরোধহীনভাবে বেড়ে ওঠে। এগুলো যখন ঘটে, তখন আপনি অসহায় হয়ে পড়েন। আমার নিজেরই এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। অতীতে আমি শৈশবে বড়দের হাতে নিগৃহীত হয়েছি, নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। আমি যখন মেরিনে ছিলাম, আমার জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রহৃত হয়েছি। এই সব নির্যাতন কিংবা নিগ্রহের শিকার হওয়ার পরে আমার মনে হয়েছে, আমার আসলে কিছু করার নেই। এই সব প্রশ্ন থেকেই আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করি এবং আমার অনুভূতিগুলো সিনেমার মাধ্যমে প্রকাশ করি।

ভলকার হুইমাল: তাহলে আমরা বলতে পারি যে আপনার সিনেমাগুলো আসলে আত্মজৈবনিক?

কিম কি দুক: ‘ব্যাড গাই’-এর ক্ষেত্রে আমি প্রথমেই বলতে চাই যে আমি হাঙ্গ-গির মতো চরিত্র কখনোই পছন্দ করি না, কিন্তু কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে কিছু লাল আলোর এলাকায় কাজ করা লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছিল। সে আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই প্রহার করেছিল এবং আমি সেই ব্যক্তিকে ঘৃণা করেছিলাম। সেই পরিস্থিতিতে আমি তাকে মোটেই বুঝতে পারেনি, কিন্তু পরে আমি তা বোঝার চেষ্টা করলাম এবং সেইভাবে অগ্রসর হলাম। আমি আমার এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনস্তত্ত্ব দ্বারা বুঝতে চেষ্টা করলাম সেদিন কেন সে এ রকম আচরণ করেছিল।

ভলকার হুইমাল: আপনি কাহিনিচিত্র নির্মাণের আগে চিত্রশিল্পী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছেন। ২০০০ সালে নির্মিত আপনার ‘আইল’ ছবিতে আমরা পরাবাস্তব দৃশ্যায়নসংবলিত ন্যারেটিভের প্রবল উপস্থিতি লক্ষ করি। আবার ‘ব্যাড গাই’-এ এগোন শিলার পেইন্টিং একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।

আমার বেশ কয়েকটি কাহিনিচিত্রে চরিত্রগুলোর অনেকেই নির্বাক থাকে, কেননা, কোনো কিছু তাদের গভীরভাবে আহত করেছে। অন্য মানুষের প্রতি তাদের বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যায়, কেননা, তাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করে না। তারা অন্যকে বলে যে ‘ভালোবাসি’, কিন্তু অন্যরা এটাকে ধারণ করতে চায় না। এই বৈরী আচরণের জন্য তারা তাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
কিম কি দুক। ছবি: সংগৃহীত

কিম কি দুক: আমি ফ্রান্সের মন্টপেইলারের সুমদ্রসৈকতে দুই বছর চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করেছি। আমি কখনো কোনো স্বীকৃত প্রদর্শনীর আয়োজন করিনি। নিজের জন্য এই ছবিগুলো এঁকেছিলাম আমি এবং রাস্তায় এর প্রদর্শনী করতাম। আমি জার্মানির মিউনিখেও কিছু রাস্তায় চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম। এখানেই এগোন শিলার কাজের সঙ্গে পরিচিত হই। এখান থেকেই আমি তাঁর ছবি পছন্দ করেছিলাম। ‘ব্যাড গাই’ সিনেমাটি দেখলে অনেকের মনে হবে এটাতে অশ্লীলতা ও অসংগত বিষয় রয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে চরিত্রগুলো খুবই সৎ। তারা সেসব মানুষকে দেখছে, যারা কামনার বশবর্তী হয়ে চলছে। প্রকৃত অর্থে আমি গুস্তাভ ক্লিমটকে পছন্দ করতাম, কিন্তু যখন শিলার ছবি দেখেছি, তখন তাঁর দিকে ঝুঁকে গিয়েছি।

ভলকার হুইমাল: শিলা কিছু ছবিতে পতিতাদের চিত্রায়ণ করেছেন। তার ‘ফলেন ওমান’ কাজটিও খ্যাতি পেয়েছিল। আমরা আপনার ‘আইল’, ‘অ্যাড্রেস আননোন’ (২০০১) এবং ‘ব্যাড গাই’তে দেখতে পাই, আপনি সেই নারীদের দৃশ্যায়নে প্রাধান্য দিচ্ছেন, যারা নিজেদের শরীর বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

কিম কি দুক: আমার কাছে পুরুষের চেয়ে নারীর অবস্থান অনেক উঁচুতে। তারা সব সময় পুরুষের প্রয়োজন মিটিয়ে আসছে, এমনকি তারা তাদের জন্য প্রার্থনা পর্যন্ত করে থাকে। পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিশ্বজুড়েই সমস্যা দেখা যায়। এটা একটি বৈশ্বিক সংঘর্ষ, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ভিন্নতারও প্রতিফলন ঘটে। ইউরোপে এই সংঘর্ষের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। সে জন্য ইউরোপীয় সিনেমায় এর প্রতিফলনের মাত্রা অনেকটা কম। কিন্তু এশিয়ান সিনেমায় এই ধরনের সহিংসতা বেশি দেখা যায়, কেননা, এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে সংঘর্ষের তীব্রতা অনেক বেশি।
ভলকার হুইমাল: আপনার পূর্ববর্তী চলচ্চিত্রগুলোর মতো ‘ব্যাড গাই’-তে নারীবাদী নাটকীয়তা কতটুকু মূর্ত হয়েছে?

কিম কি দুক: ‘ব্যাড গাই’ দেখার পর ৯০ শতাংশ নারী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে দেখবেন যে দর্শকদের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। আপনি যদি বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মত নেন, তাহলে তাঁরা এই সিনেমাকে নেতিবাচক হিসেবেই রায় দিয়ে থাকবেন। কিন্তু দর্শকেরা কিন্তু এই সিনেমার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা এটা বুঝতে পেরেছেন। আপনি যদি মনে করেন যে কিম কি দুক নারীদের দুর্ভাগ্যকে দৃশ্যায়িত করছে, তাহলে সেটা হবে ভয়ংকর। কিন্তু আপনি যদি চিন্তা করেন, আসলে এটা সমাজের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার দৃশ্যায়ন, তাহলে আপনি কখনোই ‘ব্যাড গাই’কে পছন্দ না করে পারবেন না।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]