দক্ষিণ আমেরিকার ‘সবচেয়ে ইউরোপীয় শহর’–এর বাসিন্দা ছিলেন যে লেখক
আজ ২৪ আগস্ট আর্জেন্টিনার কালজয়ী লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেসের জন্মদিন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও ছোটগল্পকার। তবে লকডাউনের সময়ে লেখা এই রচনায় সাংবাদিক ক্রিস মস কবি হিসেবেই বোর্হেসকে বেশি চিহ্নিত করেছেন। কেননা, আর্জেন্টনার রাজধানী বুয়েনস এইরেস, যাকে দক্ষিণ আমেরিকার নাকি ‘সবচেয়ে ইউরোপীয় শহর’ হিসেবে চিহ্নত করা হয়, সেই শহরের রাস্তাঘাট নিয়ে বোর্হেসের কবিতাগুলোই তাঁকে বেশি টেনেছে। তাঁর কবিতার সূত্র ধরে বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় একসময় বোর্হেসের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে নতুন এক জগতে প্রবেশ করেছেন ক্রিস মস। এখানে আছে লেখকের কাছে বোর্হেস ছিলেন এক জলজ্যান্ত সেলিব্রেটি, যাঁর ছবি বা পোস্টার রাস্তাঘাটে দেখে তাঁর কাছে মনে হয়েছে, তিনি একজন নায়ক। ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ২৪ মে। বোর্হেসের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত লেখাটি অনুবাদ করেছিলেন তৌকির হোসেন। লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।
লকডাউন আমাকে নস্টালজিক করে তুলেছে। এই নস্টালজিয়া যতটা না ভ্রমণের দিনগুলো নিয়ে, তারচেয়ে বেশি ভ্রমণের স্থানগুলো নিয়ে। এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, যখন সেই স্থানগুলোর মধ্যে থেকে আমার প্রিয়, অম্লমধুর স্মৃতিবিজড়িত রাজধানীর নাম মাথায় আসে—বুয়েনস এইরেস। এই নাম মাথায় আসার পেছনে কারণ অনেক, আর তা ব্যাখ্যা করা একটু জটিল। বুয়েনস এইরেসের অধিবাসীদের বলা হয়ে থাকে পোর্তেনোস। শহরের অধিবাসীদের এই নাম দেওয়া হয়েছিল এমন একটা সময়ে, যখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ ও অভিশাপ এই অঞ্চলে এসে লাগেনি, যখন আর্জেন্টিনা ছিল সম্পদশালী ও সম্ভাবনাময় এবং কল্পনা করা হতো এই অধিবাসীরা সুদূর স্পেন বা ইতালি থেকে এসে এখানে বসবাস করা শুরু করেছে। ট্যাঙ্গোকে ভাবা হতো প্রেমময় ও রহস্যময় কিছু।
আমি সেখানে প্রায় এক যুগের মতো বসবাস করেছি এবং পরবর্তী দুই যুগে প্রতিবছর সেখানে বারবার ফিরে গিয়েছি। এই বারবার ফিরে যাওয়া, হয়তো নস্টালজিয়ার ধার একটু হলেও কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আর্জেন্টাইন রাজধানীর পথেপ্রান্তরে হাঁটাহাঁটি করা, এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, যেকোনো কিছুর চেয়ে আমি খুব বেশি মিস করি। আর এখন, এই আধা গ্রামীণ ইংরেজ ঘরে, আমার মানুষের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে জনমানুষের সমাগম আর তাদের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মুহূর্ত।
