নিজেকে ‘ফাইটার’ বলে দাবি করা অবন্তিকা আত্মহননের পথে হাঁটলেন কেন?
আক্রান্তকে দোষারোপ বা ভিকটিম ব্লেমিংয়ের শিকার কি হতে হয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকাকে? নিজেকে ‘ফাইটার’ দাবি করার পরও কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন তিনি? এর পেছনে সমাজের কি দায় রয়েছে?
ক্যামেরা ও আলোর কারসাজিতে যথাসম্ভব পাশবিকভাবে চিত্রায়িত খল চরিত্রের হাত এগিয়ে যাচ্ছে ‘অবলা নারী’র দিকে। অন্য কোনো উপায়েই নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় অপারগ নারী এবার নিজের প্রাণ হরণেই উদ্যত হন। কারণ, ‘ইজ্জত’ যাওয়ার চেয়ে প্রাণ যাওয়া উত্তম। ঢাকাই সিনেমায় এমন বয়ানের পুনরাবৃত্তি আমরা বারবার দেখেছি। এ বয়ানে যে ‘ভিকটিম’ বা আক্রান্তকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা চলে ‘আদর্শ ভিকটিম’। নরওয়েজীয় অপরাধবিজ্ঞানী নিল ক্রিস্টি তাঁর ‘দ্য আইডিয়াল ভিকটিম’ বইয়ে আদর্শ আক্রান্তের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে, যে আক্রান্ত আক্রমণকারীকে সবভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে এবং সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সাবধানতা অবলম্বন করেছে। ক্রিস্টির মতে, ভিকটিম ‘আদর্শ’ না হলে আক্রমণের জন্য তাঁকেও দোষারোপ করা হতে পারে।
কথাগুলো আবার মনে এল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার পর।
দীর্ঘ সেই পোস্টে তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন কীভাবে তাঁকে ক্রমাগত হুমকির মুখে রাখা হয়েছে। সহপাঠীর যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় অনলাইনে এবং বাস্তবে প্রতিনিয়ত তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। অবন্তিকার অভিযোগ, একজন সহকারী প্রক্টর অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অভিযুক্ত সহপাঠীর পক্ষ নিয়ে তাঁকে হয়রানি করতে শুরু করেন। অন্তত সাতবার তাঁকে কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অবমাননা, অপমান ও হয়রানি করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কুৎসা রটানোর মাধ্যমে সামাজিকভাবেও তাঁকে হেয় করা হয়।
যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ‘আদর্শ ভিকটিম’ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আক্রান্ত নারীর পোশাক, আচরণ, কথা, চালচলন, পারিবারিক পরিচয়, আর্থসামাজিক অবস্থান, বন্ধু–স্বজন—হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত নারী ‘ভিকটিম ব্লেমিং’য়ের শিকার হন। মার্কিন মনোবিদ উইলিয়াম রায়ান অবশ্য এই শব্দবন্ধের প্রবর্তন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে। ১৯৭১ সালে ‘ব্লেমিং দ্য ভিকটিম’ নামে একটি বইয়ে তিনি তুলে ধরেন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ ও সামাজিক অবিচার ন্যায্যতা দেওয়া হয় ভিকটিম ব্লেমিং বা আক্রান্তকে দোষারোপের মাধ্যমে। রায়ানের মতে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আদর্শিক অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমেই আক্রান্তকে দোষারোপের এই প্রক্রিয়াকে কার্যকর করা হয়।
আক্রান্তকে দোষারোপ বা ভিকটিম ব্লেমিংয়ের শিকার কি হতে হয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকাকে? যে ফেসবুক পোস্টটি দেওয়ার পর নিজ বাড়িতেই আত্মহননের পথ বেছে নেন আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থী, সে পোস্টটিতে অন্তত বিষয়টা স্পষ্ট। দীর্ঘ সেই পোস্টে তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন কীভাবে তাঁকে ক্রমাগত হুমকির মুখে রাখা হয়েছে। সহপাঠীর যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় অনলাইনে এবং বাস্তবে প্রতিনিয়ত তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। অবন্তিকার অভিযোগ, একজন সহকারী প্রক্টর অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অভিযুক্ত সহপাঠীর পক্ষ নিয়ে তাঁকে হয়রানি করতে শুরু করেন। অন্তত সাতবার তাঁকে কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অবমাননা, অপমান ও হয়রানি করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। কুৎসা রটানোর মাধ্যমে সামাজিকভাবেও তাঁকে হেয় করা হয়।
বন্ধু, সহপাঠী ও স্বজনদের দাবি, অবন্তিকা ছিলেন সপ্রতিভ, আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়চেতা। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ক্যাম্পাসের নানা আয়োজনে উপস্থাপনা করতেন। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্য কাজ করতেন। রংতুলি ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল পাবলিক স্পিকিং ও লিডারশিপ। নিজ জেলা কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কাজ করতে চাইতেন। মানসিক নিপীড়ন নিয়েও অনেক কাজ করেছেন বলে জানা যায়। এমনকি ফেসবুক পোস্টেও নিজেকে ‘ফাইটার’ বলে দাবি করা অবন্তিকা তবে আত্মহননের পথে হাঁটলেন কেন?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আবারও ফিরতে হবে ভিকটিম ব্লেমিংয়ের প্রসঙ্গে। যৌন হয়রানি বা আগ্রাসনের ক্ষেত্রে আক্রান্তদের প্রায়ই ‘সেকেন্ডারি ভিকটিমাইজেশন’–এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেকেন্ডারি ভিকটিমাইজেশন বলতে বোঝায় দ্বিতীয় দফায় তাঁকে আক্রান্ত বোধ করানো। যেমন আক্রান্তের বিবরণ অবিশ্বাস করা, আগ্রাসনের মাত্রা ও প্রভাবকে খাটো করে দেখা, প্রশাসনিক পর্যায়ে বা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অযাচিত, অবমাননাকর বা বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করা। ‘প্যাট্রিলিনিয়াল’ বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যৌনতা নিয়ে নানা ধরনের অপসংস্কার ও বিশ্বাস রয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার নারীকে পতিত বা খুঁতযুক্ত হিসেবে দেখার চল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে যে নারী নিজের প্রতি হওয়া যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁকে বারবার আক্রান্ত হওয়ার ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত নারীবিদ্বেষের কারণে আক্রান্ত নারী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। একজন ব্যক্তি হিসেবে সমাজে তাঁর এজেন্সি অর্থাৎ কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
প্রশাসনিক পর্যায় থেকে আগ্রাসনের শিকার অবন্তিকাও হয়তো এমনটাই বোধ করেছেন। একজন যোদ্ধা, যার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে সে চরম অসহায় বোধ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর এই অসহায়ত্বের কারণ আক্রান্তকে দোষারোপের সংস্কৃতি। কিন্তু আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে অবন্তিকা কি চূড়ান্ত দায়মুক্তিকেই বেছে নিলেন না? প্রতিবার যখন একজন অবন্তিকা আত্মহননকেই বেছে নেন, তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে নিপীড়নকারীরা। নারী হয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার ‘ধৃষ্টতা’ করা যায় না—সমাজে প্রতিষ্ঠা পায় এ বিশ্বাস। আর সেই সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও আরও দৃঢ় হয়।