আমাদের মুখ যেভাবে বিজ্ঞাপনে ঢাকা
আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যখন পণ্যই আমাদের জীবনযাত্রার গতিপথ নির্ধারণ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রেন্ড ঠিক করে দিচ্ছে আজকে আমাদের দিনটা কী নিয়ে কথা বলে কাটবে। কিন্তু কীভাবে?
‘এবং আমি সব চোখ চিনে নিয়েছি, চিনেছি সবাইকে
সেই সব চোখ যারা গেঁথে ফেলে প্রণীত বুলিতে
এবং যখন আমি প্রণীত, পিনে বিঁধে ছটফট করছি
যখন আমি বিদ্ধ এবং দেয়ালে মোচড়াচ্ছি
তখন কীভাবে শুরু করা যায়
আমার দিনের এবং কাজের কথা বলার…’
টি এস এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফরক’ কবিতার প্রুফরককে বলা হয় আধুনিক মানুষের প্রতিচ্ছবি, সেই আধুনিক মানুষ, যাকে পিনে গেঁথে ব্যবচ্ছেদ করে—ক্রমাগত ব্যবচ্ছেদ করে একের পর এক চোখ; আর সেই সব চোখে চোখ রেখে কফির পেয়ালা হাতে দিনের আলাপ সারতে গিয়ে বারবার দীর্ঘসূত্রতার জালে জড়িয়ে যায় কথা।
কী দেখে এই চোখগুলো? মাথার চুল কি কমে যাচ্ছে? পোশাক কি যথেষ্ট কেতাদুরস্ত? অলংকার কি রুচিসম্মত? আর তাই আধুনিক মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেকে নির্মাণ করে। ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফরক’ কবিতাতেই ইংরেজ কবি এলিয়ট যেমন বলেন—
‘সময় আসবে, সময় আসবে
একটি মুখ নির্মাণের, দেখা হওয়ার আগে সেই মুখগুলোর সাথে, যাদের দেখি
সময় পাওয়া যাবে হত্যার এবং সৃষ্টির’।
কারা এই প্রুফরক নামের সেই আধুনিক মানুষ, যারা ক্রমাগত কেবলই ‘মুখ নির্মাণ’ করে?
ফরাসি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক গায় ডিবোর্ড বলছেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা আধুনিক মানুষকে বেঁধে ফেলছে নিজেকে ক্রমাগত ধ্বংস ও সৃষ্টির এই চক্রে। তিনি বলছেন, আধুনিক সমাজে প্রকৃত সামাজিক জীবনের জায়গা নিচ্ছে উপস্থাপন। আর এর নাম তিনি দিয়েছে ‘দ্য সোসাইটি অব স্পেকটেকল’ বা ‘চকমকে দৃশ্যের সমাজ’। যেখানে সামাজিক জীবন থাকা থেকে পাওয়া এবং পাওয়া থেকে আবির্ভূত হওয়ায় পর্যবসিত হয়েছে। যেখানে পণ্যের সঙ্গে সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। কী! পরিচিত শোনাচ্ছে? মুঠোফোনের পর্দায় মুখ গুঁজে রাখা মুখগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কিংবা বিশেষ ব্র্যান্ডের গাড়ি, জুতা বা ঘড়ি না পেলে যাঁদের জীবনই বৃথা হয়ে যায়, তাঁদের কথা?
আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন পণ্যই আমাদের জীবনযাত্রার গতিপথ নির্ধারণ করছে। সামাজিক মাধ্যমের ট্রেন্ড ঠিক করে দিচ্ছে, আজকে আমাদের দিনটা কী নিয়ে কথা বলে কাটবে। মেটা দুনিয়ায় উপস্থাপিত জীবনই যাপন করছি আমরা।
আজ থেকে অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে কী ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন ডিবোর্ড? তিনি বলেন, ‘চকমকে দৃশ্যের সঙ্গে পরোক্ষ মিল খোঁজা প্রকৃত কর্মতৎপরতাকে প্রতিস্থাপন করছে।’ ঠিক যেমনটা এখন আমরা দেখছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটি সুন্দর মুহূর্তকে সত্যিকার অর্থে উপভোগ করার চেয়ে তার ছবি তুলে পোস্ট করার দিকেই এখন আমরা জোর দিচ্ছি বেশি। একজন বৃষ্টির ছবি তুলে পোস্ট দিলে নিউজফিড ছেয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে—মানে বৃষ্টির ছবিতে। কিন্তু বৃষ্টির শীতল ছাট, মাটির ঘ্রাণ আর রিমঝিম শব্দের অনুভূতি কি আমরা হারাচ্ছি?
‘বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সাথে ওতপ্রোত
নিয়ন আলোয় পণ্য হলো
যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।’
শঙ্খ ঘোষের ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতাটির মতো আজ আমাদের সবার মুখই বিজ্ঞাপনে ঢাকা। ব্যক্তিগত যা কিছু তার বিনির্মাণ ঘটছে প্রতিনিয়ত পণ্যায়নের হিসেবের সঙ্গে মিল করে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যস্থতা করছে নানা দৃশ্য—সে স্থির হোক কিংবা গতিশীল। আমরা সবাই–ই বিজ্ঞাপন হয়ে উঠছি; আর ডিবোর্ডের ভাষায়, এভাবেই মানুষের ওপর পণ্যের উপনিবেশিকীকরণ সম্পন্ন হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা যখন এমন, তখন পণ্য–প্রভুর দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায়ও বলে দিচ্ছেন ডিবোর্ড। তিনি বলছেন, জ্ঞানই পারে চকমকে দৃশ্যের এই শৃঙ্খল ভাঙতে।
কিন্তু আসলেই কি এই ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তি সম্ভব। সেটা সময়ই বলে দেবে?