>ডা. আলীম চৌধুরী যুক্তরাজ্যের লন্ডনে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা একাডেমি। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলায় ছিল এই একাডেমি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। নিজের ডায়েরিতে একাডেমির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি িনয়ে তিনি একটি খসড়া তৈরি করেন। তারই একটি অংশ এটি। তাঁর পারিবারিকভাবে বলা হয়েছে, এই ডায়েরিটি ১৯৫৯ সালে লেখা।
লন্ডনে বাংলা ভাষাভাষী প্রবাসী পাকিস্তানিদের একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা বহুদিন থেকেই অনুভূত হচ্ছিল। কিছুদিন আগে আমরা কয়েকজন এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজে হাত দিই। প্রাথমিক প্রস্তুতিকাজ শেষ হলে উদ্যোক্তাদের এক বৈঠকে বাংলা একাডেমি গঠন করা হয়। একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকেই আজকের এই উদ্বোধনী সভা আহ্বান করা হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানিদের মাতৃভাষাপ্রীতি সর্বজনবিদিত। বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। প্রাণ দিয়ে আমরা তা প্রমাণ করেছি। দেশের বাইরে এসেও মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দরদ যে বিন্দুমাত্র কমেনি, আজকের এই মহতী সভাই তার প্রমাণ। এই ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানির কাছ থেকে আমরা যে পরিমাণ সাড়া পেয়েছি, তা উদ্যোক্তাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
উদ্দেশ্য
উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে এটি হচ্ছে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি পাকিস্তানিদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্র। এর উদ্দেশ্য প্রধানত শিক্ষামূলক। আমরা নিয়মিতভাবে সাহিত্য–সভা, বিতর্ক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করব। একাডেমির অংশ হিসেবে বাংলা বই দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকায় সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার থাকবে। আমরা একটি বাংলা সংকলন বের করব বলে আশা করছি। পরে সম্ভবপর হলে একটি সাহিত্য পত্রিকাও বের করা হবে।
একাডেমির পক্ষ থেকে আপনাদের চিত্তবিনোদনের জন্য মাঝেমধ্যে বাংলা গানের আসর, নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। এ ছাড়া প্রবাসী জীবনের নির্জনতা ও একঘেয়েমি দূর করার উদ্দেশ্যে এখানে অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা যেমন: ক্যারম, দাবা, তাস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হবে।
কর্মসূচি
একাডেমির মূল কয়েকটি বিভাগ থাকবে যেমন সাহিত্য শাখা, পাঠচক্র, পাঠাগার বিভাগ, প্রমোদ বিভাগ ইত্যাদি। এই বিভাগগুলোই বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাডেমির কাজ পরিচালনা করবে। যেমন সাহিত্য শাখা সাহিত্য সভার অনুষ্ঠান, বাংলা সংকলন ও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। পাঠাগার বিভাগ পাঠাগার পরিচালনা করবে। প্রমোদ বিভাগের কাজ হবে নির্দোষ আমোদ–প্রমোদের ব্যবস্থা করার, যা না হলে সবকিছুই অচল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো আর্থিক বিভাগ। এরা একাডেমির জন্য অর্থ সংগ্রহ করবে এবং হিসাব–নিকাশ রাখবে। আমরা আশা করছি, যাঁর যে বিষয়ে দক্ষতা আছে, তাঁরা এগিয়ে এসে এই বিভাগগুলোকে গড়ে তুলতে সাহায্য করবেন।
এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা সম্বন্ধে বেশি বলার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু কয়েকটি দিকের প্রতি ইঙ্গিত করব।
আমাদের মতো অনুন্নত দেশের লোকদের বিদেশে আসার একটা মস্ত বড় উপকারিতা হলো, নিজের দেশের ও সমাজের দৈন্য সহজেই চোখে পড়ে। আর পাঁচটা উন্নত দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে আমরা এখনো কত পেছনে পড়ে আছি। অশিক্ষা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি সামাজিক অনুশাসন জাতীয় জীবনে একটি স্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই অচল অবস্থার অবসান করা গুটি কয়েক লোকের পক্ষে সম্ভবপর নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই শুধু দেশের উন্নতি সম্ভবপর। এই ব্যাপারে আজ আমরা যারা এখানে সমবেত হয়েছি, তাদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের অনেকেই হয়তো দেশে ফিরে গিয়ে সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবেন। যে দেশের শিক্ষিত লোকের সংখ্যা শতকরা মাত্র... (অস্পষ্ট) জন, সেখানে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে শিক্ষিত সমাজের দায়িত্ব অপরিসীম। দেশের কাজে হাত দেওয়ার আগে সর্বাগ্রে জানা প্রয়োজন যে দেশের সমস্যাগুলো কী এবং কী তার প্রতিকার। পড়াশোনা ও আলোচনার মাধ্যমে দেশের সমস্যাগুলো বুঝতে হবে এবং প্রতিকারের উপায় বের করতে হবে আমাদেরই। সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে আমরা যাতে দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারি, সেভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। আমরা আপনাদের কাছে একাডেমি তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করার আবেদন করছি।
সাংগঠনিক কমিটি আজ থেকে সদস্য সংগ্রহের কাজ শুরু করছে। কমপক্ষে এক পাউন্ড দিলে আপনারা প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হতে পারবেন। তবে আমরা আশা করছি অনেকেই এর চেয়ে বেশি দেবেন। সাংগঠনিক কমিটি একাডেমির জন্য একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের সমবায়ে গঠিত একাডেমি পরিষদের সামনে পেশ করবেন। গঠনতন্ত্র তৈরি হলে পরিষদের সভায় নতুন কমিটি নির্বাচিত হবে। আমাদের রসিদ বই এখনো ছাপা হয়নি। আজ যাঁরা সদস্য হবেন, তাঁদের রসিদ আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেব।
এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলে আমি আমার কর্তব্যে অবহেলা করব। শওকত আলীর সাহায্যের ফলেই এত অল্প সময়ের মধ্যে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। আপনারা অনেকে হয়তো জানেন যে আজ আমরা যেখানে সমবেত হয়েছি, এ ঘরটি তাঁরই। এ ছাড়া পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য করছেন। শওকত আলীর এই বদান্যতা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। এ ছাড়া অন্য যে বন্ধুরা আমাদের এই ব্যাপারে সাহায্য করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
স্থানাভাবে ও ঠিকানা সংগ্রহ না করতে পেরে আমরা অনেককে আজকের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি বলে দুঃখিত। আশা করি ভবিষ্যতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হব। আজকের সভায় যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁদের কাছে এই খবরটা পৌঁছে দিতে আপনাদের অনুরোধ করব।
সংক্ষেপিত
এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী
এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালে। ১৯৪৮ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি, ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি এবং ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে ডিপ্লোমা ইন অপথালমোলজি ডিগ্রি লাভ করেন। চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন এবং তাঁদের জন্য ওষুধ সরবরাহ করতেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।