সৈয়দ শামসুল হক
সবার কাছে তাঁর পরিচয় সব্যসাচী লেখক। নিজের গদ্য, পদ্য আর কাব্যনাট্যের মধ্য দিয়ে নিত্যই তিনি মুগ্ধতার রুমাল নাড়েন আমাদের পরানের গহিন ভিতরে। সৈয়দ শামসুল হকের ৮৪তম জন্মদিন ২৭ ডিসেম্বর। এবারের আয়োজনে থাকছে সৈয়দ হকের অপ্রকাশিত নাটকসহ তাঁর জীবনের অপ্রকাশিত এক অধ্যায়।
ভূমিকা: পিয়াস মজিদ
নরওয়ের কালজয়ী নাট্যকার হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)-এর অতুলনীয় সৃষ্টি পিয়ের গিন্ট (১৮৬৭)। আজ থেকে দেড় শ বছর আগে ইবসেন এই নাটকটি লেখার অনেক পরে ২০০০ সালে পিরচানের পালা শিরোনামেএর অনুবাদ করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। না, ঠিক অনুবাদ নয়, এখানে তিনি নাটকটির বঙ্গীয় রূপান্তরই সম্পন্ন করেছেন। ফলে ইবসেনের এই নাটকের আশে, আনিত্রা, ইনগ্রিড, কারি, ট্রোল ডাইনি, সলভিয়েমা ইত্যাদি বিভিন্ন চরিত্র সৈয়দ হকের বঙ্গীয় রসায়নে আসিয়া, সোহাগি, আসমত, পিরচান চরিত্রে রূপ পেয়েছে। আর পরি, রাজা, অমাত্য, লাঠিয়াল—এরা তো আছেই।
সৈয়দ শামসুল হক শেকস্পিয়ারের অনন্য বাংলা অনুবাদক হিসেবে স্বীকৃত। সম্প্রতি আমরা তাঁর ব্রেখট অনুবাদেরও সন্ধান পেয়েছি। শেকস্পিয়ারের বাইরে বড় ক্যানভাসে কাজ করার জন্য তিনি এই নাটকের বঙ্গীয় রূপান্তর করেছেন, যা ২০০০ সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের প্রযোজনায় এবং কামালউদ্দিন নিলুর নির্দেশনায় মঞ্চে আসে। দীর্ঘ এই নাটকটির মঞ্চরূপ হিসেবে সৈয়দ হক পিরচানের পালায় দশটি নির্বাচিত দৃশ্যের রূপান্তর করেছিলেন। তবে মূল নাটকের আরও কিছু অংশ বই আকারে প্রকাশের আগে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৬ সালে মৃত্যু এসে তাঁর জীবনে যতিচিহ্ন টেনে যাওয়ায় এই রূপান্তরিত নাটকের প্রত্যাশিত যতি তিনি টেনে যেতে পারেননি। সৈয়দ হকের জীবন ও শিল্পসঙ্গী আনোয়ারা সৈয়দ হকের কল্যাণে তাঁর ল্যাপটপের অসংখ্য লেখার ফাইলের মধ্য থেকে খুঁজে পাওয়া গেছে অপ্রকাশিত এই নাটকটি। চারুলিপি প্রকাশনী থেকে এটি বই হয়ে বেরোবে ২৭ ডিসেম্বর, সৈয়দ হকের ৮৪তম জন্মদিনে। বলে রাখা ভালো, সৈয়দ হককৃত এই রূপান্তরিত নাটকে মূল নাট্যকারের উদ্দিষ্ট বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হকের প্রিয় কাব্যনাট্যধর্মিতা। গ্রামবাংলার পালারীতিও এখানে প্রযুক্ত। বিশেষত এর গীতিপ্রবণতা মুগ্ধ করবে পাঠককে। এখানে প্রকাশিত হলো পিরচানের পালা নাটকের দশম দৃশ্যটি। এই দৃশ্যে চোখ ও কান পাতলে হয়তোবা আমাদের সমকালীন সমাজজীবনের ছবিও দেখতে পাওয়া যাবে!
দৃশ্য ১০
আসিয়া পাগলিনীর মতো এসে আছড়ে পড়ে।
আসিয়া: পিরচান! পি-র-চা-ন!
তুই কই গেলি বাপজান।
পাগলিনী দ্যাখ তোর মায়।
দেওয়ান যে সব নিয়া গেছে তার এক্কো থাবায়।
ভিটাছাড়া করছে দেওয়ান।
তোর বাপের পিরান
লাঠিয়াল ছিঁড়া ফেলছে,
হাঁড়ি–পাতিল ভাঙছে।
চক্ষে যে আন্ধার দেখি—বাপজান!
কই তুই? আর কি দেখা পাব তোর পিরচান।
গর্ভের সন্তান তুই,
কপালে বিন্ধছে সুঁই,
তোর হাতে এক ফোঁটা পানি পাব না রে!
যায় যে পরান।
আল্লারে! আমার সংসার তুমি দিলা ছারেখারে!