আমি বুয়েনস এইরেসের প্রতিটি রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করেছি। জানি, এটা বোকার মতো শোনায়। একজন স্থানীয় লেখকের মতে, বুয়েনস এইরেসে ২ হাজার ১৫৪ টির মতো রাস্তা রয়েছে এবং সেগুলো মিলে কয়েক হাজার মাইলের মতো দূরত্ব তৈরি করে। কিন্তু একজন বিদেশি যদি কোনো শহরকে আপন করে নিতে চায়, তাহলে তার জন্য সেখানে হাঁটা ছাড়া তো আর কোনো গতি নেই। প্রথম যখন আমি লুমি গাইডবুক (রাজধানীর রাস্তাঘাটের মানচিত্র) কিনলাম, সেই মানচিত্রে শত শত রাস্তার ছক আর হিজিবিজি দেখে বেশ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। মানচিত্রে ইংল্যান্ড যেমন মধ্যযুগের দম্ভ নিয়ে, সুপরিকল্পিত রাস্তাঘাটের নকশা নিয়ে সাজানো-গোছানো দেশ হয়ে ভাব ধরে থাকে, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস সেখানে প্রথম দেখায় ছিল একটা ধাঁধার মতো।
ক্রমেই আমি কেন্দ্র থেকে হেঁটে হেঁটে দূরে সরতে থাকি, শহরের সবচেয়ে লম্বা রাস্তা, ২৩ মাইলজুড়ে আভেনিদা রিভাদাভিয়া পার হই, উত্তরের শ্রমিকদের এলাকা সাভেদ্রার দিকে মোড় নিই, পরে দক্ষিণের এল সারের দিকে আগাতে থাকি, যেখানে ট্যাঙ্গোর কথা এখনো শোনা যায়, যে এলাকাকে মলিন মনে হয়, যেন সে জায়গাটা অসম্পূর্ণ কোনো এক দিকে। জনমুখে একটা কথা চালু আছে, এই শহর দক্ষিণ আমেরিকার নাকি ‘সবচেয়ে ইউরোপীয় শহর’। ঘুরেফিরে সেই কথার দিকেই মন চলে যায়। আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক লাতিন আমেরিকান বাস্তবতা: কিছু জায়গায় ঘিঞ্জি, সারি সারি টিনের পুরোনো বাড়ি, কিছু জায়গায় আবার কাচঘেরা বারান্দার শৌখিন আবাস এবং তাদের ওপরে মাথা উঁচু করে থাকা আমেরিকান আধুনিক অট্টালিকা। এই নতুন-পুরোনো, মলিন-অমলিন, সুন্দর-অসুন্দরের পাশাপাশি নির্লিপ্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেও একধরনের মোহ কাজ করে।
শহরের গাইড বই আমার কল্পনার রস জোগাতে পারে না। আমার বরং স্থানীয় কাউকে দরকার হয়, যিনি আমাকে এই নগরীর ধাঁধার জট খোলার রাস্তাটা দেখাবেন। আমি এমন একজনকে পেয়েও যাই, যাঁকে কিনা আর্জেন্টিনার বাইরে রহস্য ও হেঁয়ালির গুরু মানা হয়।
হোর্হে লুইস বোর্হেসের সান্নিধ্যে আমি প্রথম আসি টিনএজ বয়সে, তাঁর ‘দ্য বুক অব ইমাজিনারি বিয়িংস’ বইয়ের কল্যাণে। শুধু সাহিত্যগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেই নয়, বরং বলা চলে এইরেসের প্রায় সর্বত্র বোর্হেসের নাম প্রায়ই উচ্চারিত হয়। এমিসি প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বোহের্সের রচনাসমগ্র দৃষ্টিনন্দনীয় হার্ডকভারে শহরের বইয়ের দোকানগুলোয় ‘আর্জেন্টাইন সাহিত্য’ সেকশনে একেবারে চোখে পড়ার মতো জায়গায় গর্বভরে দাঁড়িয়ে থাকে। পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবি এখনো হরদম দেখা যায় সময়ে-অসময়ে। শহরের শপিং সেন্টারের একটা কোনায় তাঁর নামযুক্ত শিল্পকেন্দ্র প্রতিদিন অপেক্ষা করে দর্শনার্থীর জন্য।
