২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মোনালিসা নিয়ে যত কাণ্ড

>

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর চিত্রকর্ম মোনালিসাকে ঘিরে কাণ্ডের শেষ নেই। এই তো কদিন আগেই জানা গেল, ছবিটি আঁকার আগে মূর্ছা গিয়েছিলেন শিল্পী। মোনালিসাকে কেন্দ্র করে একের পর এক ঘটে চলেছে যে বিস্তর ঘটনা, বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে ফিরে দেখা হয়েছে সেগুলোর দিকে।

লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা। এটি  অাঁকা হয়েছিল ১৫০৩ সাল থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে।
লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা। এটি অাঁকা হয়েছিল ১৫০৩ সাল থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে।


মোনালিসার আগে মূর্ছা
বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’ ও এর স্রষ্টা লেওনার্দো দা ভিঞ্চিকে নিয়ে গবেষণা চলছেই। ৪ মে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ এক তথ্য। ধারণা করা হচ্ছে, মোনালিসার অঙ্কনকর্ম সম্পন্ন করার আগে মূর্ছা গিয়েছিলেন লেওনার্দো দা ভিঞ্চি! শুধু তা-ই নয়, প্রথম দিকে ভিঞ্চি ডান হাতেই ছবি আঁকতেন, কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি হয়ে যান বামহাতি।

রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিন জার্নাল-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে উঠে এসেছে এমন সব তথ্য। রোমের ভিলা সালারিয়া ক্লিনিকের চিকিৎসক ও গবেষক ড. ডেভিট লাজেরি বলেন, ভিঞ্চি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ দিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছিলেন। তখন তাঁর শরীরের ডান দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভিঞ্চির একটি প্রতিকৃতিতে দেখা যায়, তাঁর ডান হাত কাপড়ে মোড়ানো এবং সম্ভবত ব্যান্ডেজ করা। এ থেকে বোঝা যায়, ডান হাতে রংতুলি ধরা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন থেকে তিনি মূলত বাম হাতে আঁকার চর্চা শুরু করেন।

ঠিক কোন সময়ে ভিঞ্চি মোনলিসা আঁকা শুরু করেছিলেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে গবেষকরা ধারণা করছেন, ১৫০৩ সাল থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে ছবিটি এঁকেছিলেন তিনি। ভিঞ্চির ডান হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৫০৫ সালে। যে কারণে মোনালিসার অঙ্কন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে বলে গবেষকদের ধারণা।

১৫১৬–তে ৬৪ বছর বয়সে ভিঞ্চি যখন ইতালি থেকে ফ্রান্সে আসেন, সে সময় ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস মাত্র চার হাজার সোনার মুদ্রার বিনিময়ে ভিঞ্চির কাছ থেকে সংগ্রহ করেন মোনালিসাকে। রাখেন ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদে। এরপর প্রথম ফ্রান্সিসের জামাতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মোনালিসাকে নিয়ে যান টুইলিরাইসে, নিজের শয়নকক্ষে। ১৮২১ সালে নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর ছবিটি উপহার দেওয়া হয় লুভর জাদুঘরকে। সেই থেকে মোনালিসা লুভর জাদুঘরেই আছে। মাঝে ১৯১১ সালে লুভর থেকে একবার চুরি হয়েছিল মোনালিসা। সেটা অবশ্য ভিন্ন কাহিনি। সে কাহিনিতে প্রবেশের আগে একবার ঘুরে আসা যাক বিশ্বখ্যাত মোনালিসার বিখ্যাত হাসির ভুবনে।