থাকো তুমি কোন আসমানে?
গরিবও তোমার সৃষ্টি, দৃষ্টি নাই
আমাদের পানে?
কেবল তোমার দৃষ্টি
রাজাবাদশা–দেওয়ানের দিকে।
আর তুমি গরিব পুড়ায়া মারো আগুনের শিকে!
এত সুখ পাও তুমি গরিবেরে এত কষ্ট দিয়া।
আর, দুগ্ধ দিয়া গোসল করাও
যারা গরিবে জুলুম করে—এ কী উলটা ভাও!
এরে কয় তোমার বিচার?—
আসতেছে মরণ আমার।
মরণ ঘনায়া আসে, চক্ষে দেখি
কেবল আন্ধার।
পিয়াসে পরান যায়—পানি—
সন্তানের হাতে এক ফোঁটা পানি—
তা–ও ভাগ্যে নাই কি আমার?
পিরচাঁন! বাপজান!
মাথায় কাঠ নিয়ে পিরচান আসছিল, থমকে দাঁড়ায়।
আসিয়া: বাপজান! পানি!
পিরচান মাথার বোঝা ফেলে ছুটে কাছে যায়।
পিরচান: মা! মা তুই! মা রে!
আসিয়া: পরান যায় রে।
পিরচান, আইছস ব্যাটা?
পানি—এক ফোঁটা!
পিরচান: মা তুই এইখানে? ভিটা থিকা এতদূরে ক্যান?
তর কী হইছে মা রে, তুই এমন করস ক্যান?
আসিয়া: ভিটাছাড়া করছে আমারে।
দেওয়ান—দেওয়ান!
সর্বাঙ্গে মারছে লাঠি,
কাইড়া নিছে ঘটিবাটি—যায় যে পরান।
ভাগ্যে ছিল, শেষকালে দেখা হইল, বাপজান।
পানি!!
পিরচান: পানি! কই পাই পানি?
জগৎ ভরমিয়া মা রে আমি পানি আনি।
দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধইরাছিলি,
মুখেতে দুধের সুধা তুই দিয়াছিলি—
আইজ তর পিয়াসায়
ব্যাটা কই পানি পায়?
এত হতভাগা আমি তোর গর্ভের সন্তান!
মায়ের অন্তিমকালে পানিটুকু পান—
করাইতে অক্ষম!
আল্লা তুই এত বেরহম?
এতই তোমার কাছে আমরা অধম
যে, তোমার সৃষ্টির পানি,
সাত সাগরের পানি,
তেরো শ নদীর পানি
সব তুমি শুষ্ক কইরা রাইখাছ গরিবের তরে?
মায়ের অন্তিমকালে পুত্র তার পানি যে
সন্ধান করে—
কোথাও সে পানি নাই—নদী বা সাগরে—
নাই পানি
মা যে জননী হয় ব্যাটা তার মুখে তুইলা ধরে।
বলতে বলতে পিরচান পানি সন্ধান করে কোথাও না পেয়ে মায়ের কাছে ছুটে ফিরে আসে।
আসিয়া: পিরচান! পিয়াস—পিয়াস বড়—
যায় যে পরান।
পিরচান: এক ফোঁটা পানি নাই জগৎ সংসারে।
তবে এই জিহ্বা চুইষা খা রে।
এই জিহ্বা সন্তানের জিহ্বা তোর।
এই না জিহ্বায়
আমি কথা কইয়াছি তোরই তো ভাষায়।
এই না জিহ্বায় আমি ডাক দিছি—মা!
মা আমার মা!
ধর, জিহ্বা ধর।
মা তোর বক্ষের দান দুগ্ধসুধা আছে
এই জিহ্বার ভিতর।
তোরই সেই দান
সন্তানের জিহ্বা থিকা কর তুই পান।
আসিয়া: পি-র-চা-ন!
আসিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
পিরচান: মা!—মা রে!—মা!
ধুঁক ধুঁক করে না তো জান!
আর নড়ে না তো ঠোঁট।
মা! মা রে! একবার ওঠ।
একবার পিরচান ডাক দে আমারে।
মা দ্যাখ চায়া দ্যাখ তুই
এই কাষ্ঠ কত কাষ্ঠ আর কোনো কষ্ট
নাই মা রে,
এই কাষ্ঠ বেচিব বাজারে,
অন্নবস্ত্র সব হবে, খাজনা পরিশোধ হবে,
আবার সুদিন হবে, জমি হবে, ধান হবে,
আবার রন্ধন হবে,
উনুনের তাপে তোর মুখ রাঙা হবে,
দুধের পাতিলে তোর দুধ উথলাবে,
দুঃখ দূরে যাবে।
একবার চায়া দ্যাখ মা রে!
একবার ডাক দে আমারে—পিরচান পিরচান
মা ও মা রে!
মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে পিরচান উঠে দাঁড়ায় মায়ের বুক থেকে।
পিরচান: নাই আর নাই তবে জননী যে নাই
জননী বিদায় নিলে জগৎ যে নাই!
