বাঙালি কি গল্প উপন্যাস পড়ে প্রেম শিখেছিল
বাঙালির জীবনে প্রেম এসেছে কখন থেকে? নীরোদ সি চৌধুরী যেমন বলেছেন, ‘বাঙালী জীবনে নূতন ভালবাসার প্রবর্তনকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র’—কথাটি কি ঠিক? বাঙালি কি তবে গল্প–উপন্যাস পড়েই প্রেম শিখেছিল?
সাদা চোখে দেখলে প্রেম একটা আতুর ব্যাপার। আতুর; মানে স্পর্শকাতর, নাজুক, নরম। এ জন্য বাংলায় একটা শব্দ চালু আছে প্রেমাতুর। আবার প্রেম কখনো কখনো আগুন হয়ে ওঠে। এ জন্য বাংলায় বলা হয় প্রেমানল। এ এক আশ্চর্য আগুন। এ এমন আগুন, যেখানে প্রেমিক ও প্রেমিকা সজ্ঞানে ঝাঁপ দেয় এবং উপভোগ করে নন্দিত নরক। গড়পড়তা সমাজের চোখে প্রেম একটা পতন। কেউ প্রেমাচ্ছন্ন হলে বাংলায় তাকে বলা হয় প্রেমে পড়েছে (পতন!), ইংরেজিতে বলে ‘ফল্ ইন লাভ’। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে দেখা যায়, প্রেম এক অপরিমেয় শক্তির নাম। সমাজের, রাষ্ট্রের কখনো কখনো বিশ্বের প্রচলিত বিধিবিধানকে একটা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার আশ্চর্য এক ক্ষমতা রাখে এই প্রেম।
প্রেমের শক্তি বোঝার জন্য বড় বড় বই পড়তে হয় না। চারপাশে চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা তা বুঝতে পারি। বেশ কিছুকাল আগে বাংলা মুলুকে বেদের মেয়ে জোসনা নামে এক সিনেমা বেশ তোলপাড় তুলেছিল। কথিত আছে, সেই সিনেমা মাসের পর মাস একই সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিল। এক গর্ভবতী মা ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ওই সিনেমা এতবার দেখেছেন যে তিনি সিনেমা হলেই সন্তান প্রসব করেছিলেন। কথাটা হয়তো সত্যি নয়। অথবা সত্যি। সেটা আমাদের কহতব্য না। বলতে চাইছি, ওই সিনেমায় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন রাজার ছেলে। আর অঞ্জু ঘোষ বেদের মেয়ে। গ্রহদোষে রাজপুত্র প্রেমে পড়েন বেদের মেয়ের। ওই সিনেমারই এক গানে দেখা যাচ্ছে রাজার ছেলে আশঙ্কা করছেন ওই বেদের মেয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন কি না। গানে গানে রাজকুমার বলছেন, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি গো/ ও জোসনা দিও না ফিরায়ে গো’। এ এক কাতর মিনতি বটে! কাঙালপনায় ভরা এই উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই তো শাহজাদার গায়ের জড়িদার রাজকীয় পোশাক এক লহমায় ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়েছে। শাহজাদা প্রেমের স্বভাব আর শক্তি সম্পর্কে নিজেই এক উপলব্ধিতে এসেছেন। গানের মাধ্যমেই বলেছেন, ‘প্রেম মানে না রাজা-প্রজা গো/ ও জোসনা জাতি-কুল মানে না গো।’ ধনি-গরিব, জাত-অজাত, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, সাদা-কালোর মতো হাজারো যেসব শ্রেণিভেদ পৃথিবীর মানুষেরা তৈরি করেছে, একমাত্র প্রেমই পারে তার সবকিছুকে সমান করে দিতে। প্রেমের এই শক্তি-সামর্থ্যরে কথা ভেবেই বোধ করি শ্রীচৈতন্য দেব তাঁর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে প্রেমকেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বলেছিলেন, পরম কৃষ্ণকে পেতে হলে প্রেম দিয়েই পেতে হবে। এই প্রেম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই তিনি অজাতকে জাত দিয়েছিলেন; বদলে দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের মেজাজ-মর্জি। লালনের ভাষায়, ‘একটা পাগলামি কইরে জাইত দেয় অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে, আবার হরি বইলে পড়ছে ঢুইলে ধুলার মাঝে।’ নিজে বিরাট হয়েও ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়ার ক্ষমতা তো একমাত্র প্রেমই রাখে! অনেকে বলবেন, এই প্রেম তো নর-নারীর প্রেম না। এ তো মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ‘বৈষ্ণবকবিতা’য় বলেন, যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। ঠাকুরের ভাষায়, ‘দেবতারে যাহা দিতে পাই, দিই তাই/ প্রিয়জনে প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই/ তাই দিই দেবতারে, আর পাব কোথা? / দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।’
তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু এই প্রেম কি মানুষ বই পড়ে শেখে? নাকি বাইরে থেকে কেউ এসে কাউকে প্রেম শিখিয়ে দিয়ে যায়? সরলভাবে দেখলে যে কেউ বলবেন, এটা আবার কেমন কথা! প্রেম কি শেখা বা শেখানোর ব্যাপার! প্রেম তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মতো। আমার যা নেই তাই কারও কাছে কাঙ্ক্ষা করার নাম যদি প্রেম হয়, তবে তা তো নর-নারী চিরকালই বাসনা করে আসছে। এদিক থেকে প্রেম আদি ও অকৃত্রিম। কিন্তু নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর বাঙালী জীবনে রমণী ও আত্মঘাতী বাঙালী নামের দুই বইয়ে নানাভাবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে বাঙালির জীবনে প্রেম আগে ছিল না। ইংরেজের মাধ্যমে বাংলায় প্রেমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উনিশ শতকের রেনেসাঁসের আগে বাংলার নর-নারীর মধ্যে যা ছিল তার নাম ‘কাম’ বা ‘শরীর’। প্রমথ চৌধুরী যেমন তাঁর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে বলেছেন, সেখানে শরীরের নিচে মন বা আত্মা চাপা পড়ে গেছে; তেমনি উনিশ শতকের রেনেসাঁসের অন্যতম ভোক্তা নীরদও মনে করেন বাংলার মধ্যযুগে কাম আর শরীরের নিচে রুচিমান প্রেম চাপা পড়ে মরেছে। ইংরেজের বইপত্রের মাধ্যমে বাঙালির জীবনে ‘নতুন প্রেম’, ‘নতুন ভালোবাসা’ দেখা দিয়েছে। তবে তো দেখা যাচ্ছে পুরোনো প্রেম বলে একটা পদার্থ বাংলা মুলুকে ছিল। পুরোনো প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে ‘নবপ্রেমজালে’।
কিন্তু বাংলার নর-নারীর পুরোনো প্রেমকে নীরদচন্দ্র যে শুধু কাম আর শরীর দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তাই-ই-বা মানা যায় কীভাবে। চর্যাপদ–এ বাসনা-কাতর এক সবর যখন সবরীকে প্রকৃতির পটে রেখে দেখে এবং তাকে পেতে চায়, তখন তো বলতে পারি না যে ইংরেজ আসার আগে বাঙালির জীবনে প্রেম ছিল না। চর্যাপদ–এর একটি পদে আছে, পাহাড়ে নানা ধরনের গাছে ফুল ফুটেছে। মনে হচ্ছে ফুলেল ডালগুলো আকাশকে স্পর্শ করে আছে। এই ফুলশোভিত বনে সবরী বালিকা কানে কুণ্ডল কণ্ঠে বজ্র ধারণ করে ঘুরে বেড়ায়। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলির প্রেম আর মৈয়মনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন পালার প্রেমের কথাই বা ভোলা যায় কীভাবে। হ্যাঁ! এই প্রেম হয়তো বিলেতি কেতার প্রেম ছিল না। এখানে নারী বিলেতি কায়দায় পুরুষের কাছে ‘অন্য তাৎপর্যে’ আবিষ্কৃত হয়নি, পুরুষের ‘বিশেষ রুচি’ও ফুটে ওঠেনি। কিন্তু বাঙালির প্রেমের প্রকৃতি তো বাঙালির চারপাশ থেকেই উঠে আসবে। বিলেত থেকে আসবে না বা বিলেতি কেতায় দৃশ্যমান হবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তবু বিলেতি প্রেম বাংলায় দেখা দিয়েছিল উনিশ শতকে। প্রেম, নর-নারীর সম্পর্ক সম্পর্কিত আইডিয়াগুলো কিছু এসেছিল ইংরেজি সাহিত্যের বইপত্রের মধ্য দিয়ে। আর কিছু এসেছিল ওই রুচিতে বেড়ে ওঠা এদেশীয় ইংরেজি শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকদের কথা-কবিতার মাধ্যমে। নীরদের ভাষায় ‘বাঙালী জীবনে নূতন ভালবাসার প্রবর্তনকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র’। রবীন্দ্রনাথের হাতে এ বিশেষ প্রেমের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয়। এঁদের এই বইপত্র পড়েই নব্য কালো-ইংরেজ শ্রেণি নতুন সাদা প্রেম শিখেছে। আয়ত্ত করেছে প্রেমের ভাষা-সম্ভাষণ; দুই তরফা (নর–নারী) প্রেমের ব্যাকরণ। এঁদের বইপত্র দিয়েই ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির দাম্পত্যজীবনে বিলেতি রোমাঞ্চের প্রবেশ ঘটেছে। প্রেমের ক্ষেত্রে নর-নারীর বয়স পুনর্নির্ধারিত হয়েছে। নীরদ তাঁর বই দুটিতে মধ্যযুগের ও আধুনিক যুগের সাহিত্যের অবিশ্বাস্য আর অজস্র লাগসই উদাহরণ দিয়ে বাঙালি জীবনে প্রেমের এই রূপান্তরের ইতিহাস নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছেন। নীরদের এই চিন্তা হয়তো মিছা না। কিন্তু এতে পুরোনো প্রেম, যা আধুনিক ইউরোপীয় প্রেমের তুলনায় একটু ‘গাড়ল গাড়ল’, তার কী হলো! তা কি ঢাকা পড়ে গেল! নাকি মার খেয়ে গেল!
পৃথিবীর অনেক দেশের ইতিহাসে দেখা যায়, বহিরাগতের আক্রমণে তাড়া খেয়ে মূল ভূমি থেকে উৎখাত হয়ে অনেক সময় ‘জাতি’ সাব্যস্ত হয় ‘উপজাতি’ হিসেবে। তারা আশ্রয় নেয় পাহাড়ে-পর্বতে-জঙ্গলে। বাঙালির নিজস্ব প্রেমের কেতারও তাই হয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে গ্রামে, লোকালয়ে, ‘কালো কালো’ মানুষের মধ্যে। এরই প্রকাশ হয়তো আমরা লক্ষ করি লালন, হাছন, জসীমউদ্দীন, শাহ আবদুল করিমদের গান-কবিতায় বা বিচ্ছেদি, মুর্শিদি, রাখালি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার খোপে খোপে। এসবের মধ্যে মধ্যযুগের শরীরী প্রেম হয়তো নিজস্ব বিকাশের ধারায় অশরীরী হয়েছে। হ্যাঁ, হয়তো তা বিলেতি কায়দায় আর রুচিতে হয়নি।
বাংলা অঞ্চলের শিক্ষিত বাঙালি সম্ভবত পৃথিবীর বিরল জাতিগুলোর অন্যতম, যারা বই পড়ে ‘রুচিমান’ প্রেম শিখেছে। এর পক্ষে ডিসকোর্স তৈরি করে শ্লাঘা বোধ করেছে। একেই কি উপনিবেশিত মন বলে! কিন্তু প্রেমই বলি আর কামই বলি তা তো মাটি ফুঁড়ে ওঠার কথা। চারপাশের বাস্তবতা ঠিক করে দেওয়ার কথা। নিজের মতো করে তার একটা বিকাশও হওয়ার কথা। হয়েছেও হয়তো। সেই বাঙালি প্রেমের খোঁজ জরুরি বলে মনে করি। নইলে বড়লোকের বেটির মাথায় লাল গেন্দা ফুল গোঁজার বাসনা শুধু গানেই রয়ে যাবে।