শহীদুল জহিরের গল্পে আবদুল গণিরা কেন রাজাকার হয়
শহীদুল জহিরের অধিকাংশ গল্পে আমরা রাজাকার হিসেবে আবদুল গণিকে পাই। লেখক অন্তত তিনটি গল্পে রাজাকারের নাম হিসেবে এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ প্রতিটি গল্পের গণি একই ব্যক্তি নন। তারা সমনামী।
বিষয়টি প্রথম টের পাই ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ (২০০২) ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে। আবদুল গণি নামের এক রাজাকার পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে ক্রমাগত পাকিস্তানি সৈন্যদের ডেকে আনে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওরফে ‘বিলাই’দের ধাওয়া খেয়ে মহল্লার লোকেরা যখন ‘ইন্দুরে’র মতো পালিয়ে যায়, গণি তখন ঘোষণা দেয়, ‘আপনেগো আবার বিলাই দেখান লাগে’।
এ ছাড়া আরও দুটি উপন্যাসে শহীদুল জহির দুটি পৃথক গণিকে হাজির করেন। মুখের দিকে দেখির (২০০৬) গণি যুদ্ধের টানা ৯ মাস মুরগি চুরির মতলব নিয়ে ওত পেতে থাকা শিয়ালের মতো অন্তঃসত্ত্বা খৈমনদের বাড়ি আনাগোনা করে। ওদিকে খৈমনও গর্ভপাতের পর নিজ সন্তানকে সবজিবিক্রেতা স্বামীর চাঙারির মধ্যে কাপড়ের ‘পোঁটলা’ বানিয়ে লুকিয়ে রাখে; আর বিপদ এড়াতে মা ক্যাঙারুর মতো কোমরের নিচে জামার আড়ালে কাপড়ের পর কাপড় গুঁজে পেট ফুলিয়ে রাখে। এরপর একাত্তর সালে বাংলাদেশ মুক্ত হলে মুক্ত হয় শিশুটিও। সেই থেকে লোকে তাকে বিদ্রূপ করে ‘পোঁটলার পোলা’ বলে ডাকে। কারণ ‘[অয় তো] পোঁটলার ভিতরথন বাইরইছে, মায়ের প্যাটে হয় নাইকা!’
অন্যদিকে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার গণি জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং ভিক্টোরিয়া পার্কে ‘মব জাস্টিস’ বা গণরায়ে সাজা পায়।
প্রশ্ন হলো, জহির কেন রাজাকার চরিত্র হিসেবে তিনটি গল্পেই একই নামের অবতারণা করেন। এটা কি নিছক খেয়াল, না কাকতালীয় ঘটনা, নাকি সচেতন সিদ্ধান্ত?
উত্তরে জহির আমাদের অস্পষ্টতার পানাপুকুর আরেকটু ঘুলিয়ে দেন। তিনি কাহিনিকথনের চতুর্থ দেয়াল ভেঙে মুখের দিকে দেখি উপন্যাসে এর কৈফিয়ত দেন এই বলে যে ‘রাজাকার কমান্ডারদের নাম আবদুল গণিই হয়’। নামের এই পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি রেজাউল করিমকে জানান, ‘আপনি যখন ছবি দেখতে যান, তখন একই লোক বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে। যেমন ফেরদৌস ও রিয়াজ…আপনি ওই বিভিন্ন চরিত্রেই গ্রহণ করেন।’
জহির কেন রাজাকার হিসেবে আবদুল গণিকেই বেছে নিলেন—এ নিয়ে আমারও একটা অনুভব আছে। জহিরের লেখা অনুবাদ করতে গিয়েই মূলত এই উপলব্ধি।
আমি মনে হয়, রাজাকার চরিত্র হিসেবে আবদুল গণি ও জনতার আদালত হিসেবে ভিক্টোরিয়া পার্ক—এই দুই তথ্যের মধ্যে ১৮৫৭ সালের লালবাগ সিপাহি বিদ্রোহের অস্ফুট আভাস আছে। এসবে উঠে এসেছে মহল্লাকেন্দ্রিক প্রচলিত কেচ্ছাকথন। আর তা লিখিত ইতিহাসকে মৌখিক ইতিহাসের বিপরীতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
সিপাহি বিদ্রোহ হটাতে নবাব গণির ভূমিকা পুরান ঢাকায় মুখে মুখে প্রচারিত। সে বিবেচনায় শহীদুল জহিরের পুরান ঢাকার আখ্যানে রাজাকারের নাম হিসেবে আবদুল গণিই জুতসই।
১৮৫৭ সালে জলপাইগুড়ির ৩৪তম রেজিমেন্টে সিপাহি বিদ্রোহ ঘটলে এর আঁচ ঢাকাতেও এসে লাগে। খবরটি লালবাগের ৭৩তম রেজিমেন্টে পৌঁছে দেয় জলপাইগুড়ির সিপাহিরা। কিন্তু লালবাগে বিদ্রোহের আগুন ঝলসে ওঠার আগেই ইংরেজ নৌসেনারা তা প্রতিহত করে। তারা পরাস্ত সিপাহিদের আন্টাঘর ময়দানের গাছের সারিতে ফাঁসি দেয় এবং জনগণের প্রদর্শনের জন্য বহুদিন ধরে লাশ ঝুলিয়ে রাখে। সে সময় মড়ার গন্ধে মহল্লার লোকেদের পক্ষে ময়দানের পাশ দিয়ে হাঁটাচলা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। সন্ধ্যার পর অনেকেই সে পথে চলাচল করতে ভয় পেত। তাদের অভিযোগ ছিল, গভীর রাতে ময়দান থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে! এমনটাই লিখেছেন হৃদয়নাথ মজুমদার তাঁর স্মৃতিচারণায়। এ রকম নানা কেচ্ছাকাহিনি সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘ফেরারি’ গল্পের চরিত্র খিজির যেমন পাঠককে সতর্ক করে বলে, ‘আমাগো বাপ–দাদায় আমাগো বহুত কইছে, রাইত হইলে ঐ ময়দানের বগলেও ভি যাইবি না।’
সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালে ঢাকার নবাব ছিলেন খাজা আবদুল গণি। তাঁর পিতা খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছ থেকে একটি প্রাসাদ কিনেছিলেন। পরবর্তীকালে গণি সেটি সংস্কার করে পুত্রের নামানুসারে নাম রাখেন ‘আহসান মঞ্জিল’।
নবাব গণির ইংরেজ ভক্তি সর্বজনবিদিত। কথিত আছে, সম্ভাব্য বিদ্রোহের কথা তিনিই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। মুসলিমদের প্রতিনিধি হওয়ায় বিপ্লবীরা তাঁর সঙ্গে সলাপরামর্শ করতেন। ইতিহাসে গণির বিশ্বাসঘাতকতা নথিভুক্ত হয়নি। কিন্তু নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকা, মীজানুর রহমানের ঢাকা পুরাণ ও মুনতাসীর মামুনের হৃদয় নাথের ঢাকা প্রভৃতি গ্রন্থে এসব ঘটনা বা রটনার উল্লেখ রয়েছে।
১৯০১ সালে প্রকাশিত চার্লস এডওয়ার্ড বাকল্যান্ডের বিবরণীমতে, সিপাহি বিদ্রোহকালে নবাব গণি ঢাকাতেই ছিলেন। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর উপস্থিতি ঢাকার অধিবাসীদের ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থা জোগাতে সাহায্য করবে আর কুচক্রীদেরও অনিষ্ট সাধনে বাধা দেবে। ব্রিটিশ সরকারকে হাতি, ঘোড়া, নৌকা, টমটম, এমনকি ঋণ দিয়েও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই নবাব। উল্লেখ্য, ১৮৭০-এর দশকে তিনিই প্রথম ঢাকার রাস্তায় বিজলিবাতি, চাঁদনীঘাটসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।
আবদুল গণির ইউরোপীয় পোশাক-আশাক, বিলাসবহুল বলরুম, রেসের ঘোড়া ও আস্তাবল, ইংরেজ ঘোড়সওয়ার ইত্যাদি দেখে আর্থার লয়েড ক্লে তাঁকে ‘অ্যাঙ্গলিসাইজড নেটিভ’ বলতেন। লোকমুখে শোনা যায়, লালবাগ বিদ্রোহ দমনের পর আবদুল গণি আহসান মঞ্জিল ও রূপলাল হাউসে বল নাচের আয়োজন করেছিলেন ইংরেজদের অভিবাদন জানাতে।
সিপাহি বিদ্রোহ হটাতে নবাব গণির ভূমিকা পুরান ঢাকায় মুখে মুখে প্রচারিত। এসব মহল্লাভিত্তিক মৌখিক ঐতিহ্য বা অলিখিত ইতিহাস। সে বিবেচনায় শহীদুল জহিরের পুরান ঢাকার আখ্যানে রাজাকারের নাম হিসেবে আবদুল গণিই জুতসই। আর জনতার আদালত হিসেবে ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’ও যথাযথ।
রাজাকার গণির গণবিচারের অনুপুঙ্খ বর্ণনা মেলে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায়। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ধরা পড়লে গণিকে ভিক্টোরিয়া পার্কের চত্বরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাকে বেঞ্চির ওপর উপুড় করে শুইয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। তার মাথা থাকে বেঞ্চির বাইরে; মুখের সামনে থাকে মাইক্রোফোন ও স্ট্রসহ ভিটাকোলার বোতল। এরপর লুঙ্গি উঁচিয়ে ভেতরে ঢোকানো হয় এসএলআরের নল। এ নিয়ে উপস্থিত জনতা দ্বিধায় পড়ে যায়, ‘এসএলআরের নলটি রাজাকার আবদুল গণির পাছার ছিদ্রের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না!’ শাস্তির এমন প্রদর্শনী ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ কথাই মনে করিয়ে দেয়। যেন নিয়তির পরিহাস! অথবা পুরান ঢাকার লোকেদের হয়ে লেখকের প্রতিশোধ।
এভাবে ভিক্টোরিয়া পার্ক পরিণত হয় জন–আদালতে। বস্তুত, ব্যক্তিগোষ্ঠী বিশেষে পার্কটির প্রতীকী অর্থ পরিবর্তনশীল। ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য যা ছিল ক্ষমতাবল প্রদর্শনের প্রতীক, স্বদেশিদের জন্য তা ছিল শোকস্থল, আর মহল্লাবাসীর জন্য প্রেতলোক।
যুগে যুগে মালিকানা বদলের সঙ্গে বদলে গেছে এর নামও। আঠারো শতকের শেষভাগজুড়ে এটি আন্টাঘর ময়দান বা আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব হিসেবে পরিচিত ছিল। হিন্দি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় ‘আন্টা’ বা ‘আন্ডা’ হলো ডিম। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষের শাসনভার রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে সোপর্দ হলে এর নাম বদলে হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। পরবর্তী সময়ে প্রায় ১০০ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান আমলে এর নাম পুনরায় বদলে হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
লোকমতে, রানির শাসনামলে নবাব গণির অনুদানে পার্কটি পুনর্নির্মিত হয়। তা সত্ত্বেও জনে জনে তিনি জুডাস হিসেবেই বেশি পরিচিত। শহীদুল জহির তাঁর ঢাকাই উপাখ্যানে এসব মৌখিক ইতিহাসকে প্রচ্ছন্ন প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে আমরা অতীতকে নতুনভাবে নিরীক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। নিঃসন্দেহে, সেসব নিরীক্ষা ‘ন্যারেটিভ মাল্টিপ্লিসিটি’ বা কাহিনিকথনের বহুত্বকে উদ্যাপন করে!