নজরুলের মূল্যবোধ ও বাংলাদেশ

কাজী নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশে ‘জাতীয় কবি’ হয়েছেন। কিন্তু সাম্য, মানুষের মুক্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মতো তাঁর ভাববস্তু ও মূল্যবোধ থেকে আমরা কি ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছি? স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভূত বাস্তবতা কি নজরুলকে আবারও খণ্ডিত করল? নজরুলজয়ন্তী সামনে রেখে এসব জিজ্ঞাসার অনুসন্ধান।

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯—২৯ আগস্ট ১৯৭৬)প্রতিকৃতি : কাইয়ুম চৌধুরী

স্বাধীনতার জন্য মানুষকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দাঁড়াতে হবে—এই উপলব্ধি কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম থেকেই ছিল। এই ‘আত্মশক্তি’ প্রপঞ্চটি তাঁর সাহিত্যের ভিত্তিভূমিও।

মানুষের প্রথম পরিচয় তার ব্যক্তিসত্তা। আমাদের প্রত্যেকের একটা ব্যক্তিসত্তা আছে। এরপরই আসে জাতিসত্তার ব্যাপারটি। জাতিসত্তা যখন বিকশিত হয়, তখন তার একটা অভিন্ন অভিব্যক্তির ভাষা ও ভূমি থাকে। জাতীয়তার প্রথম উপকরণ হলো ভাষা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাই সারা পৃথিবীতে অগ্রগণ্য। আমরা বলি, বাঙালি বিকশিত হয়েছে হাজার বছর ধরে। বাংলা ভাষার পরিভ্রমণের ইতিহাস প্রায় ৯ হাজার বছরের। ফলে ভাষাভিত্তিক একটা গোষ্ঠীসত্তা সুদূর অতীত থেকেই আমাদের ছিল। আর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে আমাদের যেসব যুক্তি, এর সবই নজরুল ইসলামের মধ্যে ছিল। বলা দরকার, কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কতগুলো সূচক বক্তব্য দিয়েছেন। ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, বাঙালি যেদিন এক হয়ে বলতে পারবে বাঙালির বাংলা, সেদিন সে অসাধ্য সাধন করবে। বাঙালি একাই সেদিন ভারত স্বাধীন করবে। স্বাধীনতার জন্য আমাদের কী করতে হবে, এই প্রবন্ধের শেষ দিকে নজরুল তার উপায় বাতলেছেন। তাঁর মত হলো, বাঙালিকে তার বীরসত্তার প্রকাশ ঘটাতে হবে। দুই ধরনের দখলদার আছে—আশপাশের ও বাইরের। তাদের বিতাড়িত করতে হবে। এ জন্য একটা যুদ্ধ অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ দরকার।

অবিভক্ত ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের এই কথাগুলো মধ্যে প্রকারান্তরে স্থিত আছে বাঙালির লড়াকু চেতনা ও সংগ্রামী মনোভাব। কাজী নজরুল ইসলাম যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, আদতে তা তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবির জন্মদিনে তাঁকে এ দেশে নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন, তার পেছনেও এমন একটা যুক্তি আছে। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশেই তাঁকে স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়। তিনি আমাদের মনে চেতনা-চিত্তে জাগ্রত।

কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষা থেকে উচ্চারণ—সবকিছুই ছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর এই ভাবনা গ্রহণ করেছিলেন বলেই ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে বরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশে এনেছেন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব, কাজী নজরুল ইসলামকে এ দেশের জাতীয় কবি করার মধ্য দিয়ে আমরা একটা পরম্পরাকে অনুসরণ করেছি। স্বাধীনতা, বীরসত্তা, মুক্তিযুদ্ধ—নজরুলের কাছ থেকে এসব প্রণোদনা পেয়ে বাঙালিরা ১৯২৯ সালে আলবার্ট হলে এই বিদ্রোহী কবিকে বাঙালির ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করেছিল। ইতিহাসের এ সত্যের আলোকে বলা যায়, আমরা যথার্থভাবেই এর পরম্পরাকে বহন করে এনেছি।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যেসব মূল্যবোধ আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম, তার সবকিছুই নজরুল-সাহিত্য বা নজরুলের মূল্যবোধের মধ্যে বিদ্যমান। তাই তাঁকে আমরা জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলাম। তবে স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এসে আজ যদি হিসাব করি, কতটা পৌঁছাতে পারলাম সেই মূল্যবোধের কাছে, খানিকটা হতাশায় আমরা যে নিমজ্জিত হব—এ কথা সত্য।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে থেকে আমাদের জাতীয় জীবনে ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক যে স্লোগান যুক্ত হলো, তার সঙ্গেও নজরুলের যোগ রয়েছে। ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় নজরুল প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তাই বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডে নজরুলই যে জাতীয় কবি হবেন, এ যেন ঐতিহাসিকভাবেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান—সবার ব্যক্তিক ও সামষ্টিক স্বাধীনতার কথা নজরুল বলেছেন। তাঁর আগে খুব কম বাঙালিই নারী-পুরুষের সমতা ও স্বাধীনতা নিয়ে এমনভাবে ভেবেছেন। নজরুলের সাহিত্যে যেসব মূল্যবোধ রয়েছে—সম্প্রদায়গত মিলন, মানুষের মুক্তি, নারী-পুরুষের সমতা, মানুষের স্বাধীন সত্তা—সত্যি বলতে, স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যেসব মূল্যবোধ আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম, তার সবকিছুই নজরুল-সাহিত্য বা নজরুলের মূল্যবোধের মধ্যে বিদ্যমান। তাই তাঁকে আমরা জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলাম। তবে স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এসে আজ যদি হিসাব করি, কতটা পৌঁছাতে পারলাম সেই মূল্যবোধের কাছে, খানিকটা হতাশায় আমরা যে নিমজ্জিত হব—এ কথা সত্য। স্বাধীন দেশে আমরা বারবার মানবিক স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছি। তবে সব সময় যে তা অর্জন করতে পেরেছি, তা বলা যাবে না। এই না পারারও ইতিহাস আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির হাতে অন্যায়ভাবে সপরিবার নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের স্বাধীনতা ও বাঙালিত্বের সবকিছু যেন মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। হাওয়া বইতে শুরু করল উল্টো স্রোতে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের যে সংবিধান প্রণীত হয়, সেখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা ছিল। সব মানুষ সমানভাবে, শান্তিতে বাস করতে পারবে—এই মন্ত্র আমরা কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি ছিলেন সাম্যবাদী। এই সাম্যবাদী কবি ‘অভেদসুন্দর’ বলে একটা কবিতাসম্মত কথা বলেছিলেন। এই ‘অভেদসুন্দর’ বিষয়টির ভেতরে সর্বমানবতা, পরমতসহিষ্ণুতা—এই বিষয়গুলো নিহিত।

জীবনের শেষ অভিভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ইসলাম ধর্মে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তিনি কেবল মুসলমানের নন। সর্বমানবিকতার বোধ, তথা অন্যের মতকে গ্রহণ করার মানসিকতা তিনি সব সময় ধারণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার জন্য নজরুলের সেই ‘অভেদসুন্দর’-এর কাছে আমাদের পৌঁছানো প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুপ্রদত্ত সংবিধানেও এই ‘অভেদসুন্দর’ রয়েছে। এ জন্য সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকার স্বীকার করতে হবে। তা না করে আমরা যদি ভিন্ন পথে অগ্রসর হই, তাহলে পদে পদে বিপদ আসবে। এখন পৃথিবীজুড়ে সম্পদ কুক্ষিগত করার অযৌক্তিক প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। এখান থেকে সরে এসে যেমন মানবিক বৈষম্য দূর করা দরকার, তেমনি রাজনীতিক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মীসহ সবার এ বিষয়ে সচেতনতাও প্রয়োজন। সাম্য ও সুখের পরিবেশ বজায় রাখতে না পারলে আমরা আবার ভুল পথে হাঁটব। আর এটা হলে তা হবে দেশের সংবিধানের মৌলিক আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ।

আমাদের দেশে, এমনকি কলকাতায়ও নজরুল যেভাবে চর্চিত হন, তা অনেকটাই খণ্ডিত। কিন্তু নজরুল এবং তাঁর সাহিত্য খণ্ডিত নয়। নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আমরা তাঁকে খণ্ডিত করেছি। নিজ নিজ ভাবাদর্শের অধিকারীরা নিজের নিজের সুবিধা অনুযায়ী নজরুলকে মূল্যায়ন করছেন। এ ক্ষেত্রে আবারও বলা দরকার, ধর্ম–কর্মে, সংসারে, সাহিত্যে এবং জীবনযাপনেও নজরুল সর্বদা একটা ‘অভেদসুন্দর’ নির্মাণ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে এই বার্তা আমাদের গ্রহণ করা উচিত। আজকাল একধরনের মানুষ নিজের স্বার্থে অন্যের স্বার্থকে আঘাত করছে। আমরা যদি এই প্রবণতা থেকে না বেরোতে পারি, তবে যতই নজরুলের গান-কবিতা গলায় ধারণ করি না কেন, তাঁর মূল্যবোধ থেকে দূরেই থেকে যাব।

নজরুলের তিন হাজারের মতো গান শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০০ গানের স্বরলিপি পাওয়া যায়। তাঁর গানে ভালোবাসা, মানবিক সখ্য, মূল্যবোধ—সবকিছুই আছে। ফলে তাঁকে চর্চা করা মানে একটা মানবিক সমাজ নির্মাণের দিকেই যাত্রা।

প্রতিদিন সকালে উঠে নজরুলের অন্তত একটি রচনা পড়া প্রয়োজন। আমাদের পাঠাভ্যাস এখন একেবারেই কমে গেছে। সম্পদের আকাঙ্ক্ষায় দিন দিন অধ্যয়ন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ। আমরা তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে যতটা গ্রহণ করেছি, ততটা ধারণ করতে পারিনি।

এখন যদি প্রশ্ন আসে, কীভাবে হৃদয়ে ধারণ করা যাবে নজরুলকে? আমাদের জাতীয় জীবনে তাঁর গুরুত্ব কী? নজরুলের মূল্যবোধ থেকে বাংলাদেশ কত দূরে?

এককথায় এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা বলা যায়, যে জাতির একজন বীর থাকেন, এমন একটা আদর্শ থাকে—আমি যদি তাঁর মতো হতে পারি—তবে আমাদের পিছিয়ে থাকার কথা নয়। আদর্শিকভাবে নজরুলকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। না হলে ধনতান্ত্রিক স্বৈররাষ্ট্রের মতো নানাবিধ নিপীড়ন পিছু ছাড়বে না আমাদের। কেননা, ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য না কমানো গেলে মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব।

নজরুলের চেয়ে মানবিক ঐক্যের মানুষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষ বাঙালির ভেতরে খুব বেশি নেই। শেষে এটুকু বলে এই লেখার ইতি টানতে চাই, আজ আমরা যে বাঙালির মানব-ঐক্যের সাধনার কথা বলছি, নজরুল সেই মানব-ঐক্যের ডাক অনেক আগেই দিয়েছেন। তাঁর পথে হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধু। এ প্রসঙ্গ মনে রেখে আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশে জাতীয় কবির মর্যাদা সমুন্নত করতে চাই, তাহলে দেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তাঁর মূল্যবোধের সমানুপাতিক প্রতিফলন থাকা জরুরি। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক।