যেভাবে খেটে খাওয়া মানুষের ‘নায়ক’ হয়ে উঠেছিলেন ফারুক

গতকাল ১৬ মে সোমবার সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন চিত্রনায়ক ফারুক। আজ তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। স্বাধীনতা–উত্তরকালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে তাঁর অবির্ভাব। মানুষও তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন। কীভাবে যেভাবে খেটে খাওয়া মানুষের ‘নায়ক’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি?

‘সুজন সখী’ ছবিতে কবরী ও ফারুক
ছবি: সংগৃহীত

বাংলায় ‘মিয়া’ বলতে বোঝানো হয় ভদ্রলোক। যেভাবে কলকাতায় ‘বাবু’ একটি সম্মানসূচক ডাক, তেমনি পূর্ববঙ্গে ছিল মিয়া। এই মিয়া ডাকে যেমন সম্মান আছে, তেমনি নেতা হিসেবে সমর্থনও আছে। মহাতারকাদের ভিড়ে এই সম্মান আর সমর্থন পেয়েছিলেন একজনই। তিনি নায়ক না হয়ে হয়েছিলেন ‘মিয়া ভাই’।

স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে চলচ্চিত্রই ছিল জনসাধারণের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু গ্রামীণ জনপদের এই দেশের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করছিলেন বড় পর্দার নায়কেরা? শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত তরুণ—যাঁর উচ্চারণে পশ্চিমবঙ্গীয় ধাঁচ স্পষ্ট, তাঁর মধ্যে নিজের ছায়া খোঁজার সাহস কি করতে পারতেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর?

একাত্তর-পরবর্তী বাংলা সিনেমায় তাই উঠে আসতে শুরু করল গ্রামবাংলার মানুষের জীবন, জীবিকা আর সংঘাতের গল্প। তাদের বয়ান ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে শুরু করল রুপালি পর্দায়। আর এই বয়ানের নায়ক গ্রামের সহজ–সরল, সুঠাম যুবক। গ্রামীণ আর্থ-রাজনৈতিক শোষণযন্ত্রের শিকার সে। অন্য অনেক শোষিতের হয়ে যে রুখে দাঁড়ায়, অবলীলায় হাতে তুলে নেয় বইঠা বা চাপাতি। প্রেম তার কাছে হাওয়ার মতোই সহজাত কিন্তু গভীর। মৃত্যু তার কাছে বিশ্বাসের মতোই সাবলীল।

ঢাকাই সিনেজগতের আদি প্রেমের গল্প বলা চলে ‘সুজন সখী’কে । ‘লাইলী-মজনু’, ‘শিরি-ফরহাদ’-এর মতো প্রেমের গল্পগুলো আমদানি করা, নিজস্ব নয়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে ‘সুজন সখী’—যা উঠে এসেছে বাংলার ঘর-পরিবার থেকে, তুলে ধরেছে বাংলার মানুষের জীবনাচরণকে। এই প্রেম আমাদের চেনা প্রেম, চেনা সুখের হাসি, চেনা বেদনার অশ্রু। মুক্তিযুদ্ধ করা টগবগে এক যুবক, পুরান ঢাকায় যাঁর বাড়ি, সেই আকবর হোসেন পাঠান ফারুক অভিনয় করেন ‘সুজন’ চরিত্রে।

‘লাঠিয়াল’ ছবিতে ফারুক
সংগৃহীত

ধরাছোঁয়ার বাইরের স্বাপ্নিক চরিত্র ছিলেন না ফারুক। ফ্যান্টাসি নয়, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে তিনি ধরা দেন—যাঁর ত্রুটি আছে, বল আছে, সামর্থ্য আছে, রাগ-অভিমান-ঘৃণা আছে, প্রেম আছে। যাঁকে জীবিকার জন্য, সামাজিক স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আত্মত্যাগ আর বিসর্জন যাঁর প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। মানুষ তাঁর মধ্য দিয়ে কি রোজকার জীবনের লড়াই আরেকটু চালিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছিল? খেটে খাওয়া মানুষের নায়কোচিত উপস্থাপনের উপলক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ফারুক?

ধরাছোঁয়ার বাইরের স্বাপ্নিক চরিত্র ছিলেন না ফারুক। ফ্যান্টাসি নয়, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে তিনি ধরা দেন—যাঁর ত্রুটি আছে, বল আছে, সামর্থ্য আছে, রাগ-অভিমান-ঘৃণা আছে, প্রেম আছে। যাঁকে জীবিকার জন্য, সামাজিক স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আত্মত্যাগ আর বিসর্জন যাঁর প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। মানুষ তাঁর মধ্য দিয়ে কি রোজকার জীবনের লড়াই আরেকটু চালিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছিল? খেটে খাওয়া মানুষের নায়কোচিত উপস্থাপনের উপলক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ফারুক?

ফরাসি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক জঁ লুই বদ্রির মতে, আদর্শিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা চলচ্চিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কারণ চলচ্চিত্র বাস্তবের প্রতিফলন। পদ্ধতিগতভাবেই চলচ্চিত্র যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। যার ফলে ক্ষমতাসীনের আদর্শিক প্রতিনিধিত্বে সক্ষম। একাত্তর–পরবর্তী রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিশ্চিতে নিপীড়িতের স্বাধীকার অর্জন ও তাকে নায়কের ভূমিকা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধ, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পার করে টিকে থাকা জনপদ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠই গ্রামীণ আর্থ–সামাজিক কাঠামোর অংশ তাঁদের এক সুতোয়া বেঁধে রাখতে চলচ্চিত্রের বিকল্প ছিল না। ভিনদেশী চলচ্চিত্রের প্রবেশ বন্ধ করে সে সময় একটি কেন্দ্রীভূত সাংস্কৃতিক সত্তা গড়ে তোলাই সবচেয়ে নিরাপদ ছিল। সেই বিনির্মাণের নায়ক হয়ে ওঠেন ফারুক।

পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে ৬০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয়ের যে দাপট ফারুক দেখিয়েছেন, তাতে এই কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়াই যায়। সিনেমা থেকে বিদায় নিয়েছেন আগেই, এবার জাগতিক প্রস্থান ঘটল। তবে চলচ্চিত্র দর্শকের হৃদয়ে যে নোঙ্গর গেঁথেছেন, তা রইবে।