ক্রিকেট যখন প্রযুক্তির আর অর্থের
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উত্তেজনায় দুনিয়া এখন মাতোয়ারা। কিন্তু পুঁজি আর প্রযুক্তির চক্করে ক্রিকেট কি এখন শুধুই একটা খেলা?
আশির দশকে যে কিশোর স্কুলে যাওয়ার পথে কোনো ক্রিকেটপ্রেমীকে দেখেছেন রানিং কমেন্ট্রি শুনতে উঠতে-বসতে-হাঁটতে কানের কাছে এক ব্যান্ডের রেডিও ধরে রাখতে, আবার স্কুল থেকে ফিরতেও সেই একই দৃশ্য, সেই কিশোরই আজ দিনভর টেস্ট বা ওয়ানডে ক্রিকেটের দর্শক না হয়ে উত্তেজনাকর টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বুঁদ হয়ে থাকেন। আয়োজক আর খেলোয়াড়েরাও লুফে নেন দীর্ঘ ম্যাচের পরিবর্তে অল্প সময়ে বেশি লাভের সুযোগ। প্রযুক্তি, চাকচিক্যের আধিক্য আর টাকার লেনদেন সময়কে কতভাবেই না বদলে দেয়!
১৭৮৭ সালে মেরিলবোন ক্রিকেট ক্লাব থেকে যাত্রা শুরু করে আজকে ২০২৩ সালের ক্রিকেটে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবং আসছে। চারদিকে তাক করা ক্যামেরাগুলো এখন ব্যাটাসম্যানের ভাগ্য নির্ধারণ করে, টিভি থাকে আম্পায়ারের ভূমিকায়, গণমাধ্যম খেলার প্রতিটি মুহূর্ত পৌঁছে দেয় মানুষের চোখ-কানের চাহিদামতো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ সেসব মুহূর্ত নিয়ে বিচার-বিবেচনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, বলতে গেলে খেলার প্রতিটি মুহূর্তে এখন দর্শকেরা ক্রিকেটারের হেলমেটের ঠিক চারদিকে জড়ো হয়ে বসে থাকেন। একসময়ে ধরা যাক, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সিরিজ বা ওয়ানডে ম্যাচ হলে একটি মাত্র ক্যামেরার চোখ দিয়ে পিচের এক পাশ থেকে দর্শক তাকিয়ে থাকতেন। দ্রুতগামী খেলার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মুহূর্তগুলো বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। আর টি-টোয়েন্টি শুরুর পর থেকে পিচের চারদিকে অন্তত ৩০টি ক্যামেরায় এখন দর্শকের চোখ। স্টাম্পের গায়েও বসানো আছে মিনিয়েচার ক্যামেরা। ব্লাইন্ড স্পট বলে একচুল জায়গাও নেই। দর্শক এখন ব্যাট হাতে স্টাম্প আড়াল করে নিজেই যেন ব্যাটসম্যানের জায়গায় দণ্ডায়মান, সামনে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান, তাঁকে মোকাবিলা করবেন এবার দর্শক নিজেই! টেলিভিশনের সামনে বসে তো বটেই, চাইলে হাতের মুঠোয় ফোনে ক্রিকেটের অ্যাপে। সোজা কথায়, ক্রিকেট আগে ছিল ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল’ বা একমাত্রিক আর এখন তা ‘মাল্টিডাইমেনশনাল’, অর্থাৎ ক্রিকেট এখন বহুমাত্রিকতা নিয়ে উপস্থিত।
২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আইসিসি টি-টোয়েন্টির আয়োজন করেছে ৮৬৮টি, টেস্ট ১২১ আর ওয়ানডে ২৪৬।
শুরুর দিকে, ২০০৩ সালে টি-টোয়েন্টি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে সনি টিভির কাছে বিক্রি হয়েছিল।
ইউনিক টেলিভিশনের তথ্যানুযায়ী, প্রথম আইপিএল দেখেছিলেন ১০২ মিলিয়ন মানুষ, দশম আয়োজন দেখেন ৪০০ মিলিয়ন। আর ১৩তম বারের প্রথম এক সপ্তাহেই দেখেন ২৬৮ মিলিয়ন দর্শক, যা ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চার গুণ।
দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেটপ্রেমীদের বুঁদ হয়ে থাকার জায়গা, সিরিজ আর ওয়ানডে ফরম্যাটের জায়গায় যখন টি-টোয়েন্টির পতাকা সগৌরবে উড়তে থাকে, তখন দীর্ঘদিনের দর্শকের মনে স্মৃতিময় অতীতের হাত ধরে কিছু প্রশ্ন আসে বটে। যদিও বিশ্বকাপের আয়োজনের খাতিরে ওয়ানডে ফরম্যাটকেই এখনো ধরে রাখা হয়েছে, কিন্তু দর্শকের মনে আশঙ্কা আসতেই পারে, এ ব্যবস্থা থাকবে তো? ক্রিকেট একসময় সত্যিকার অর্থে ছিল ধৈর্যশীল ও তারিয়ে তারিয়ে আনন্দ লাভের খেলা। আস্ত একটা দিন শেষে উত্তেজনাকর কিছু মুহূর্তের স্মৃতি নিয়ে তৃপ্ত হতেন দর্শক। প্রিয় দল জিতে যাওয়ার বা হারার আনন্দ-বেদনা দীর্ঘদিন তাঁর মনে উঁকি দিত। কিন্তু এখন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে দর্শকের শরীরে এন্ডরফিন হরমোন তৈরি করে, অর্থাৎ তাঁকে উত্তেজিত করে, আনন্দ-বেদনায় ভাসিয়ে তারপর ডোপামিন নিঃসৃত করে তাঁকে তৃপ্ত করার প্রক্রিয়া সফলভাবে চালু হয়ে গেছে।
তবে এসব কি করা হয়েছে কেবল দর্শকের কথা ভেবে?
দর্শক আর প্রযুক্তি হয়তো কেবল সহায়তা করেছে, মূলে আছে অর্থের লেনদেন। বিশ্বব্যাপী বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থই সব। কার্ল মার্ক্স সেই কবেই বলেছিলেন ‘বুর্জোয়া সমাজে অর্থের ক্ষমতা’র কথা; অর্থ এমনই এক উপাদান, যা পুঁজিবাদী সমাজের অন্য সব উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে প্রযুক্তির আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সঙ্গে মানুষের কিংবা অন্য যেকোনো উপাদানের যোগাযোগ। তাই অর্থ ও প্রযুক্তি যেদিকে নির্দেশ করবে, মানুষের চাহিদা সন্দেহাতীতভাবে ধাবিত হবে সেদিকেই।
প্রযুক্তি যখন উৎকর্ষের দিকে, ঠিক তখনই ভারতের আইপিএল আর অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল) টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে শুরু হলো। অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম ক্রিকেট খেলাকে তখন গাড়ির রেস ফর্মুলা ওয়ানের মতো করে প্রচার শুরু করল। ফক্স স্পোর্টস আর চ্যানেল নাইনের মনোযোগ গেল ওই খেলার দিকে। শুরু হলো ক্রিকেটে মনোমুগ্ধকর উপস্থাপন, শত ক্যামেরার ফ্লুইড ফ্রেমিং, ঝকমকে গ্রাফিকস, হাই ইনটেনসিটি, র্যাপিড কাটস আর হাইপারবোলিক ধারাবর্ণনা—তখন থেকে এই হলো মূলত ক্রিকেটের চেহারা। যে চাকচিক্য তার গায়ে এসে লাগল আর দিন দিন কেবল আনকোরা প্রযুক্তিনির্ভর চোখ ঝলসানো পরিবর্তনের আঁচড় সেখানে পড়তে লাগল, তাতে ক্রিকেট এখন কেবল সুস্থিরভাবে মাপজোখ করে বল-ব্যাট করার খেলা নয়, বরং অকশন, টাকার লেনদেন আর গ্ল্যামারের আখড়া।
