বিদ্রোহে–বিপ্লবে
জাগরণ, স্লোগানে স্লোগানে
ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল কবিতা, গান, র্যাপ, পোস্টার, কার্টুন আর গ্রাফিতি। এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ভাষায় ধরা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে সচিত্র দলিল বিদ্রোহে–বিপ্লবে
স্লোগান রাজনীতির মাঠ থেকে উচ্চকিত সুরধ্বনি। স্লোগান রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা আর ক্ষোভের ভাষা। সময়োপযোগী একটা স্লোগান জটিল রাজনৈতিক ভাবকে সহজ ভাষায় মানুষের মাথায় গেঁথে দিতে কাজ করতে পারে মোক্ষম অস্ত্রের। স্লোগান শত্রু-মিত্র চিনতে শেখায়। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের কথামতো, ‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি বুঝতে শিখি/ কে ভাই কে দুশমন…/ স্লোগান দিতে গিয়ে আমি/ সবার সাথে আমার দাবি/ প্রকাশ্যে তুললাম’।
স্লোগানে সব সময় একটা গণচরিত্র থাকে। ফলে তথাকথিত নান্দনিক হয়ে ওঠার চেয়ে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সংক্ষিপ্ত ও সরল প্রকাশই তাতে বেশি ঘটে। জনগণের তাৎক্ষণিক ক্ষোভ বা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই বেশি ঘটে স্লোগানে। বহুদিনের অনুচ্চারিত ক্ষোভ তাতে ভাষা পায়। স্লোগানে গণদাবি মূর্ত হয়ে ওঠে।
জুলাই ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানের দিকে তাকালে আমরা দেখব, ইতিহাসের অপরাপর গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে রাজনৈতিকতা ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অনেক দিক দিয়েই এর মেজাজে তফাত আছে। রাজনৈতিক আন্দোলন সাধারণত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সড়ক আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। এই আন্দোলন জেন-জির আন্দোলন। এর ফলে অভূতপূর্ব সব ঘটনা ঘটেছে।
এত অল্প সময়ের গণ–আন্দোলনে এত বিচিত্র ধরনের গান, স্লোগান, কার্টুন, গ্রাফিতি ও মিম তৈরি হয়েছে যে ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। অবিশ্বাস্য রকমের বহুবর্ণিল এক আন্দোলন আমরা চাক্ষুষ করেছি।
বর্ণিল কথাটা আক্ষরিক অর্থেও সত্যি। যখন শেখ হাসিনা সরকার মাছের মায়ের পুত্রশোক পালন করতে সবাইকে কালো রং ব্যবহার করার নির্দেশ দিল, তখন দারুণ কুশলতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা দিলেন বিপ্লবের লাল রঙে প্রোফাইল রাঙানোর ডাক। আর তাতে সাড়া দিয়ে কোটি মানুষ ফেসবুকের মতো মিডিয়ার নীল ফিডকে লালে লাল বানিয়ে ফেলল। লালে লাল দুনিয়া। এ যেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘মোহররম’ কবিতা থেকে উঠে আসা বাস্তবতা: ‘নীলসিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া/ আম্মা, লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।’
যাহোক, অনন্য এই গণ-আন্দোলনের অনন্যতার প্রতিফলন স্লোগানেও থাকবে। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বিশ শতকের শুরুতে ব্যাপক আকার নিলে স্লোগানের দ্রোহী উপস্থিতিও স্পষ্ট হতে থাকে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত স্লোগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ থেকে ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের ‘যদি তুমি ভয় পাও/ তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/ তবে তুমিই বাংলাদেশ’ পর্যন্ত স্লোগানগুলোর আলোচনা–পর্যালোচনা অল্প হলেও হয়েছে। জুলাই ২৪ অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলোও ইতিহাসের অনন্য দলিল, কালপঞ্জি। গণবিদ্রোহের ইতিহাসে অনন্য এই জেন-জির অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলোও আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, স্লোগান একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সময়কেই শুধু তুলে ধরে না, এটি সংস্কৃতির পথরেখাও দেখায়।
স্লোগানের গতিবিধি দেখে আপনি রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেকাংশে অনুমান করতে পারবেন। সত্যি বলতে, স্লোগানগুলো দেখেই জুলাই অভ্যুত্থানের টাইমলাইন বা সময়রেখা বুঝে ফেলা সম্ভব। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি মানুষের আকাঙ্ক্ষায় কী রকম বদল ঘটে, তার একধরনের কালপঞ্জি স্লোগানেও প্রতিফলিত হয়। কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে নিতে বদলে গেছে আন্দোলনের দাবি, মিছিলের স্লোগান ও অভ্যুত্থানের ভাষা।
যেমন আন্দোলনের শুরুর দিকে দেখেছি, ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’–এর মতো স্লোগান। আবার ১৫ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করলেন, তখন কিছুক্ষণের মধ্যে মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা স্লোগান দেন: ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।/ কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। কিংবা ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’!