জননী যে জন্ম দেয় কত কষ্ট করে—
দশ মাস দশ দিন গর্ভে তার ধরে—
েবল শিশু তো নয়—একটি জীবন—
যেন এ জীবন হয় সুখের কারণ।
অবিচার দুঃখশোক এই পৃথিবীর
ঘুচাবে সন্তান—এই আশা জননীর।
জননী যে দুগ্ধ দেয় সন্তানের ঠোঁটে—
জননী যে ভাষা দেয় মুখে বোল ফোটে—
জননী যে চক্ষে দেয় সোনার স্বপন—
জননী যে বক্ষে করে আশার বপন—
কেবল স্বপন আর কেবল আশাই?—
জননীর কাছে আরও বড় কিছু পাই।
বাস্তব কঠিন বড়—বাস্তবের সাথে
যুদ্ধের সংকল্প পাই জননীর হাতে।
সন্তান তখন ছুটে যায়—যুদ্ধ করে
জননীর মুখে হাসি ফুটাবার তরে।
জননী হাসিলে হাসে জগৎ সংসার।
অমাবস্যা কাটে, চাঁদ ওঠে পূর্ণিমার।
সে জননী যায় যদি কিবা থাকে আর?
চন্দ্রসূর্য নিভা যায়, জগৎ আন্ধার।
আর কে আমারে ডাক দিবে—পিরচান!
আর কে ফিরাবে পথে তার কুসন্তান?
মা নাই জগৎ নাই—আন্ধার জগতে
দেখি না যে পথ আমি যাই কোন পথে?
যাই আমি কোন পথে, কোথায় যে যাই—
যেখানেই যাই আমি নাই আশা নাই।
সৈয়দ হকের যত অজানা
লেখালেখির সূচনায়
বারো বছর বয়সে সদ্য টাইফয়েড থেকে উঠে প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন প্রথম দুটো কবিতার পঙ্ক্তি, ‘আমার জানালার পাশে একটি গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে।’ এ ছাড়া ছোটবেলায় নিজের গ্রামে গনি মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে তিনি দেখেছিলেন, যে কিনা বানিয়ে বানিয়ে দারুণ গল্প বলতে পারত। তাকে দেখে কিশোর সৈয়দ হকের মনে তখনই জেগেছিল গল্প লেখার বাসনা। প্রথম প্রকাশিত লেখা ফজলে লোহানী সম্পাদিত অগত্যা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ১৯৫১–এর মে মাসে ‘উদয়াস্ত’ শিরোনামের গল্প। গল্পটি লেখা হয়েছিল সে বছরেরই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এবং ছাপার সময় লেখকের নাম ছিল ‘শামসুল শায়ের’।পিতার সূত্রে
তাঁর পিতা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন নিজের পেশা–সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি ভারত বিজয় নামে একটি নাটকের লিপিকার ছিলেন। ধারণা করা যায়, পিতার এ নাট্য-ঝোঁক উত্তরকালে পুত্র সৈয়দ হককে নাট্যচর্চায় প্রাণিত করেছে।
বিচিত্র পেশা
সার্বক্ষণিক সাহিত্যকর্মই ছিল সৈয়দ শামসুল হকের একমাত্র নিরবচ্ছিন্ন পেশা। এ ছাড়া তরুণ বয়সেই বোম্বেতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার কামাল আমরোহীর সঙ্গে কাজ করতে। সেখানে সিনেমা প্রোডাকশন হাউসে পরিচালনায় শিক্ষানবিশ সহকারী হিসেবে কাজ করেন ১৯৫১-৫২ কালপর্বে। জীবিকার জন্য একসময় পেশাদার অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক রচনা এমনকি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল লেখার কাজও করেছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু করেন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগে অনুষ্ঠান প্রযোজক ও সংবাদ-পাঠক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পারিবারিক উদ্যোগে একসময় ‘সব্যসাচী’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থাও খুলেছিলেন তিনি।
বসতবাটি
সৈয়দ হকের জীবন কেটেছে মূলত তিনটি শহরে: কুড়িগ্রাম, ঢাকা ও লন্ডন। ১৯৪৮-এর মার্চের শেষ ভাগে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা আসেন। প্রথমে ছিলেন লক্ষ্মীবাজারে, তারপর বিভিন্ন সময় গ্রিন রোড, মণিপুরিপাড়া হয়ে আমৃত্যু ছিলেন গুলশানে। মাঝখানে ১৯৭১-এ বিবিসির কাজে যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখান থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফেরেন ১৯৭৯-এর মার্চের শেষভাগে।
বিজয়ের সোনালি প্রহরে
১৯৭১-এ লন্ডনে বিবিসিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিবিসি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি সৈয়দ শামসুল হকই পাঠ করেন।
সূত্র: সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজীবনী তিন পয়সার জ্যোছনা, হে বৃদ্ধ সময় এবং সৈয়দ শামসুল হক সংবর্ধনাগ্রন্থ জলেশ্বরীর জাদুকর