তবে প্রযুক্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবনের কোন জায়গায় চাকচিক্যের ছোঁয়া লাগেনি? পছন্দমতো খাওয়া-পরা থেকে শুরু করে বিনোদন—সবকিছুই এখন নানা প্রযুক্তির উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। বলা বাহুল্য, প্রযুক্তি মানুষকে ধৈর্যহীন করে, দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে বাধা দেয়। যে দর্শক চার-পাঁচ দিন ধরে টেস্ট ম্যাচ দেখতেন, ওয়ানডে ম্যাচ দেখবেন বলে আটঘাট বেঁধে বসতেন, তাঁর এখন ততটা সময় কোথায়! অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আর হাজার অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনরাত দৌড়ানো আছে, সামাজিক চাপে সবার ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা আছে, সেখানে নিজের জন্য এতটা সময় দেওয়া অসম্ভব। এখন মূলত মানুষ খোঁজে শর্টকাট রাস্তা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘ উপন্যাস পড়ার স্থিরতা নেই, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক লাইন পড়াই এখন পাঠকের পড়াশোনা। চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্যও কমে এসেছে। মানুষের মনোযোগের ব্যাপ্তি ছোট হতে হতে অমনোযোগের পর্যায়ে উপনীত। একটাতে মনোযোগ দিলে জানেন, তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য আরও অনেক ক্ষেত্র। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা সারা পৃথিবীর সমস্ত উত্তেজনাকর বিষয়-আশয় তাঁর চোখের সামনে হাজির করছে। তাই সাধারণ জীবনের নির্ভেজাল গল্প, ধীর খেলার বাস্তব গতি এখন আর তাঁকে আকর্ষণ করে না। প্রযুক্তি আর অর্থনীতি মানুষের মনস্তত্ত্বে যে পরিবর্তন এনেছে, তাতে ধাক্কা বা চমক ছাড়া আর কিছু তাঁকে জাগাতে পারছে না। সেই শেষের কবিতায় যেমন রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন—‘...চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো; ফুলের মতো নয় বিদ্যুতের রেখার মতো...’। তাই তো উপন্যাস-চলচ্চিত্রে সামাজিক ওঠানামাবিহীন জীবনের কাহিনিতে পাঠক-দর্শক আর উঁকি দিতে চান না। তিনি চান রহস্যের গন্ধ, অ্যাডভেঞ্চার, টান টান উত্তেজনা—থ্রিল আর অ্যাকশন। উপন্যাস-চলচ্চিত্রে তাই অ্যাডভেঞ্চার আর রহস্য গল্পের জোয়ার এসেছে। মানুষের বদলে যাওয়া এ মনস্তত্ত্বের সঙ্গে টি-টোয়েন্টির আবিষ্কার ভালোমতো তাল মেলাতে পেরেছে। এরপর যদি তাতে থাকে নিত্যদিনের প্রযুক্তিগত চমক, তাহলে তো কথাই নেই। আগের সেই ক্রিকেট ফরম্যাটের তুলনায় সময় বাঁচল, আবার তৃপ্তিও বাড়ল।
কিন্তু ওয়ানডে বা টেস্টে নাটকীয়তা কিংবা শেষ মুহূর্তে পট আমূল বদলে যাওয়ার ভোজবাজি কি ভোলার! শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালের কথাই ধরা যাক—ট্রেন্ট বোল্ট ক্যাচ ফেলে দিলেন, বেন স্টোকস যখন স্টাম্পের জন্য ক্রিজে হুড়মুড় করে বল ছুড়লেন, ব্যাটে লেগে হলো চার, সুপার ওভারের শেষ বলেও রানের নিষ্পত্তি হলো না, গাপটিলের রানআউটের পর বাটলারের উদ্দাম ছুট, আর তারপর বাউন্ডারির ওপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ডের হাতে ট্রফি ওঠা। দিনমান অপেক্ষা না করলে ধীর-উত্তেজনার খেলা ওই পর্যায়ে ওঠা অসম্ভব বটে। টি-টোয়েন্টিতে সন্ধ্যাবেলা অকশনে নেওয়া ক্রিকেটারদের ছড়ানো উত্তেজনা অফিসের পরে, স্কুল-কলেজের পরে আরাম করে উপভোগ করা যায়। টেলিভিশনে প্রচারের ক্ষেত্রেও সময়টা উপযোগী, প্রচুর দর্শক আর মাত্র তিন-চার ঘণ্টার অনুষ্ঠান, গণমাধ্যম ঠিক যেমনটা চায়। ক্রিকেটার আর আয়োজকদের লাভও অনেক বেশি, তাই অকশন আর গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য বিক্রিসহ টাকার ছড়াছড়ি অনেক বেশি। শুরুর দিকে, ২০০৩ সালে টি-টোয়েন্টি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে সনি টিভির কাছে বিক্রি হয়েছিল। ইউনিক টেলিভিশনের তথ্যানুযায়ী, প্রথম আইপিএল দেখেছিলেন ১০২ মিলিয়ন মানুষ, সেখানে দশম আয়োজন দেখেন ৪০০ মিলিয়ন। আর ১৩তম বারের প্রথম এক সপ্তাহেই দেখেন ২৬৮ মিলিয়ন দর্শক, যা ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চার গুণ।
টেস্ট আর ওয়ানডে একে অপরের পরিপূরক, তবে টি-টোয়েন্টি দ্রুতগামী এবং মানুষের বর্তমান জীবনাচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেভাবে ভাবতে গেলে, টেস্ট আর ওয়ানডে পুরোনো দিনের সাদাকালো ছায়াছবি, ধীর লয়ের আর নিয়ন্ত্রিত আবেগের। সেখানে টি-টোয়েন্টি সম্পূর্ণ রঙিন, নাচগানে ভরপুর। চিয়ারলিডাররা একটি অর্জনও হেলাফেলা করেন না। অভিনন্দন আর হাসি-আনন্দ, বিখ্যাত ব্যক্তিদের আনাগোনা, শত শত স্পনসর—সব মিলে ভরপুর আয়োজন। কত সেলিব্রিটি আর স্টারের সমাগম খেলাকে সরগরম করে প্রতিদিন! কোথায় আসর বসবে আর কে স্পনসর করবে—সবকিছু নির্ভর করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাদি বিবেচনা করে।
তবু শুরুর দিকে খেলা-গবেষকেরা ভেবেছিলেন, এ এক হঠাৎ ফ্যাশন, যাকে বলে ‘ফ্যাড’, এ রকম জিনিস হুট করেই আসে আবার হুট করেই চলে যায়। কিংবদন্তি বোলার মাইকেল হোল্ডিং বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, এটা আবার ক্রিকেট নাকি! এ তো মনে হয় চিরাচরিত ক্রিকেট আর নতুন প্রজন্মের চাহিদার মাঝামাঝি ভারসাম্য বজায় রাখার এক কায়দা, পুরোনো বিখ্যাত রচনার যেমন সংক্ষিপ্ত রূপ হয়। হফম্যান বলেছিলেন, ‘খেলায় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আমরা নিজেদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাই, কিন্তু তাই বলে এতটা নিয়ন্ত্রিত!’ নিশি নারায়ণ বরং হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা আসলে এখন খেলার জগৎ থেকে বিনোদনের জগতে প্রবেশ করেছি।’ পাওয়ার প্লে নামে ছয় ওভার নিয়ে টাকা খাটানো দেখে বিবিসির জোনাথন অ্যাগ্নু বলেছিলেন, এটা হলো যত কম সময়ে যত বেশি টাকা বের করে আনা যায়, সেই ধান্দা। মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছিলেন, টেস্ট সত্যিকারের খেলা, আর টি-টোয়েন্টি কেবল ভাগ্যের। ইমরান খানও সুর মিলিয়েছিলেন, ক্রিকেটারের টেম্পারমেন্ট আর টেকনিকের বিচার করবে টেস্ট বা ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির মতো ভাগ্যের খেলা নয়। জাভেদ মিয়াদাঁদ অবশ্য বলেছিলেন, ‘অল্প সময়ে বেশি টাকা পেলে ক্রিকেটাররা যাবেন না কেন?’ অন্যদিকে পাকিস্তানি পেসার ওয়াসিম আকরামের ধারণা, ওয়ানডে এখন একঘেয়ে আর বিরক্তিকর। শুধু খেলতে হয় বলে খেলা—বল করে যাও, মাঝেমধ্যে বাউন্ডারি খাও, চারজন ফিল্ডার সেট করো, ২০০-২৫০ রান হোক, শেষ ওভারে আটকানোর চেষ্টা করো—এই তো! তিনি বলেন, ওয়ানডে থেকে তাঁর কমেন্ট্রি করারও মন উঠে গেছে।