সে হাসি রহস্যময়…

কেউ বলেন বিষাদের হাসি, কেউ বলেন আনন্দের হাসি। কেউ বলেন ইচ্ছাকৃত, আবার কেউ বলেন অনিচ্ছাকৃত। মোনালিসার হাসি নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। নেই মতভেদেরও অন্ত। জানা যায়, যে বছরগুলোতে দা ভিঞ্চি মোনালিসার হাসি ফুটিয়ে তুলছিলেন, সেই বছরগুলোতে তিনি রাত কাটাতেন তাঁর ফ্লোরেন্স স্টুডিওর কাছের একটি হাসপাতালে। তখন তিনি পড়াশোনা করেছেন মানুষের ত্বক, পেশি ও স্নায়ু নিয়ে। এসব পড়াশোনার প্রভাব পড়েছে মোনালিসার ওপর। হাসির সময় মানুষের মুখের প্রতিটি পেশি কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, পেশিগুলো কীভাবে নড়াচড়া করে, সেসব বিশ্লেষণ মোনালিসার হাসিতে ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন গবেষকেরা।

গবেষকদের এমন মনে করার পেছনে যুক্তির রসদ জুগিয়েছে খোদ ভিঞ্চিরই নোটবই। ভিঞ্চি যখন মারা যান, তখন এ চিত্রকরের লেখা প্রায় ছয় হাজার পাতার একটি নোটবই উদ্ধার করেছিলেন গবেষকেরা। সেই নোটবইয়ে দেখা যায়, পাতার পর পাতা অসংখ্য স্কেচ। সেসব স্কেচের কোনোটার নাম দিয়েছেন ক্রোধের পেশি, কোনোটার নাম বিষণ্নতার পেশি। ক্রোধের পেশিকে আবার তুলনা করেছেন ঘোড়ার মুখের সঙ্গে।

মোনালিসার হাসি সম্পর্কে গবেষকেরা বলছেন, এটাই মানুষের হাসি সম্পর্কে প্রথম ড্রয়িং। যদিও মুখের শেষ দিকের সূক্ষ্ম লাইনগুলো অসম্পূর্ণ থাকে, তবু মনে হয় ঠোঁট হাসছে।

কেন এমন মনে হয়, তার ব্যাখ্যা মিলেছে আরেক বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। সেখানে জোর দেওয়া হয়েছে অপটিক্সের ওপর। বলা হয়ে থাকে, লেওনার্দো বুঝতে পেরেছিলেন, আলোকরশ্মি চোখের মধ্যে কোনো এক নির্দিষ্ট জায়গায় পড়ে না। এটা পড়ে সমগ্র রেটিনার ওপর। এই ধারণা নিয়ে ভিঞ্চি এই রহস্যজনক হাসি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মোনালিসার ঠোঁটের কোণের হাসির সূক্ষ্ম লাইনগুলো অনেক ধীর বা মন্থর। যদি সরাসরি মোনালিসার দিকে তাকানো হয়, তাহলে রেটিনার ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম বিবরণগুলো ধরে রাখে। যাতে মনে হয় না তিনি হাসছেন। কিন্তু যদি চোখ একটু এদিক-সেদিক, যেমন গালে বা ছবির অন্যদিকে রাখা হয়, তাহলে ছবিটি আবার অন্য রকমভাবে ধরা পড়ে। তখন দেখা যায়, তার ঠোঁট হাসছে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের স্নায়ুবিজ্ঞানী মার্গারেট লিভিংস্টোন বলেছেন, ‘উচ্চ স্পেসিক ফ্রিকোয়েন্সি ইমেজের চেয়ে কম স্পেসিক ফ্রিকোয়েন্সি ইমেজগুলোতে হাসি অনেক বেশি স্পষ্ট।’ তাই আপনি যদি পেইন্টিংয়ে মোনালিসার ছবির অন্য কোনো দিকে তাকান, তাহলে হাসি অনেক বেশি স্পষ্ট হয়।

মোনালিসার নগ্ন স্কেচ

বছর দুয়েক আগে ২০১৭ সালে মোনালিসার একটি নগ্ন স্কেচ পাওয়া যায় ফ্রান্সের প্যারিসের একটি শিল্প সংগ্রহশালায়। ১৮৬২ সাল থেকে প্যারিসের উত্তরের শ্যান্তিলে প্রাসাদে অবস্থিত কনডে জাদুঘরে রেনেসাঁ যুগের শিল্প সংগ্রহশালার মধ্যে পড়ে ছিল এটি।

