হিরো আলম কেন রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতীক হয়ে উঠলেন
‘রুচির দুর্ভিক্ষ’—কথাটি অনেক আগে বলেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সম্প্রতি এই ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বিষয়টি আবার সামনে এসেছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর (অধেয় নির্মাতা) হিরো আলমকে কেন্দ্র করে। কেন ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’–এর প্রতীক হয়ে উঠলেন তিনি?
মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটা কথা আছে, ‘রিটার্ন অব দ্য রিপ্রেসড’ বা ‘অবদমিতের ফিরে আসা’। ফ্রয়েড এখানে বলতে চাইছেন, আমরা যেসব বিষয় আড়াল করি বা মনের কোণে চেপে রাখি, সেগুলো আসলে পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। সমাজের অনুমোদিত কাঠামোর বাইরে যাওয়ায় যেসব ইচ্ছাকে আপনি গলা টিপে হত্যা করেছেন, সেগুলো ফিরে আসে কোনো এক অচেনা রূপে—স্বপ্নে, আচরণে, বিদ্রুপে বা মুখ ফসকে বলে ফেলা কোনো কথায়।
ফ্রয়েডের মতে, স্বাভাবিক থেকে একধরনের বিচ্যুতি এই অবদমন—যেটাকে আপনি নিজের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। আমাদের সামষ্টিক অবচেতনের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে একই ঘটনা। ‘কালেকটিভ আনকনশাসনেস’ বা সামষ্টিক অবচেতনে আমরা অনেক বিষয়ই সামাজিক মানদণ্ডের অনুকূল না হওয়ায় চেপে যাই। বিষয়গুলো হলিউডি সিনেমার মানবিক বোধহীন জম্বির মতো ফিরে আসতে পারে এবং দাঁড়াতে পারে আমাদের সামষ্টিক বিচ্যুতির নজির হয়ে। হালে যেমনটা যেমনটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন হিরো আলম।
বাংলাদেশের আরও অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের (অধেয় নির্মাতা) মধ্যে একজন হিরো আলম। কিন্তু তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা কেন? তিনি কেন সমগ্র বাঙালির রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতীক হয়ে উঠলেন? তাঁর উত্থান কেন এত গুরুত্ববাহী? কারণ তিনি সেই জম্বি, যার জন্ম আমাদের মনন থেকেই এবং যাকে কোনোভাবেই আমরা মুছে ফেলতে পারছি না।
রুচি—শব্দটাই আভিজাত্যের নির্দেশক। আপনার রুচি আছে, মানে আপনি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিভুক্ত। সমাজে আপনার সাংস্কৃতিক পুঁজি অন্যদের তুলনায় বেশি। আর এই সাংস্কৃতিক পুঁজির জোরেই আপনি অন্যদের থেকে আলাদা ও উন্নত। কাজেই আপনি সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণকারী। আর এভাবেই আপনি সমাজে ‘কালচারাল হেজিমনি’ বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করেন এবং করবেন। এই ‘হায়ারার্কি’ বা বিভাজনক্রম যেকোনো সমাজব্যবস্থায় শাসকের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার মূল হাতিয়ার—এমন কথা বলেছেন মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি। এখন রুচি যাঁর, মুলুক তাঁর—বিষয়টা কি তা–ই?
বাখতিনের ‘কার্নিভ্যাল’–এর মধ্যেই আমরা হিরো আলমকে পাই। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, মানুষ দৈব নয়, মানুষ সবার ঊর্ধ্বে নয়। দোষ–ত্রুটি মিলিয়েই মানুষ এবং তাঁরও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে।
রুশ দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক মিখাইল বাখতিনকে এবার একটু টেনে আনা যাক। তিনি বলছেন এমন এক সাহিত্যিক ধরনের কথা, যেখানে প্রতিষ্ঠিত সব ধারণাকে বিদ্রুপ ও গোলযোগের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা যায়। শুধু তা–ই নয়, এর সঙ্গে অবদমিত আরও অনেক ধারণাকে মুক্ত করা যায়। এই অবস্থার নাম তিনি দিয়েছেন ‘কারনিভ্যালেস্ক’। দুনিয়াজুড়েই কার্নিভ্যাল এমন এক উৎসব যেখানে সব জাতপাত ঘুঁচে যায়। আপাতদৃষ্টে যা উদ্ভট, যা অস্বাভাবিক, যা প্রচলিত ধারার বাইরে, তা করার অনুমোদন মেলে কার্নিভ্যালে। বাখতিনের এই কার্নিভ্যাল–বিশ্বে চার ধরনের ঘটনা ঘটে।
স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
বিভাজনক্রমের বিলুপ্তি ঘটায় এবং সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন আচরণে উৎসাহ দেওয়া হয়।
বিপরীতধর্মী মত ও দৃষ্টিভঙ্গির সহাবস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
সব দৈবত্বের অবসান ঘটে। ফলে যা ‘অশ্লীল’, ‘নিচু’, ‘কুরুচিকর’—তা প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি হয়।
বাখতিনের ‘কার্নিভ্যাল’–এর মধ্যেই আমরা হিরো আলমকে পাই। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, মানুষ দৈব নয়, মানুষ সবার ঊর্ধ্বে নয়। দোষ–ত্রুটি মিলিয়েই মানুষ এবং প্রত্যেকেরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। রুচির বেসাতি করে অনেকেই ক্ষমতাকাঠামোর সান্নিধ্য লাভের উপায় খুঁজেছেন।
গণমানুষকে ‘রুচিশীল’ করার চেষ্টায় তাঁদের মধ্যে বিভাজনক্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু রুচির দায়ের ভারটা হিরো আলমের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে আমরা যেন বিভক্তির চর্চা চালিয়ে না যাই।