আওয়ামী লীগ ও তাদের বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ এবং ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা’ বলায় তাঁরা পাল্টা বলতে থাকেন, ‘লাখো শহীদের দামে কেনা/ দেশটা কারও বাপের না’। এই পর্যায়ে এসে আওয়ামী স্লোগানের অনেকগুলো পাল্টা স্লোগান আমরা দেখতে পাই। যেমন ‘আছিস যত রাজাকার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’–এর পাল্টা স্লোগান দেখেছি ‘স্বৈরাচার, স্বৈরাচার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’। কিংবা আওয়ামী লীগের ‘জনে জনে খবর দে/ এক দফা কবর দে’র পাল্টা স্লোগান ‘জনে জনে খবর দে/ ছাত্রলীগের কবর দে’।
১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হলে তাঁর ছবি আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি হয়ে ওঠে প্রতিরোধ আর বিপ্লবের আইকন। এদিন থেকে স্লোগানের মেজাজও বদলাতে থাকে। পুলিশি সহিংসতা আর নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপরে গুলি চালানোর ফলে স্লোগানেও তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন, ‘আমার খায়, আমার পরে,/ আমার বুকেই গুলি করে’। কিংবা সরাসরি সাঈদের ছবি ব্যবহার করে অনলাইনে বা অফলাইনে দেখা যায়, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’–এর মতো স্লোগান।
এই সময় থেকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিচারেরও দাবি ওঠে। স্লোগানে তার ভাষা হয়ে ওঠে, ‘তোর কোটা তুই নে,/ আমার ভাই ফিরিয়ে দে’ কিংবা ‘লাশের ভিতর জীবন দে/ নইলে গদি ছেড়ে দে’।
হাসিনার শাসনপন্থীদের দীর্ঘদিন ধরে চালু একটা বয়ান ছিল, আওয়ামী লীগের বিকল্প দেখান। ২৫ তারিখ থেকে সেই বয়ান বা ন্যারেটিভ ভেঙে পড়তে শুরু করে। সৃষ্টি হয়, ‘তুমি কে? আমি কে?/ বিকল্প, বিকল্প’ ধরনের স্লোগান।
এই পর্যায় থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের আপসের সমস্ত সম্ভাবনা বিলীন হতে শুরু করে। স্লোগান শোনা যায় ‘আপস না সংগ্রাম?/ সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘দালালি না রাজপথ?/ রাজপথ, রাজপথ’। পুলিশ ও আওয়ামী সংগঠনগুলো নির্লজ্জ সহিংসতার বিরুদ্ধেও সরব হতে থাকে আন্দোলনকারীরা, ‘কে এসেছে? কে এসেছে?/ পুলিশ এসেছে।/ কী করছে? কী করছে?/ স্বৈরাচারের পা চাটছে’।
আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার ক্ষোভ তীব্র থেকে যত তীব্রতর হতে থাকে স্লোগানও তত জ্বালাময়ী হতে শুরু করে। হাসিনার পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের গুলিতে শত শত মানুষের মৃত্যুর মিছিল যত দীর্ঘ হতে থাকে, হাসিনার পদত্যাগের দাবিও তত স্পষ্ট হতে শুরু করে। স্লোগান ওঠে, ‘এক দুই তিন চার,/ শেখ হাসিনা, গদি ছাড়’, ‘দফা এক দাবি এক,/ শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ কিংবা ‘এক দফা, এক দাবি/ স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’। এই স্লোগান শুরু হওয়ার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল হাসিনাশাহির অন্তিম সন্নিকটে।
৪ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবন ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে লংমার্চের ডাক দেন। সর্বস্তরের জনমানুষের মধ্যেও প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান স্পষ্ট হতে শুরু করে স্লোগানে, ‘ঢাকায় আসো জনতা,/ ছাড়তে হবে ক্ষমতা’।
৫ আগস্ট সকাল থেকেই হাসিনার পালানোর গুজব ছড়াতে শুরু করে। উল্লসিত জনতা স্লোগান দেয়, ‘পালাইছে রে পালাইছে,/ হাসিনা পালাইছে’। বিকেলের মধ্যেই এই স্লোগান বাস্তব সত্যে রূপ নেয়।
জেন–জির অভ্যুত্থান বলেই হয়তো জুলাই অভ্যুত্থানে স্লোগানের বৈচিত্র্য এবার ছিল অনেক। আন্দোলনে দেখা গেছে, ‘এক দফা দাবি এক/ কোটা নট কামব্যাক’–এর মতো স্লোগান, যেখানে কোড সুইচিংয়ের ব্যবহার ছিল। কিংবা অনেক স্লোগানের মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটা স্লোগানও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়, ‘আঁর ন হাঁইয়্যে,/ বৌতদিন হাঁইয়্য’ (আর খেয়ো না,/ অনেক দিন খেয়েছ)।
ইতিহাসে অনেক গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের কথা আমরা জানি, রুশ বিপ্লব কিংবা ইরানি বিপ্লবের কথা জানি। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের অনেকগুলো অভ্যুত্থান আমরা দেখেছি চীনে বা কিউবায়। প্রতিটি অভ্যুত্থানই স্বতন্ত্র। কিন্তু জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের সঙ্গে অপরাপর অভ্যুত্থানের চরিত্রগত মৌলিক কিছু তফাত রয়েছে। যেমন কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে বা সুসংগঠিত দলের নেতৃত্বে এটি হয়নি। রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল ভিন্নতর, নেতৃত্ব ছিল বিকেন্দ্রিক। একুশ শতকের লেট ক্যাপিটালিজমে বিশ্বপুঁজির পেটের মধ্যে বসে, তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’ বলে পরিচিত জেন-জির হাত দিয়ে সংঘটিত হওয়া একুশ শতকের সবচেয়ে যুগান্তকারী এই অভ্যুত্থানের চরিত্র ও ফল ভবিষ্যতে কেমন হবে, তা এখনই বলা কঠিন। যথার্থ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন নিরাবেগ কাল ও স্থানিক দূরত্ব। তবে আপাতদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, সৃষ্টিশীল এই গণ–অভ্যুত্থান তার স্বাতন্ত্র্য নিয়েই হাজির হয়েছে। আর এই স্বাতন্ত্র্যের ইশারা আছে জুলাই অভ্যুত্থানের বৈচিত্র্যময় ও সৃষ্টিশীল স্লোগানে।