>বই হিসেবে প্রকাশের জন্য নিজের একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি প্রথমা প্রকাশনকে দিয়েছিলেন আমজাদ হোসেন। সেই সূত্রে মাঝেমধ্যেই আসতেন প্রথমার দপ্তরে, আড্ডা দিতেন দীর্ঘক্ষণ। উঠান নামে তাঁর সেই উপন্যাসটি যখন বই হয়ে বেরোচ্ছে, তখনই তিনি নেই। স্মৃতিসুধায় ভরা এ লেখায় চলচ্চিত্রের মানুষ আমজাদ হোসেনের চেয়ে বেশি করে পাওয়া যাবে লেখক আমজাদ হোসেনের অবয়ব, অনেকের কাছে যা এখনো অপ্রকাশিত।
একটা বিশাল উঠান। উঠানটি ঘিরে পাঁচ ভাই আর তাদের ছেলেদের ঘর। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ছেলেমেয়ে নিয়ে এক বিরাট সংসার। এর প্রধান বড় দাদা রুস্তম সরকার। তার হুমকি–ধমকি নির্দেশ আর ইশারায় চলে এই উঠানের সব মানুষ। যৌবনে রুস্তম সরকার নিজেকে বড় বংশের ছেলে বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বড়লোকের কন্যা কমলাসুন্দরীকে বিয়ে করেছিল। স্ত্রীর গয়না বেচে আসাম থেকে কাঠ এনে বিক্রি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় সে। বিশাল বাড়ি করে সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে। এসব বিশ শতকের গোড়ার কথা। তারপর সামাজিক সংঘাত, ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা আর ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা। এই হলো আমজাদ হোসেনের সাম্প্রতিকতম উপন্যাস উঠান।
এই উপন্যাসের কাজ করতে গিয়ে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। বছর দেড়েক আগে একদিন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের ডাক পেয়ে তাঁর ঘরে যাই। দেখি সম্পাদক আর আমজাদ হোসেন আড্ডায় মশগুল। তাঁকে জানি আগেই। এবার পরিচয় হলো। সম্পাদক বললেন, আমজাদ ভাই, আপনি পাণ্ডুলিপি দেবেন এই রাশেদকে। পরের সপ্তায় প্রথমার দপ্তরে এলেন তিনি। কী পাণ্ডুলিপি দেবেন, সে নিয়ে দুকথা হলো। তারপর তিনি চলে গেলেন সাহিত্য আলোচনায়।
এই এক দিনের আড্ডায় তিনি আমাকে, না প্রথমাকে পছন্দ করলেন বলতে পারব না, তিনি প্রায়ই আসতেন প্রথমায়। পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন, কাজ হচ্ছে। কিন্তু আড্ডা হতো প্রধানত সাহিত্য নিয়ে। প্রথমার জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুলিপি সম্পাদক আখতার হুসেন তাঁর পূর্বপরিচিত। ফলে মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে আখতার ভাইও যোগ দিতেন। ক্রমে আমি তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম।
তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে আমিও খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। সময় পেলেই চলে আসতেন। তাঁর উপন্যাস উঠান-এর কাজ চলছিল। কিন্তু সে নিয়ে খুব বেশি কথা হতো না। আমাকে বলতেন, চলো, একবার কোথাও বেরিয়ে আসি। চলো, চট্টগ্রাম যাই। রাঙামাটি যাই। হাতের কাজ কমলেই যাব আমজাদ ভাই, আমি বলতাম। কারওয়ান বাজার এলাকায় দু-একটা টিভি চ্যানেল অফিসে আসতেন কখনো কখনো। আসতেন এফডিসিতে। এদিকে এলে একবার প্রথমায় আসা চাই। সরাসরি তো আসতেনই। মাঝে মাঝে মনে হয়, একটু কি নিঃসঙ্গ বোধ করতেন?
