বনভোজন
অনেক দিন ধরেই রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগ-জেলা-মহকুমা এমনকি গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত পিকনিকের প্রীতিপ্রদ উৎসব বেশ চালু হয়েছে। পিকনিকের ঋতু হলো শীত। উৎসব বলে কথা, অনেকের ত্বর সয় না। শীত ঠিকমতো না পড়তেই শুরু হয়ে যায় পিকনিক। শীত এখন এমনিতেই আসে দেরিতে। অনেকে যেমন শীতের নতুন কাপড় বানিয়ে ধৈর্য ধরতে পারে না, আগেই গায়ে চড়িয়ে দেয়, ব্যাপারটা ঠিক তেমনিই।
গ্রামবাংলার মানুষের প্রিয় ঋতু শীত। ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’ বলে একটা কথা আছে। আমি অল্প বিদ্যার মানুষ। তাই আগপাছ না ভেবে কথাটা বলে ফেললাম অনায়াসে। আমার জন্ম গ্রামে, ১৯৪৪-এর শেষ সপ্তাহে। গ্রাম ছেড়েছি ১৯৬১-তে, গ্রামের স্কুলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি শীত শুধু গ্রামবাংলার মানুষের প্রিয় ঋতুই নয়, উৎসবেরও ঋতু। নতুন গুড়ের ঋতুও শীত—আখ ও খেজুরের। বাড়িতে বাড়িতে নতুন গুড়ের পিঠা নানা নামের, নানান ধাঁচের। নতুন গুড়ের মুড়কি। নাড়ু। পায়েস। ঘন দুধে ভেজানো ঢেঁকিছাঁটা চালের চিতই পিঠা। ময়রার দোকানে নতুন গুড়ের বাতাসা, কদমা, খোরমা।
গ্রামের মানুষের পায়ে কি তখন জুতা-স্যান্ডেল ছিল? ছিল না। কিংবা গায়ে জামা-কোট-সোয়েটার? তা-ও না। কারও পায়ে বড়জোর কাঠের খড়ম। কারও-বা পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো? বিত্তবান অল্প কিছু মানুষের পায়ে চামড়ার পাম্প শু। তাদের গায়েই শুধু দামি পশমি শাল ও পশমি তুষ। বাকিদের কারও গায়ে কুমারখালির বিখ্যাত সুতি চাদর, কারও গায়ে নিজেরই দ্বিতীয় লুঙ্গি কিংবা মোটা গামছা বা বাড়ির মেয়েদের ভাঁজ করা শাড়ি। দরিদ্র মানুষ তখন শীত তাড়াত পাড়ার মোড়ে, পথের ধারে ধারে গোল হয়ে বসে আগুন পোহানোর মধ্য দিয়ে। শীত নিয়ে তারা কোনো অভিযোগ করত না। শীত তারা উপভোগ করত। ছোটবেলায় আমরা যে তা-ই করেছি, সে কথা এখনো মনে পড়ে।
এখন টেলিভিশন দেখলে হতবাক হয়ে যাই। অল্প বিদ্যার জেরেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের কোনো টিভি চ্যানেলেই ঋতুবন্দনা নেই। আছে শুধু ঋতু সংহার, তবে তা মহাকবি কালিদাসের সম্পূর্ণ বিপরীত। শীতের যে আনন্দ-উৎসব, তার বিবরণ চোখে পড়ে না। অবাক বিস্ময়ে দেখি, মাত্র ৮–১০ সেন্টিগ্রড শীতে গায়ে মোটা জ্যাকেট, মাথায় শীতের টুপি—তিনিও টিভি-ক্যামেরার সামনে অবলীলায় বলে যাচ্ছেন, ‘শীতে আমরা কাবু হয়ে যাচ্ছি, আমাদের দিকে তাকানোর কেউ নেই। ’ সেই সঙ্গে আরও দেখি শুধু কুয়াশা ও শীতজনিত বিভিন্ন রোগে কাহিল হাসপাতাল এবং রোগীদের দৃশ্য। সত্যিই, ‘কী বিচিত্র এই দেশ! ’ শীতে শীত, গরমে গরম, ঝড়ের সময় ঝড় আর আষাঢ়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি—এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলে এ রকম তো বলা হয় না, দেখানোও হয় না। সেখানে দেখানো হয় শুধু মানুষের অযথা দুর্দশা।
শীত ছেড়ে ফিরে যাই পিকনিকের কথায়। বাসের গায়ে ব্যানার টাঙিয়ে পিকনিকে যায় সাধরণ তরুণেরা। তারা মুখে বলে পিকনিক, কিন্তু ব্যানারে লেখে বনভোজন। বিভিন্ন বিখ্যাত অভিধানেও দেখা যায়—সেখানে বনভোজনের অর্থ লিখে অভিধানকার তৃপ্তি পাননি, তাই শেষে ইংরেজিতে পিকনিক শব্দটা জুড়ে দিয়েছেন।
পিকনিক ইংরেজি শব্দ। মূল অর্থ হলো আপন আপন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে পার্টিতে একত্রে ভোজন করা। ইংরেজরা কাজটা এখনো করে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে বাঙালি এখনো পিকনিক করে এবং মুখে বলে বনভোজন।
বনভোজন শব্দটা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। তাঁর চিঠিপত্রে আগে পিকনিক শব্দটা দেখতে পাওয়া যেত। ১৯১১ সালে প্রকাশিত নাটক, অচলায়তন-এ হঠাৎ এল নতুন শব্দ বনভোজন। বঙ্গীয় শব্দকোষ–এ শব্দটির অর্থ পাওয়া গেল বনে রন্ধনপূর্বক ভোজন। পরে প্রকাশিত অন্যান্য অভিধানে বিস্তৃত অর্থ দেওয়া হলো—সংঘবদ্ধভাবে বনে বা রম্যস্থানে গিয়ে রন্ধন ও প্রীতিভোজন।
একটা ব্যাপার দেখেছিলাম ছোটবেলায়। কনকনে শীতের মধ্যে পাড়ার মানুষ হঠাৎ একদিন তরিতরকারি, চালডাল এবং দল ছোট হলে কয়েকটা মুরগি আর দল বড় হলে একটি খাসির দড়ি ধরে হাঁড়িকুড়িসহ চলে যেত গ্রামের বাইরে। কোনো একটা বড় গাছের তলায় বসে শুরু হতো প্রাক্-রন্ধন পর্ব, রন্ধন পর্ব ও একত্রে প্রীতিভোজন। মহিলাদের অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সব কাজ করত পুরুষেরাই। খাওয়া হতো কলাপাতায়। দলে দুয়েকজন সাহসী হিন্দু থাকলে তারা খেত কলাপাতার সামনের দিক পেতে। আর মুসলমানরা খেত উল্টো দিক পেতে।
গ্রামের জেলেপাড়ার হিন্দুরা দলে ভারী বলে একই দিকে একই সঙ্গে বের হতো একই কায়দায়। জেলে হলেও সেদিন তাদের হাতে থাকত মোরগ—তারা বলত, রামপাখি। মুসলমানরা কখনোই তাদের খাবার খেত না। জেলে বলে নয়, আমার সমবয়সী ভাইপো ও বন্ধু মোমিনের কাছ থেকে জানতে পারি, তারা মুরগি-মোরগ জবাই করে না, গলা থেকে কেটে মাথা আলাদা করে ফেলে। আর সেটা মুসলমানদের জন্য হারাম।
যা-ই হোক, গ্রামের এই ব্যাপারটি ছিল উৎসবের মতোই। শীত তখন হয়ে যেত কার্তিকের শেষ দিনগুলো থেকেই। গ্রামের মানুষ প্রতীক্ষা করত পৌষের এই দিনটার জন্য।
গ্রাম থেকে বেরিয়ে বনে গিয়ে রন্ধন ও ভোজনের ব্যাপারটি ঘটত পৌষসংক্রান্তির দিনে। বিষয়টি হিন্দুদের হলেও শীতকে উপভোগ করার জন্য মুসলমানরাও দিনটিকে বেছে নিত। বনে ভোজন হলেও ব্যাপারটির নাম বনভোজন ছিল না। বনভোজন শব্দটার সঙ্গে তখন তাদের পরিচয় ঘটেনি।
