১৯০১ সালে সাহিত্যে প্রথম নোবেলপ্রাপ্ত লেখক সুলি প্রুদোম আর ২০২২ সালের নোবেল বিজয়ী আনি এরনোর মাঝখানে রয়েছে ১২১ বছরের উজ্জ্বল ইতিহাস। এই প্রায় শোয়া শতাব্দীজুড়ে নোবেল পেয়েছেন মোট ১১৯ জন সাহিত্যিক। এর মধ্যে ১০২ জন পুরুষ এবং ১৭ জন নারী সাহিত্যিক পুরস্কৃত হয়েছেন, যার সর্বশেষজন ফরাসি লেখক আনি এরনো। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির পর এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জিজ্ঞাসা ছিল: কে এই আনি এরনো, কীভাবে নোবেল পেলেন তিনি?
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়া
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। সুইডিশ একাডেমির নেতৃত্বে প্রতিবছর সাহিত্যে যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, এর সদস্যসংখ্যা ১৮। তবে চার থেকে পাঁচজনের সমন্বয়ে গঠিত নোবেল কমিটিই মূলত লেখকদের সাহিত্যকর্ম পাঠ ও সুইডিশ একাডেমির কাছে সম্ভাব্য প্রাপকদের নাম পেশ করে থাকে। যেমন এ বছর নোবেল কমিটির সভাপতি ছিলেন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক অ্যানডার্স ওলসন। আর সদস্য ছিলেন চারজন—সাহিত্যিক পিয়ার ওয়াস্টবার্গ, লেখক জেসপার স্ভেনব্রো, লেখক অ্যালেন ম্যাটসন ও লেখক অ্যালেন সোয়ার্ড। কমিটির সহসদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ম্যাটস মাম।
এ পুরস্কারের কয়েকটি ধাপ রয়েছে।
প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরে নোবেল কমিটি কর্তৃক বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও সংস্থার কাছে লেখকদের নাম মনোনীত কারার জন্য চিঠি পাঠানো হয়। পরের বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় এই নাম। বিভিন্ন দেশের যেসব ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান পুরস্কারের জন্য লেখকদের নাম প্রস্তাব করতে পারেন, তাঁরা হলেন সুইডিশ একাডেমির অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের সদস্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক, কোনো দেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য সংস্থা এবং আগে নোবেল পেয়েছেন এমন লেখকেরা।
● নোবেলের ১২১ বছরের ইতিহাসে পুরস্কার পেয়েছেন ১১৯ জন সাহিত্যিক, পুরুষ ১০২ ও নারী ১৭ জন।
● ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাহিত্যে মোট ৩ হাজার ৭৭৭টি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবছর প্রায় ২০০টির মতো মনোনয়ন আসে। পরে প্রস্তাবিত নামগুলো নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে অনুমোদনের জন্য সেটি একাডেমির কাছে পেশ করে নোবেল কমিটি। এর পরবর্তী ধাপে এপ্রিল মাসে ১৫ থেকে ২০ জন লেখককে নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করা হয়। মে মাসে ওই তালিকা থেকে পাঁচজনকে বাছাই করা হয়। এটাই হলো নোবেলের সংক্ষিপ্ত তালিকা।
জুনে শুরু করে আগস্ট মাস পর্যন্ত সুইডিশ একাডেমির সদস্যরা সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত পাঁচজন লেখকের লেখাপত্র পড়ে ও বিশ্লেষণ করে কাটান। সেপ্টেম্বরে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন এবং তর্কবিতর্ক করেন। সুইডিশ একাডেমির সভাপতি অ্যানডার্স ওলসন জানান, ‘পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, এত সব অসাধারণ লেখকের মধ্য থেকে কেবল একজনকে বাছাই করা।’ অবশেষে অক্টোবরে নির্বাচিত হয় বিজয়ী, এ মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়। আর ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমে বিজয়ী লেখকের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার।
নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর
সুইডিশ কমিটি ৫০ বছরের আগে কোনো সালের প্রস্তাবিত লেখক ও প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশ করে না। সম্প্রতি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রস্তাবিত লেখক ও প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাহিত্যে মোট ৩ হাজার ৭৭৭টি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৯৭১ সালে নোবেল কমিটির কাছে বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। তাঁর নামটি প্রস্তাব করেছিলেন কৃষ্ণ কৃপালিনি। সে বছর তারাশঙ্কর নোবেল পাননি, পেয়েছিলেন চিলির কবি পাবলো নেরুদা। এ লেখার শেষে এই সুযোগে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই রুশ কথাসাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের কথা, যিনি মোট ১৯ বার মনোনয়ন পেলেও নোবেল জেতেননি। এ প্রসঙ্গে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের কথাও বলা যাবে, নোবেল পুরস্কারের জন্য মোট ২৬ বার প্রস্তাব করা হয়েছিল তাঁর নাম। কিন্তু তিনিও পাননি এ পদক।
● গ্রন্থনা: মাহীন হক
সূত্র: নোবেলপ্রাইজ ডট ওআরজি