আপাদমস্তক শিল্পী অঞ্জন দত্ত
অঞ্জন দত্ত—দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী। অঞ্জনের জন্ম মাসে এই লেখায় তাঁর জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন তাঁর এক ভক্ত।
আমাদের কৈশোর-যৌবনে যে গুটিকয়েক শিল্পী গভীর আবেশে আবিষ্ট করেছেন, তাঁদের মধ্যে অঞ্জন দত্ত অন্যতম। মনে পড়ে, প্রথম যখন শুনেছিলাম অঞ্জনের ‘চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল’ গানটা, মনের মধ্যে কেমন যেন করে উঠেছিল। একটি ছেলে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। দুজনেই স্কুলে পড়ে। ছেলেটার আছে বুকপকেটে চিঠি। কিন্তু সেই চিঠিতে প্রথম প্রেমের বানান ভুল, মেয়েটার আছে যত্ন করে রাখা খাতার ভেতর চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল।
এত সহজ কথায় গান! গানের মধ্যে আবার গল্প! তা-ও আবার নিজেদের সঙ্গে মিল। সেই তো অঞ্জন দত্তর প্রেমে পড়া শুরু।
এই প্রেমের দুর্মর টানেই গিয়েছিলাম তাঁর ‘সেলসম্যানের সংসার’ নাটকটা দেখতে, যখন অঞ্জন মঞ্চনাটক নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়।
মনে পড়ে, ‘সেলসম্যানের সংসার’ নাটকের প্রয়োজনে অঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে হেসেছেন। হাসতে হাসতে কেঁদেছেন। তবে সে কান্না ছিল নিতান্তই উইলি লোম্যানের। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক বাবা, একজন বুড়ো সেলসম্যানের কান্না। নাটক শেষে দর্শকের আবদার ছিল, তিনি যেন গান শোনান। চোখে পানি শুকায়নি তখনো অভিনেতা অঞ্জনের। বলছিলেন, ‘থাকুন না একদিন আমার অভিনয় নিয়ে, গান পরে আবার হবে।’ এই আকুতি কি অভিনেতা অঞ্জনের নয়!
অঞ্জন দত্তের গান আমাদের অনেক দিনের সঙ্গী। তাঁর অনেক গানই মনের ভেতর বুদ্বুদ তুলে আসছে। তবে লিখতে বসে এখন কেন জানি না তাঁর ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’ গানটির কথা মনে আসছে বারবার। ‘আমি অনেক ভেঙেচুরে, আবার শুরু করেছি, আবার পাওয়ার আশায় ঘুরে মরেছি। আমি অনেক হেরে গিয়েও হারটা স্বীকার করিনি, শুধু তোমায় হারাব আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি বৃষ্টি দেখেছি।’ এ কী গান! মনে হয় অঞ্জন যেন আমার কথাগুলোই গানে গানে বলছেন। বেড়ে ওঠার শহর দার্জিলিং ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর গানে, ‘আমার শৈশবের দার্জিলিংটা’ বা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’—এগুলোর মধ্যে শ্রোতারা যেন দেখতে পান পাহাড়ঘেরা দার্জিলিংয়ের অপরূপ প্রকৃতি।
এরপর অনেক গান শোনা হয়েছে অঞ্জনের। ‘ববি রায়ের সঙ্গে চলে যেও না’ গানটা তো রীতিমতো কাঁপিয়ে দিল।
দিন দিন অঞ্জন হয়ে উঠলেন এক ভালোবাসার নাম। তাঁর সম্পর্কে খবরের কাগজে পড়ি। তৃষ্ণা মেটে না কিছুতেই। অঞ্জনের জীবনী থেকে বই লিখলেন বাংলাদেশের সাজ্জাদ হুসাইন। বইয়ের নাম ‘অঞ্জনযাত্রা’। অটোগ্রাফসহ সংগ্রহ করলাম সেই বই। সেই বই পড়ে ভাবলাম, এ কী বৈচিত্র্যময় জীবন তাঁর। বাড়ি কলকাতায় হলেও অঞ্জনকে ভর্তি করানো হয় দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস স্কুলে। স্কুলের কঠোর নিয়মের মধ্যেও পালিয়ে সিগারেট খাওয়া, প্রেম করা। আবার স্কুলমাস্টারের বেত খাওয়ার বাইরে একজন অঞ্জন হয়ে ওঠার আকুতি স্কুল থেকেই পেয়েছিলেন এই শিল্পী।
সৎ থেকে জীবনে বড় হওয়ার দীক্ষাও অঞ্জন পেয়েছেন এখান থেকে। বাবা ছিলেন বড় আইনজীবী। সেন্ট পলসে পড়ার সময় বাবার ব্যবসায় মন্দা নেমে এল। একের পর এক দামি দামি গাড়ি বেচতে হলো। একপর্যায়ে টাকার অভাবে অন্য স্কুলে ভর্তি হলেন অঞ্জন। বড়লোক বাবার ছেলে দেখলেন কীভাবে সংসারে অভাব নেমে আসে। একপর্যায়ে তাঁর পড়াশোনা শেষ হলো। বাবা চলে গেলেন পরপারে।
এ সময় দার্জিলিংয়ের অঞ্জন ‘অঞ্জন দত্ত’ হয়ে ওঠার জন্য শুরু করলেন প্রবল সংগ্রাম। থিয়েটারে যোগ দিলেন। ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু নিজের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না কোনোভাবেই। এর মধ্যে নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ‘শিল্পী’ নামে একটি সিনেমায় অঞ্জনকে প্রধান চরিত্রে কাস্ট করলেন। চরিত্রটি ঠিকমতো বুঝে নিয়ে তিনি চলে গেলেন গ্রামে, তাঁতিদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন। সেই ঘরে ইঁদুর-ছুঁচো ঘোরাঘুরি করে। সেখানেই থাকলেন অঞ্জন। গায়ের রং তামাটে হয়ে গেল। বড় হলো চুল-দাড়ি। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। একপর্যায়ে তাঁর হলো রক্ত আমাশয়। পরিচালক খুঁজে পেলেন একজন প্রকৃত শিল্পীকে, অভিনয়ের জন্য যিনি এতটা করতে পারেন।
অঞ্জন দত্তের গান আমাদের প্রথম যৌবনের সঙ্গী। তাঁর অনেক গানই মনের ভেতর বুদবুদ তোলে। তবে লিখতে বসে এখন কেন জানি না তাঁর ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’ গানটির কথা মনে আসছে বারবার। ‘আমি অনেক ভেঙেচুরে, আবার শুরু করেছি, আবার পাওয়ার আশায় ঘুরে মরেছি। আমি অনেক হেরে গিয়েও হারটা স্বীকার করিনি, শুধু তোমায় হারাব আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি বৃষ্টি দেখেছি।’ এ কী গান! মনে হয় অঞ্জন যেন আমার কথাগুলোই গানে গানে বলছেন।
কিন্তু সেই সিনেমায় তিনি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করলেও তেমনভাবে ‘নায়কোচিত সফলতা’ পেলেন না। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের (এখন কবীর সুমন) গান তখন এপার-ওপার বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়। সুমনের গান অঞ্জনকে ভাবায়। তিনি গান গাওয়ার চেষ্টা করলেন। দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইতেও শুরু করলেন নিজের লেখা গান। খুব অল্প সময়ে সহজ কথায় লেখা অঞ্জনের গানগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
অঞ্জন এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, এমন জনপ্রিয় হতে শুরু করল তাঁর গান যে তিনি মঞ্চে উঠলে ছেলেরা গানের সঙ্গে গলা মেলাতেন। তাঁর পোশাকও ছিঁড়ে দিতেন উত্তেজনায়। সিএমভির মতো বড় বড় সংগীত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাঁর সঙ্গে চুক্তি করা শুরু করল। এই বাস্তবতায় নিজের বাংলা গানকে হিন্দিতে অনুবাদ করে সেটি ওই ভাষায় গাওয়ার প্রস্তাব পেলেন অঞ্জন। সঙ্গে ছিল মোটা টাকার প্রলোভন।
তবে তিনি জানতেন, কোথায় থামতে হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এটা তিনি করবেন না। শুধু টাকাই সব নয়। গান-সিনেমায় একাকার হলেও অঞ্জন হয়তো অভিনেতা হিসেবেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বছর তিনেক আগে ঢাকায় এসে একবার সে কথা বলেওছিলেন স্পষ্ট করে, ‘এখন গানই আমার পরিচয়। কিন্তু আমি আসলে অভিনেতা হতে চেয়েছি। বড় মাপের পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি বটে, কিন্তু বড় অভিনেতা হতে পারিনি। আমি এখন আর নতুন করে অভিনেতা হওয়ার চেষ্টা করি না। আমি মনে করি, একটা সময় যেভাবে অভিনেতা হওয়ার জন্য কাজ করেছি, তা এখন আর সম্ভব নয়। যদি বয়স কম হতো, তাহলে অভিনেতাই হতে চাইতাম। তবে গান না গাইলে হয়তো হারিয়েই যেতাম।’ ২০১৮ সালের সেই দিন অঞ্জন দত্ত বলেছিলেন, তাঁর বয়স ৬৪। এখন সেই হিসাবে অঞ্জনের বয়স ৬৭। হ্যাঁ, ১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মেছেন তিনি।
১৯৮২ সালে ‘গৃহযুদ্ধ’ সিনেমায় অভিনয়ের পর সিনেমা ফেলে তিনি চলে গিয়েছিলেন জার্মানিতে শুধু থিয়েটারের টানে। ওখানে ছিলেন পাক্কা তিন বছর। জার্মানিতে অঞ্জন থিয়েটার দেখেছেন, করেছেন এবং শিখেছেনও। থিয়েটারের মাধ্যমেই সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পান অঞ্জন। মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থিয়েটারে তাঁর অভিনয় দেখেই তাঁকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত বেশ কিছু সিনেমায় বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জন। টালিউডের বদলে যাওয়া ফিল্মি পরিবেশে অভিনেতা হিসেবে অঞ্জন দত্ত নতুনভাবে জ্বলে উঠেছিলেন। ‘দ্য বং কানেকশন’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’, ‘চলো…লেটস গো’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’, ‘শেষ বলে কিছু নেই’—ছবিগুলোতে এই সময়েই অভিনয় করেছিলেন তিনি। করেছিলেন পরিচালনাও।
তবে শেষ পর্যন্ত অঞ্জন দত্ত আমাদের কাছে কোন পরিচয়ে প্রতিভাত হন—গায়ক, অভিনেতা, না পরিচালক?
তাঁর নিবিড় ভক্ত হিসেবে আমার মনে হয়, গায়ক, অভিনেতা বা পরিচালক—অঞ্জনকে এমন বিভাজনে ফেলা অমূলক। কারণ, তিনি আপাদমস্তক এক শিল্পী। এ মাসে ছিল তাঁর জন্মদিন। আমাদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গী, শিল্পী অঞ্জন দত্তকে শ্রদ্ধা।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]