বোর্হেস অবশ্য তাঁর ছোটগল্পের জন্যই সবচেয়ে পরিচিত। কিন্তু তাঁর কবিতাই বরং আমার এইরেস যাপনে ছন্দ জোগায়। নিদেনপক্ষে তাঁর কবিতা, সেখানকার চারপাশের আবহে যে অন্তরীণ জটিলতা রয়েছে, তা বুঝতে আমাকে সাহায্য করে। তাঁর ‘দ্য স্ট্রিটস’ কবিতার শুরুর লাইনের কথা মনে পড়ে যায়। কবিতাটা বেরিয়েছিল ১৯২৩ সালের প্রথম কবিতাসংগ্রহে, বুয়েনস এইরেসে তখন বেশ গরম পড়ছে। লাইনটা এমন, ‘আমার আত্মা এই রাস্তায়/এই বুয়েনস এইরেসে’। এই কবিতা বলে, কীভাবে বোর্হেস নিজেকে শুধু শহরের কেন্দ্রের সঙ্গেই নয়, বরং ‘প্রতিবেশী ঘটনাহীন রাস্তাগুলোরও একই সঙ্গে চেনান, খুঁজে পান’।
বুয়েনস এইরেস, বোর্হেসের কবিতাকে অর্থবহ করে তোলে। যেটা আদতে শহরটাকেই বুঝতে সাহায্য করে। এখন, অনেক অনেক বছর পর এবং এক সমুদ্র দূরে, এই করোনাভাইরাস আরোপিত অদ্ভুত নস্টালজিয়ার ভেতর দিয়ে আমি তার কবিতাগুলো আবার পড়ি এবং আবার শহরটাকে দেখতে পাই, সময় আর স্মৃতির ভাঁজের মধ্য দিয়ে।
আরবিজাত শব্দ ব্যবহার করতেন বোর্হেস, যা থেকে মনে পড়ে যায় আন্দালুসিয়ার কথা। বোর্হেসের চোখ দিয়ে আমি দেখি একটা পুরোনো পৃথিবী কীভাবে আবার নতুন হয়ে ধরা দিচ্ছে। ‘এল পাসিও’ নামের এক কবিতায় কীভাবে একটা মামুলি আঙিনা হয়ে যাচ্ছে ‘বেহেশতে প্রবাহিত হয়ে চলা নদী, যার ঢাল দিয়ে আসমান বাড়ির ভেতরে হানা দেয়’। বোর্হেস সিরিয়াস ধরনের এক পথিক ছিলেন, যাঁর মহাকাব্যিক পরিভ্রমণের আখ্যান শুনে মনে হয় আধুনিক কোনো এক মনোভূগোলবিদের কথা শুনছি। তিনি লিখছেন, কাবালিতো, পম্পাই ও অর্তুজার ভিলার মতো পর্যটকমুক্ত মফস্বল এলাকার ‘ (সাধারণ) এই মেটে বাদামি রঙা বাড়ি, এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে যাওয়া সিঁড়ি, কলবেলের আওয়াজ’, সন্ধ্যার ধূসর আলোয় মনে হয় ‘কবিতার মতোই রঙিন, আলোকিত’। একেবারে সাধারণ রাস্তাগুলোও বোর্হেসের কাছে হয়ে ওঠে কবিতার মতো মহান আর উদার।
বোর্হেসের দ্বিতীয় কবিতাসংগ্রহের নাম ‘মুন অ্যাক্রস দ্য ওয়ে’ (১৯২৫), যার মাধ্যমে তিনি ধরতে চেয়েছেন এইরেসের ক্রমে পশ্চিম দিকে বিস্তৃত হওয়ার কাব্যিক নিশান। তখন রিভার প্লেট নদীর মোহনা পেরিয়ে এইরেস এগিয়ে যাচ্ছে আরও পশ্চিমে। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এলাকার ধার দিয়ে হেঁটে গেলে একটা সময় লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর চোখের সমুখে উন্মুখ হয়ে পড়ে। তাঁর পরবর্তী সংগ্রহ ‘সান মার্টিন কপিবুক’–এ (১৯২৯) এমনই এক সুন্দর, প্রায়ই-উক্ত হওয়া কবিতা ‘দ্য মিথিকাল ফাউন্ডেশন অব বুয়েনস এইরেস’ শেষ হয় এভাবে:
একটা সিগার-স্টোরের সুবাস এই মরুভূমিতে হয়ে ওঠে
গোলাপের ঘ্রাণ।
একটা বিকালবেলা মনে করিয়ে দেয় গত হয়ে যাওয়া দিন,
আর কজন পুরুষের মন ভারী হয়ে ওঠে অতীতের মায়ায়।
কেবল একটা জিনিসেরই অভাব—