তাঁর নিজের পরিচয় অনেক। চলচ্চিত্রের মধ্যেই তো অনেক—পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, গীতিকার, কাহিনিকার এবং অভিনেতা। প্রতিটি ক্ষেত্রই সৃজনশীল। এদিকে তিনি গল্প উপন্যাস নাটক লিখেছেন, শিশুসাহিত্যের চর্চা করেছেন। লিখেছেন ছড়া আর কবিতাও। সেই ষাটের দশকে কলকাতার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাঁর কবিতা।
বাংলা কথাসাহিত্য এবং কবিতার তিনি একজন সর্বগ্রাসী পাঠক ছিলেন। আমাদের সমসাময়িক কবিদের কারও কারও কবিতা সম্পর্কে অবলীলায় মন্তব্য করতেন। কলকাতার আমাদের সমসাময়িক কবি শ্রীজাতর কবিতার লাইন পর্যন্ত তাঁর মুখস্থ। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির লেখকদের গল্প উপন্যাস কবিতা তো পড়া ছিলই, এর বাইরে জনপ্রিয় লেখকদের লেখা ছিল নখদর্পণেও। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে হাল আমলের কথাশিল্পীর রচনা পর্যন্ত তাঁর পড়া ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয়। আমার যেমন তেমনি তাঁরও খুব প্রিয় একজন লেখক সমরেশ বসু। সমরেশ বসু, সুনীল-স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন—আরও কত বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে আড্ডা আলোচনা আর ঘোরাঘুরির গল্প করেছেন। কোনো কোনো উপন্যাসের কাহিনিও তাঁর মনে ছিল। প্রথম সারির কথাসাহিত্যিকদের বাইরে গজেন্দ্র কুমার মিত্র, মনোজ বসু, নিমাই ভট্টাচার্য্য, ফাল্গুনী-নীহাররঞ্জন, জরাসন্ধ, যাযাবর—কাকে না পড়েছেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, গত ৪০ বছরের কথাসাহিত্যের কথা বলতে গেলে, পাঠক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস যতটা পড়েছেন, তার চেয়ে বেশি পড়েছেন আর খবর রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য সম্পর্কে। নিয়মিত দেশ পড়তেন, প্রতিবছর পূজা সংখ্যা কিনতেন ৫-৭টা। বই তো কিনতেনই।
অবাক হয়ে যাই, চলচ্চিত্রশিল্পের এতগুলো শাখায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে কীভাবে ৭০টি বই লেখা সম্ভব। এর মধ্যে উপন্যাস-গল্প-নাটক আছে, শিশুসাহিত্য ভূতের বই ছড়াও আছে। সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশুসাহিত্যের জন্য পরপর দুবার অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন প্রযোজনাসহ চলচ্চিত্রের ৬টি শাখায়; শুধু গোলাপী এখন ট্রেনে ছবিতেই ৫টি পুরস্কার (১৯৭৮)। তাঁর হাতে বাচসাস পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে ৬ বার। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। তাঁর চলচ্চিত্র নয়নমনি, গোলাপী এখন ট্রেনে, কসাই, দুই পয়সার আলতা, ভাত দে—ছোটবেলা থেকেই নামগুলো পড়ে আসছি, শুনে আসছি। আশির দশকে অন্যের বাড়িতে চাটাইয়ে বসে দেখেছি তাঁর সুন্দরী আর গোলাপী। তখন পাড়ায়–মহল্লায় টেলিভিশন কই। কোনো পাড়ায় একটা, কোনো মহল্লায় একটাও নেই। তাঁর জন্মদিনের ক্যামেরা ছিল আমার প্রিয় একটা বই।
এখন সব আছে। শুধু আমজাদ ভাই নেই।
নেই? কেমন যেন লাগে। বিশ্বাস হতে চায় না। অল্প সময়ে অসম্ভব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর সঙ্গে। খুবই স্নেহ করতেন। এবং একটু কি নির্ভরও করতেন না? তাঁর উপন্যাস উঠান–এর পাণ্ডুলিপির একটা বড় অংশ দিয়েছিলেন প্রথমে। পরে আরও কয়েক কিস্তি দিয়ে লেখাটা শেষ করেন। কম্পোজ, প্রুফ হওয়ার পর আমি জানুয়ারিতে এটা পড়তে শুরু করি। অন্যান্য কাজের ফাঁকে উঠান পাঠ, সম্পাদনা আর মতামত তৈরিতে দিন দশেক লাগে। মতামতটা দেখে আমজাদ ভাই বুঝেছেন, এটা ২০১৮-এর বইমেলায় বেরোচ্ছে না।
উপন্যাসটিতে একটু বড় আয়োজন ছিল। তার ভেতরে ঘটনার পরম্পরা, কাল আর চরিত্রের উপস্থাপনায় আমার কিছু মত তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তারপর কোনো কোনো জায়গা নিয়ে ভাবা আর দু–একটি জায়গায় পুনর্লিখনের জন্য নিয়ে যান তিনি। সময় নিয়ে, কী অসীম ধৈর্য নিয়েই না তিনি কাজটা করেছেন। আমি আজ তাঁর ধৈর্যের প্রশংসা করছি, এই উপন্যাস নিয়ে কাজ করার সময় তিনিও আমাদের ধৈর্যের প্রশংসা করেছেন। তাঁর দিক থেকে কাজ শেষ হয় কিছুদিন আগে। এর আগে চিকিৎসার জন্য একবার বিদেশে গিয়েছিলেন। এবার আমার দায়িত্ব ছিল পাণ্ডুলিপিটি আবার পড়া। এদিকে ২০১৯ সালের বইমেলার চাপ বাড়ছিল। উঠান–এর পুনর্পাঠে আমার দেরি হচ্ছিল। পড়া শুরু করেছি। হঠাৎ শুনি আমজাদ ভাই হাসপাতালে। অবস্থা ভালো নয়।
আমি দ্রুত কাজটি শেষ করি আর কেবলই প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করি, কবে ভালো হয়ে আবার তিনি আড্ডা দিতে আসবেন প্রথমায়। ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার পর আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম, সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। তাঁর বই তৈরি। একটু হইচই হবে। খাওয়াদাওয়া হবে।
কিন্তু আসলেন কই?আমি খুব গভীরভাবে চাইছিলাম অন্তত আর একটিবার তাঁর সঙ্গে দেখা হোক। উঠান তাঁর হাতে তুলে দেব। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। বেড়াতে যাব চট্টগ্রাম রাঙামাটি অথবা জামালপুর। হলো কই? উঠান এখন বই হয়ে আমার টেবিলে। আমি নই, বইটিই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। শুধু আমজাদ ভাই নেই, তাঁর আসা নেই, আড্ডা নেই। মন খুলে হাসি নেই।
এই লেখাটি যখন িলখছি, তখন বিদেশ–বিভুঁইয়ে কোন হিমঘরে পড়ে আছেন আপনি, আমজাদ ভাই?