অনেকে মনে করেন, ওয়ানডে আর টেস্ট খেলার সময়ে ক্রিকেটারদের মনে থাকে দেশপ্রেমের গর্ব, টি-টোয়েন্টিতে একমাত্র থাকে টাকা আয়ের লক্ষ্য। কারও মতে, তাঁরা এই ফরম্যাটে খেলতে খেলতে খেলাই ভুলে যাচ্ছেন। ২০১২ সালে এশিয়া কাপে ভারত বাংলাদেশের কাছে হারাতে নিজের দেশের দর্শকদের এ রকম সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। অন্যদিকে আইসিসি কোন ফরম্যাট চায়, তা সাম্প্রতিক হিসাবটা দেখলেই বোঝা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তারা টি-টোয়েন্টির আয়োজন করেছে ৮৬৮টি, টেস্ট ১২১ আর ওয়ানডে ২৪৬। মিসবাহ–উল–হক যেমন ওয়াসিম আকরামের মতোই বলেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এটা টিভির অনুষ্ঠান হিসেবে চমৎকার যখন কিনা আমরা জানি খেলার মূল বিষয়ই হলো বিনোদন।
আরেকভাবে ভাবলে, প্রাচীন অলিম্পিক গেমসে না থাকলেও ১৯০০ সাল থেকে ক্রিকেট অলিম্পিকের অংশ। তবে কখনোই খেলা হয়নি; হয়নি হয়তো তার দৈর্ঘ্যের জন্যই। এখন ক্রিকেটকে অন্তর্ভুক্ত করার শতাধিক বছর পর আইসিসির প্রধান নির্বাহী জানান, এখনকার টি-টোয়েন্টি অলিম্পিকের জন্য একবারে দশাসই। তাই অলিম্পিকের নতুন ডাইমেনশনেও ক্রিকেটকে হয়তো শিগগির দেখা যাবে। একসময় গরমের কারণে আরব আমিরাত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কা ছিল অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডের টিমের খেলার জন্য কষ্টকর। তাই ওই স্থানগুলোতে ওয়ানডে বা টেস্ট হতো না তাদের আপত্তির কারণে। এখন সেখানে সন্ধ্যার আবহাওয়ায় অবলীলায় টি-টোয়েন্টি খেলা যায়। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যতটা দখল করে রাখে, ক্রিকেটও হয়তো রাখে ততটাই। এটাকেই হয়তো খেলার ক্ষেত্রে সত্যিকারের ডিজিটাল বিপ্লব বলা যেতে পারে। কারণ, দর্শকই তো যেকোনো বিনোদনের শেষ লক্ষ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা টি-টোয়েন্টির প্রতিটা চমক নিয়ে প্রশংসা আর তর্কের ঝড় তোলেন। এই যেমন ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি নিয়ে ফেসবুকে ৪৬ মিলিয়ন মানুষ কথা বলেছিলেন আর টুইটারে ইমপ্রেশন জানিয়েছিল ৫ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন। প্রযুক্তির বিস্তার খেলাপ্রেমী মানুষকে কতভাবেই না উত্তেজনাকর খেলার সঙ্গে একীভূত হতে সাহায্য করছে!
১৯৯২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতের মধ্যে টেস্ট সিরিজে রানআউট নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথম টেলিভিশনকে থার্ড আম্পায়ার মানা হয়েছিল। এখন স্টাম্পিং, এলবিডব্লিউ, ক্যাচ বা ওয়াইড—সবকিছুরই রায় দেয় প্রযুক্তি। এখন দর্শক খেলা দেখেন হক–আই কিংবা হটস্পট টেকনোলজিতে। মাঠের দর্শক এখনো টিকে আছেন, ঠিক যেমন ওয়ানডে এখনো টিকে আছে বিশ্বকাপের আয়োজনের জন্য। কিন্তু কে জানে এর স্থায়িত্ব আর কদিন!