কাঠ-কয়লা দিয়ে আঁকা প্রায় দেড় শ বছর আগের নগ্ন সেই চিত্রকর্ম উদ্ধারের পর বিরাট ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা। চিত্রকর্মটি প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘরে নিয়ে পরীক্ষার পর কিউরেটররা জানান, এর কিছুটা হলেও ভিঞ্চির আঁকা। অথচ দেড় শ বছর ধরে ভাবা হতো, ছবিটি ভিঞ্চির স্টুডিওর কোনো শিক্ষানবিশ শিল্পীর আঁকা একটি চিত্রকর্ম মাত্র!

জাদুঘরটির কিউরেটর ম্যাথিউ দেলদিকে বলেন, স্কেচটি যে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির নিজের আঁকা, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘যেভাবে এই স্কেচে মুখ ও হাতের অংশটি আঁকা হয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। এটা অবশ্যই কোনো সাধারণ চিত্রকর্ম নয়। ছবিটি আঁকা হয়েছে ভিঞ্চির জীবনের শেষভাগে। তবে এটি দেখে মনে হয়, মূল চিত্রকর্মটি আঁকার প্রস্তুতি হিসেবে ভিঞ্চি এই স্কেচ এঁকেছিলেন।’ যত দূর সম্ভব, তৈলচিত্রের জন্য এটি প্রস্তুতিমূলক একটি কাজ বলেও মনে করেন ম্যাথিউ।

ভিনসেনজো পেরুগিয়া, ১৯১১ সালে মোনালিসার ছবিটি চুরি করেছিলেন তিনি।
ভিনসেনজো পেরুগিয়া, ১৯১১ সালে মোনালিসার ছবিটি চুরি করেছিলেন তিনি।


চুরি হয়েছিল মোনালিসা
দিনটি ছিল সোমবার। ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট। ভোরের আবছায়া কাটেনি তখনো। বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের ভেতরে রাখা এক আলিমারি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। জাদুঘরের দেয়াল থেকে ফ্রেমে আঁটা মোনালিসাকে নামালেন। তারপর ফ্রেম থেকে ছবিটি খুলে নিজের ওভারকোট দিয়ে মুড়ে বেরিয়ে গেলেন ল্যুভর থেকে। টের পেল না কাকপক্ষীও!

এভাবেই ল্যুভর থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল বিশ্বখ্যাত মোনালিসা। পরদিন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে খবর, চুরি হয়ে গেছে মোনালিসা! তৎপর হয়ে ওঠে ফরাসি প্রশাসন, যেভাবেই হোক উদ্ধার করতে হবে মোনালিসাকে। তদন্ত, তদন্ত। একসময় পুলিশের সন্দেহের তালিকায় উঠে আসে আরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর নাম। সন্দেহ করা হয় বিখ্যাত কবি গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ারকেও। আদালতে হাজির করা হয় এই দুই বিখ্যাত ব্যক্তিকে। অতঃপর অনেক জল ঘোলা হয়। শেষে প্রমাণিত হয় যে মোনালিসা চুরির সঙ্গে জড়িত নন এই দুজন।

তারপর মোটামুটি সবাই ধরে নেয় যে চিরকালের জন্য চুরি হয়ে গেছে মোনালিসা। তাকে বোধ হয় আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। ঠিক তখনই খোঁজ মেলে মোনালিসার।

১৯১৩ সালের নভেম্বর মাস। জানা যায়, ভিনসেনজো পেরুগিয়া নামে ল্যুভরে একজন কর্মচারী ছিলেন। তিনি কাজের শেষে জাদুঘরের ভেতর ঝাড়ু রাখার আলমারিতে লুকিয়ে পড়েছিলেন এবং পরদিন ভোরবেলা মোনালিসাকে তাঁর কোটের নিচে লুকিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। দিনটি ছিল ২১ আগস্ট ১৯১১, সোমবার, ভোরবেলা।