অজ্ঞতা হেতু বাংলাদেশের সব অঞ্চলের গ্রামের খবর আমার জানা নেই। কুষ্টিয়াতে জন্ম নেওয়া আমি শুধু আমার পার্শ্ববর্তী কিছু জেলার গ্রামের কথাই বলতে পারি। পৌষসংক্রান্তির দিন বলে এই ভোজনোৎসবের নাম মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে ছিল পুষড়া। রাজশাহীর কিছু অঞ্চল ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাম এলাকাভেদে পুষলি, পুষালি, পুষালু।
গ্রামে চড়ুইভাতি করত ছোটরা। তাদের ছিল রান্নাবান্না খেলা। বাড়ি থেকে নিয়ে যেত সব। গ্রামের মায়েরা সকালে উঠেই সবকিছু প্রস্তুত রাখতেন। ছোটদের কাজ ছিল কলাপাতা জোগাড় করা এবং সবার আনা খাবার একসঙ্গে মিশিয়ে আনন্দভোজন করা।
বনভোজন ও বনভোজনের জন্য একত্রে আনুষ্ঠানিক যাত্রার সঙ্গে পরিচিত হই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ১৯৬৬ কি ১৯৬৭-তে। বাংলা বিভাগে পড়ি। যত দূর মনে পড়ে, বনভোজনে যেত শুধু বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাই। সঙ্গে শিক্ষকগণ থাকতেন। দায়িত্ববান অভিভাবকের মতো সবকিছু তত্ত্বাবধান করতেন বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মযহারুল ইসলাম। ভোজন পর্ব শেষে বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজনের চিন্তাও আসে তাঁর মাথা থেকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কথাটি তখন চালু হয়নি। আমরা বলতাম বিচিত্রানুষ্ঠান। ধারা বর্ণনার সঙ্গে গান, কবিতা, আবৃত্তি, পাঠ নিয়ে ছিল এই অনুষ্ঠান। ধারাবর্ণনার ভাষা ছিল আবেগ ঘন, পঠিত হত আবেগমথিত কণ্ঠে।
আমাদের বাংলাদেশ—যখন ছিল পূর্ব বাংলা, সরকারি পরিভাষায় পূর্ব পাকিস্তান, তখন কোনো উৎসবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের নিজস্ব অনুষ্ঠান। মুসলমানদের ঈদকে কি তখন উৎসব বলা যেত? আজাদি দিবসের যেসব ক্রিয়াকর্ম চোখে পড়ত, তা ছিল নেহাতই অনুষ্ঠান, উৎসব তো নয়ই।
উৎসবের শুরু তো স্বাধীন বাংলাদেশে। বাংলা একাডেমিতে পড়া আমাদের প্রিয় হাসান ভাই—হাসান আজিজুল হকের একটা প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এখনো মনে পড়ে, তবে হুবহু নয়, ‘শোক যদি শক্তিতে পরিণত হয়, শক্তি উৎসবে পরিণত হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। বাংলা একাডেমির বইমেলা তো উৎসবই। এটাকে অনেকেই অবশ্য মেনে নিতে পারে না। তবে পিকনিক বা বনভোজন এখন বাংলাদেশে সত্যিই উৎসব। উৎসব শব্দের মূল অর্থ—যা সুখ প্রসব করে। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই তো প্রত্যাশিত।
একটা কথা, আমাদের বনভোজন কি ইংরেজদের পিকনিকের অনুকরণ? এ ব্যাপারে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। বনভোজনের কাল এলে আমার কেবলই মনে পড়ে শৈশবের পুষড়ার কথা। পুষড়া সবাই ভুলে গেছে। তবে আমি পুষড়ার কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হই। আরও ভাবি, আমাদের এই বিস্মৃত লোকসংস্কৃতিই কি এখন এখন নগরসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে?