লালন থেকে নেওয়া
>লালন সাঁইয়ের জীবনী সে অর্থে খুব একটা জানা যায় না। লালনের ওপর কয়েক প্রামাণ্য বই ঘেঁটে তাঁর জীবনের কয়েকটি বিশেষ ঘটনার কথা জানাচ্ছেন সুমনকুমার দাশ।
‘লালন কী জাত সংসারে’
লালন হিন্দু না মুসলমান ছিলেন, এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কম তর্ক-বিতর্ক হয়নি। এখনো সেটি চলছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন-জীবনীকার বসন্তকুমার পাল, গবেষক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা এই বাউল কবিকে হিন্দু পরিবারের সন্তান বলেই উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, কবি জসীমউদ্দীন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন প্রমুখ লেখকেরা লালনকে ‘ধর্মান্তরিত মুসলমান’ বলে মতামত দিয়েছেন। তবে মজার বিষয় হলো, নিজের একটি গানে লালন লিখেছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জেতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ লালনের মৃত্যুর পর, ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে, ‘লালন নিজে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না; অথচ সকল ধর্মের লোকেই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।’
‘পোনা মাছের ঝাঁক’
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় নিজের আখড়ায় শিষ্য-পার্শ্বচরদের নিয়ে জীবন যাপন করতেন লালন। ‘অধর মানুষ’-এর সন্ধানে সাধনপথে তাঁর ছিল নিরন্তর পথচলা। বিষয়াসক্তি কিংবা জাগতিক সমস্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। যখন মনের ভাব প্রবল বেগে জেগে উঠত, তখনই কেবল তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘ওরে, আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’। অর্থাৎ তাঁর ভেতরে গানের পঙ্ক্তি ঘুরপাক করছে। এ কথা শোনামাত্রই সাঁইজির আশপাশে ছুটে আসতেন শিষ্যরা। লালন তখন ভাবের আবেশে গান ধরতেন। শিষ্যরাও লালনের সঙ্গে তাল মেলাতেন। সময়-অসময়ে তাঁর এমন ‘পোনা মাছের ঝাঁক’ আসত।
রবীন্দ্রনাথ ও লালন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন সাঁইজির মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে কি না, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেছে। পক্ষে-বিপক্ষে উভয় মতই প্রচলিত রয়েছে। কারও ধারণা, দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। অন্যপক্ষের মত, দেখা হওয়ার সপক্ষে প্রামাণ্য কোনো দলিল-দস্তাবেজ নেই। কিছু গবেষক অবশ্য এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, রবীন্দ্র-সহোদর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালনের সাক্ষাৎ হয়েছে এবং তিনি তখন লালনের একটি স্কেচও এঁকেছিলেন। তবে এই দুই কিংবদন্তি পুরুষের সাক্ষাৎ হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে যে লালন সারস্বত সমাজে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন, তা কিন্তু মিথ্যা নয়। জমিদারি পরিচালনার সূত্রে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে আসা। সে সুবাদেই লালনের গান সম্পর্কে প্রথম অবহিত হন তিনি। এরপর রবীন্দ্রনাথ ১৩১৪ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত গোরা উপন্যাসে ব্যবহার করেন লালনের গান। ১৯২৫ সাল থেকে বিভিন্ন অভিভাষণেও রবীন্দ্রনাথ লালনের গান উদ্ধৃত করেন। শুধু তা–ই নয়, ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন থেকে মাঘ অবধি চার কিস্তিতে প্রবাসী পত্রিকায় লালনের ২০টি গান প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ।
‘আমি চলিলাম’
লালন সাঁই জীবিত ছিলেন ১১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। শেষ বয়সেও ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন। মারা যাওয়ার এক মাস আগে তাঁর পেটের পীড়া হয়। তখন পানি জমে হাত-পা ফুলে যায় তাঁর। সে সময় দুধ ছাড়া তিনি অন্য কোনো খাবার খেতেন না। তবে খাবারের পাতে মাঝেমধ্যে মাছ চাইতেন। অসুস্থাবস্থায়ও শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। সে সময়টাতে বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন লালন। মৃত্যুর আগের দিন ভোররাত পর্যন্ত গান শুনেছেন। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে শিষ্যদের ডেকে বলেছেন, ‘আমি চলিলাম।’ এর কিছুক্ষণ পরই মারা যান লালন।
সূত্র: শ্রীবসন্তকুমার পালের মহাত্মা লালন ফকির, আবুল আহসান চৌধুরীর লালন সাঁই: মরমি ও দ্রোহী ও লালনসমগ্র এবং অন্নদাশঙ্কর রায়ের লালন ফকির ও তাঁর গান।