পরে আদালতে হাজির করা হয় পেরুগিয়াকে। আদালতে তিনি বলেন, যেহেতু ভিঞ্চি ইতালীয় নাগরিক ছিলেন, তাই মোনালিসা ইতালির সম্পত্তি। ভিনসেনজোর স্বপ্ন ছিল, ইতালির সম্পত্তিকে ইতালিতে পাঠানো। তাই তিনি চুরি করেছিলেন এই চিত্রকর্ম। বিচারে এক বছরের জেল হয় ভিনসেনজোর। আর মোনালিসাকে ফিরিয়ে আনা হয় ফ্রান্সের ল্যুভরে, ১৯১৩ সালেই।

কিন্তু শাস্তি পেলে কী হবে, ইতালিতে ঠিকই ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে আখ্যা পান মোনালিসা চুরির নায়ক ভিনসেনজো পেরুগিয়া।

সূত্র: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিন, ফোর্বস ম্যাগাজিন ও দ্য গার্ডিয়ান

ভিঞ্চির নোটবুক। এই নোটবুকে তিনি এঁকেছিলেন মোনালিসার অনেক স্কেচ, লিখেছিলেন অনেক তথ্য।
ভিঞ্চির নোটবুক। এই নোটবুকে তিনি এঁকেছিলেন মোনালিসার অনেক স্কেচ, লিখেছিলেন অনেক তথ্য।


জানা–অজানার মোনালিসা

মোনালিসা চিত্রকর্মটির নামের বানান ভুল। চিত্রকর্মটির আসল নাম ছিল Monna Lisa। ইতালিয়ান Madonna শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে Monna, এর অর্থ ‘আমার সহধর্মিণী’।

মোনালিসার পরিচয় সম্পর্কে এখনো রহস্য আছে। অনেক গবেষকের মতে, এটি লেওনার্দোর নিজের মহিলা সংস্করণ। আবার অনেকের মতে, নারীটির নাম লিসা ঘিরারদিনি, যাঁর বয়স ছিল ২৪ বছর এবং তিনি দুই সন্তানের জননী ছিলেন।
ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান তাঁর ঘরে মোনালিসার চিত্রকর্মটি লাগিয়ে ছিলেন। লিসা ঘিরারদিনির বংশধর তেরেসা ঘিরারদিনি নামের সুন্দরী ইতালিয়ান রমণীকে ভালোবাসতেন তিনি।
মোনালিসার কোনো ভ্রু নেই। গুজব আছে যে চিত্রকর্মটি সংরক্ষণের সময় ঘটনাক্রমে ভ্রু মুছে গেছে। এ ছাড়া অন্য আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে, ভিঞ্চি চিত্রকর্মটির আঁকা শেষ করেননি।
মোনালিসাতে একটি খুঁত আছে। ১৯৫৬ সালে উগো উনগাজা নামের এক ব্যক্তি ছবিটির ওপর একটি পাথর ছুড়ে মারেন। এতে মোনালিসার বাম কনুইয়ে ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
মোনালিসাকে ফ্রান্সের ল্যুভর জাদুঘরের একটি আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছে, যার জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত করা আছে এবং ছবিটি বুলেটপ্রুফ কাচ দিয়ে ঢাকা একটি খাপের মধ্যে রাখা আছে। কক্ষটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে ৭ মিলিয়ন ডলার।
গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে যে বর্তমান সংস্করণটির আগে ছবিটি তিনটি আলাদা স্তরে আঁকা হয়েছিল। একটি সংস্করণে মোনালিসার হাত দুটো তার সামনে রাখা একটি চেয়ারের ওপর দিয়ে জড়িয়ে আছে।
সূত্র: মেন্টালফ্লস