এই রাস্তার আর অন্য কোনো দিক নেই।
বিশ্বাস করা শক্ত, বুয়েনস এইরেসের শুরু বলেও কিছু আছে;
বরং অনুভূত হয়, এই এইরেস হাওয়া-জলের মতোই অনন্তকাল ধরে
প্রবহমান—বয়ে চলছে।
অন্য অনেক শহরবাসীর মতোই, অতীতে যা যা ছিল এবং যা এখন আর নেই, সেই নেই হয়ে যাওয়ার স্মৃতি নিয়ে বোর্হেস আক্ষেপ করছেন, ‘আমাদের কাছে আমাদের শহরের যে ছবি রয়েছে, তা এখন সব সময়ই পুরোনো, অনেক পুরোনো মনে হয়। ক্যাফেগুলো পানশালা হয়ে গেছে; আগেকার বিশালাকার তোরণের মতো দরজাগুলোয় আঙুরলতা ঝুলে থাকত, আবার বড় দরজায় গ্রিল দেওয়া একটা ছোট দরজাও থাকত। এখন সেই দরজার বদলে বরং একটা মলিন করিডর শুরু হয়, যেটা একটা এলিভেটরের সামনে গিয়ে শেষ হয়।’
ক্রিস মস
ক্রিস মস
এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময়, সব সময় আমার চোখ পুরোনো কিছু খুঁজে ফেরে। পুরোনো, ঝুলে পড়ে যাচ্ছে, বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে—এ রকম কিছু যা কোনো সুদূর অতীতের স্বাক্ষর বহন করে। এই রকম পুরোনো ল্যান্ডস্কেপ দেখার ইচ্ছা, হয়তো আমার বিদেশি হওয়ার কারণে এসেছে। কিন্তু এ-ও তো সত্য, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়তো একটু একটু করে পোর্তেনোই হয়ে উঠছি বরং, যার কারণে আমি খুঁজে পেতে চাই অতীতকে, কল্পনাকে কিংবা যেসব একটা সময় সত্য ছিল, সেসবকে।
বোর্হেস তাঁর গল্পের মতোই ধ্রুপদি ইশারায় আর কল্পনার ধ্যানে তাঁর কবিতাকে ভরিয়ে তোলেন। বুয়েনস এইরেসকে একটা ধাঁধার মতো কল্পনা করায়, বোর্হেসকে মনে হয় যেন কোনো এক গোয়েন্দা, যিনি ৫০০ বছর পুরোনো শহরকে যেকোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের মতোই রহস্যময়, আকর্ষণীয় করে তুলছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন নগরীর সেই অতীত-স্বরূপের খোঁজে।
একটা বড় শহরে ঘুরে বেড়ানো আত্মার জন্য আশীর্বাদের মতোই। উনিশ শতকের কবি এভারিস্তো ক্যারিগোর (১৯৩০) ওপর লেখা একটা ছোট প্রবন্ধে, বোর্হেস লিখছেন, ‘বুয়েনস এইরেস গভীর সমুদ্রের মতো। কখনোই আমি এর রাস্তাসমূহে হেঁটে বেড়াতে গিয়ে বিরক্ত কিংবা প্রতারিত হইনি, বরং সব সময়ই এই হেঁটে বেড়ানো আমাকে নির্ভার করেছে, শান্তি দিয়েছে। এই শান্তি হয়তো পরাবাস্তব বোধ থেকে আসা, কিংবা পেছনের কোনো বারান্দার গিটারের সুর থেকে ভেসে আসা, অথবা অন্যান্য জীবনের সংস্পর্শ থেকে পাওয়া।’
বুয়েনস এইরেস, বোর্হেসের কবিতাকে অর্থবহ করে তোলে। যেটা আদতে শহরটাকেই বুঝতে সাহায্য করে। এখন, অনেক অনেক বছর পর এবং এক সমুদ্র দূরে, এই করোনাভাইরাস আরোপিত অদ্ভুত নস্টালজিয়ার ভেতর দিয়ে আমি তার কবিতাগুলো আবার পড়ি এবং আবার শহরটাকে দেখতে পাই, সময় আর স্মৃতির ভাঁজের মধ্য দিয়ে। যে শহরে বোর্হেস আমাকে পথ দেখান, তাঁর কবিতা ও শব্দের আলোয়। যেখানে একেকটা পায়ের চিহ্ন তাঁর শব্দ আর হেঁটে বেড়ানো তাঁর কবিতা।