অসীমের জন্য এলিজি
১৮ জুন মারা গেছেন কবি অসীম সাহা। আজ ২০ জুন বাংলা একাডেমি চত্বরে ফুলেল শ্রদ্ধায় তাঁকে শেষ বিদায় জানানো হয়।
আসীম সাহা আর নেই। শরীরটা বশে ছিল না। গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই চলে গেলেন, যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না।
আসীম সাহাকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। আমার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, তখন আমরা দুজনই ছাত্র। জাসদের অঘোষিত মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’তে কাজ করি। সহকর্মী হিসেবে ছিলাম অল্প কিছুদিন। তিনি অবশ্য আরও কয়েক বছর কাজ করেছেন, পঁচাত্তরের ২৭ জানুয়ারি পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত।
‘গণকণ্ঠ’তে তখন কবির ভিড় উপচে পড়ছে। আল মাহমুদ, দিলওয়ার, আহমদ ছফা, আবু কায়সার, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, অরুণাভ সরকার, মাশুক চৌধুরী, আবু করিম, সমুদ্র গুপ্ত—এ রকম আরও কয়েকজন কবি এ পত্রিকার নিয়মিত কর্মী। তাঁদের মধ্যে আছেন অসীম সাহাও। তিনি কাজ করতেন সম্পাদকীয় বিভাগে। শেষ দিকে দেখা হলে মনে হতো, একজন সন্তের সঙ্গে আছি।
বয়সে আমার বছর দুয়েক বড়। কিন্তু ছিলেন বন্ধুর মতো। মনে আছে, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় একটা ‘এশীয় লেখক সম্মেলন’ আয়োজন করেছিলাম। সঙ্গে কবীর চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, মাশুক চৌধুরী, সোহরাব হাসান তো ছিলেনই। আর ছিলেন অসীম সাহা ও তাঁর স্ত্রী অঞ্জনা। তিনিও কবি।
অসীম সাহা নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। ওই সময় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ক্ষমতাসীনেরা বুলন্দ আওয়াজে উচ্চারণ করত। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ১৯৭৩ সালের ১৫ অক্টোবর অসীম সাহা আক্ষেপ করে ‘সাম্প্রদায়িকতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা’ নামে একটি উপসম্পাদকীয়তে লেখেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা হাস্যকর উপহাসে পরিণত হয়েছে মাত্র। রাষ্ট্রীয় জীবনে যেখানে ধর্মকে প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করা হচ্ছে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা তো বজায় থাকছেই না, বরং বিভিন্ন উপায়ে মানুষের মগজের ভেতরে ধর্মের সার পদার্থগুলো প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দু তার হিন্দুত্ব সম্পর্কে ভাবছে, মুসলমান তার মুসলমানত্ব নিয়ে ভাবছে, মানুষ হবার চিন্তায় কেউ নিরপেক্ষ হতে পারছে না।’
অসীম সাহা ‘গণকণ্ঠ’তে ‘দৃশ্য অদৃশ্য’ নামে মাঝেমধ্যে কলাম লিখতেন। ১৯৭৪ সালের কথা। চারদিকে অনাহার, দুর্ভিক্ষ। মানুষ ভিড় করছে লঙ্গরখানায়। ২০ আগস্ট ‘ছিন্নমূল মানুষেরা কোথায় যাবে’ শিরোনামে তিনি লিখলেন, ‘শহরের ত্রাণশিবিরগুলোর চেহারা নিয়ে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় বহুবিধ খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে। বিপর্যস্ত নারী-পুরুষের জীবনযাত্রার যে মর্মান্তিক চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে, তাতে যেকোনো বিবেকবান মানুষের অস্থিমজ্জায় যদি হিমশীতল শিহরণ জেগে ওঠে, তা হলে সেটাই হবে সর্বতোভাবে সাধারণ ও স্বাভাবিক। দুস্থ মানবাত্মার নির্মম পরাজয়ের গ্লানি যেন ত্রাণশিবিরগুলোর প্রতিধবনিত হাহাকারের মধ্যে মর্মান্তিকভাবে ফুটে উঠেছে।’
একসময় অসীম সাহার লেখাজোখায় অ্যাকটিভিজম ছিল। পরে অনেকটাই বদলে গিয়েছিলেন। সময়ও গিয়েছিল পাল্টে। জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন নিভৃতে। একটা ছোট ছাপাখানা ছিল। সেখান থেকেই আয়রোজগার। তেমন সচ্ছল ছিলেন না। অতীতের টালমাটাল দিনগুলোর কথা ভেবে তিনি কি নস্টালজিয়ায় ভুগতেন?
‘একজন পুরোনো রাজা: একজন নতুন রাজা’ শিরোনামে ১৩ সেপ্টেম্বর অসীম সাহা সরকারপ্রধানকে উদ্দেশ করে লিখলেন, ‘তিনিও একদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সব রকম শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি একদিন এ দেশের জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের। অথচ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি ভুলে গেলেন সব।…এখন সারা দেশে অসংখ্য মানুষ ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মানুষের দুয়ারে করাঘাত হানছে। এখানে কি ইথিওপিয়ার চেয়েও করুণ অবস্থা আসেনি? এর জন্য কি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগই দায়ী?’
অসীম সাহা কবিতা লিখতেন। তবে ‘গণকণ্ঠ’তে খুব একটা নয়। পত্রিকাটি যখন নিষিদ্ধ হলো, তিনি তখনো তাঁর অনেক সহকর্মী এবং জাসদ–সমর্থিত ছাত্রলীগের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেছেন। জাসদ তখন মহাদুর্যোগে। নেতারা সবাই গ্রেপ্তার। দেশে চলছে সামরিক শাসন। প্রহসনের এক বিচারে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হলো। লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের ফাঁসি হলো ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে। ওই সময় জাসদ-ছাত্রলীগের নেতা রায়হান ফিরদাউসের উদ্যোগে একটি কবিতা সংকলন বের হয়। এতে যুক্ত ছিলেন মাশুক চৌধুরী, আবু করিম, মোহন রায়হানসহ আরও অনেকে। তাহের স্মরণে অসীম সাহা লিখেছিলেন এক অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা:
‘তাহের তাহের বলে ডাক দিই
ফিরে আসে মৃত্যুহীন লাশ
কার কণ্ঠে বলে ওঠে আকাশ-বাতাস
বিপ্লব বেঁচে থাক তাহের সাবাশ।’
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে মোস্তফা জব্বারের সম্পাদনায় মাসিক ‘নিপুণ’-এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম সংখ্যায় খালেদা জিয়ার একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। তিনি তখনো রাজনীতিতে আসেননি। সম্ভবত এটিই ছিল তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার এবং সেটি নিয়েছিলেন অসীম সাহা। সঙ্গে ছিলেন নাসির আলী মামুন। তিনি ছবি তুলেছিলেন।
একসময় অসীম সাহার লেখাজোখায় অ্যাকটিভিজম ছিল। পরে অনেকটাই বদলে গিয়েছিলেন। সময়ও গিয়েছিল পাল্টে। জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন নিভৃতে। একটা ছোট ছাপাখানা ছিল। সেখান থেকেই আয়রোজগার। তেমন সচ্ছল ছিলেন না। অতীতের টালমাটাল দিনগুলোর কথা ভেবে তিনি কি নস্টালজিয়ায় ভুগতেন? জানি না।