প্রায় ৫৪ বছরের কাজকে মোটে চারটা খণ্ডে, ৬০৮ পৃষ্ঠায় ধরাটা যথেষ্ট নয়, তারপরও সম্প্রতি প্রকাশিত শিল্পী রফিকুন নবীর (রনবী) ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত টোকাই ও অন্যান্যতে সেটাই করা হয়েছে। আর কাজটির সম্পাদনা করেছেন শিল্পী স্বয়ং। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়েও বেঁচে গিয়ে তাঁর মনে হলো, এত দিনের ছড়ানো–ছিটানো সব কার্টুন ইত্যাদি নিয়ে একটা বই অন্তত করে ফেলা যাক।’ যাঁরা এতে বারবার তাঁকে তাড়া দিতেন, তাঁদের অনেককেই গত কয়েক বছরে হারিয়েছেন, বিশেষ করে করোনার সময়ে আচমকা চলে গেছেন অনেক কাছের বন্ধুস্থানীয় সজ্জন। এত দিনের পুরোনো সব কাজ জোগাড় করাটা অসম্ভব কঠিন, তাতে সন্দেহ নেই। সময়টা অর্ধশতকের বেশি, আর তার মধ্যে সেই পুরোনো সাদা-কালো যুগের নিউজপ্রিন্ট ম্যাগাজিন, যা শিল্পীর ভাষায়—‘আজ মিসরীয় ভূর্জপত্রের মতো ঝুরঝুরে’। সেসব থেকে ড্রয়িংয়ের কালো লাইন বের করে আনা যথেষ্ট খাটুনির কাজ। গ্যালারি চিত্রকের সহায়তায়, শিল্পীর তত্ত্বাবধানে সেই কাজই করা হয়েছে চার খণ্ডের টোকাই ও অন্যান্য সংকলনে।
রনবী তাঁর টোকাই ও অন্যান্য সংকলনের চারটি খণ্ড উৎসর্গ করেছেন চারজনকে। প্রথম খণ্ড বন্ধু ও শিল্পী শাহাদাত চৌধুরীকে। সাপ্তাহিক বিচিত্রা সম্পাদক বাংলাদেশের পত্রিকাজগতের অন্য আরও অনেক আধুনিক সংযোজনের পাশাপাশি কার্টুনেরও বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। টোকাই আঁকার আগেও রনবী বেশ কিছু পত্রিকায় কার্টুন আঁকতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু সাড়া পেয়েছিলেন সামান্যই। এদিকে বরং সাংবাদিক ও প্রকাশক শাহাদাত চৌধুরীর নিয়মিত অনুপ্রেরণায় বিচিত্রা ও টোকাই প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। আর এরপর তো তা ইতিহাস। পাঠকেরা বসে থাকত পরের সংখ্যায় টোকাই কী করবে, তা ভেবে। এক যুগল নাকি রীতিমতো বাজি ধরতেন পরের টোকাইয়ে কী আসবে তা নিয়ে। আবার এক দম্পতি টোকাইয়ের এতটাই ভক্ত ছিলেন যে তাঁদের প্রথম সন্তানের ডাকনামই রেখে ফেলেছিলেন টোকাই!
টোকাই নিয়ে কথা চললেও সংকলনটিতে বারবারই ঘুরেফিরে এসেছে ‘অন্যান্য’ শিরোনামের মধ্যে থাকা বিচিত্র সব কাজ। শিল্পীর ভাষায়, ‘আমার কার্টুনযাত্রা শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে। সরকারবিরোধী এবং প্রতিবাদী আন্দোলন চলাকালীন মিটিং-মিছিলের জন্য পোস্টারে কার্টুন আঁকা দিয়ে সেই হাঁটার শুরু।… সেই বিপজ্জনক আঁকাজোকা ছিল তাৎক্ষণিক কর্মকাণ্ড। মিছিলে থাকত, দেয়ালে সাঁটা হতো। তারপর সেসব হারিয়ে যেত, নষ্ট হয়ে যেত।’ এসব কাজের সময় সেই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। গণজাগরণের প্রয়োজনে অসংখ্য কার্টুন-পোস্টার এঁকেছিলেন রনবী। তা দেখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁকে ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, হামিদা হোসেন প্রমুখদের জনপ্রিয় ইংরেজি সাপ্তাহিক ফোরাম পত্রিকার প্রচ্ছদ আঁকায় নিযুক্ত করেছিলেন। সেখানে একাধিক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কার্টুনের জন্ম হয় রনবীর হাতে। ১৯৭০-এর নির্বাচনকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত তৈরিতে এ পত্রিকার ভূমিকা ছিল অসামান্য। একইভাবে পরবর্তীকালে জহির রায়হান, গাজী শাহাবুদ্দিন, আলমগীর কবির প্রমুখদের ইংরেজি পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস-এও কার্টুন আঁকেন রনবী। এরপর পর্যায়ক্রমে দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক ২০০০, দৈনিক জনকণ্ঠ, পাক্ষিক—এসবে চলেছে ধারাবাহিকভাবে। মাঝখানে এমনকি কাজ করেছিলেন পুলিশের ডিটেকটিভ পত্রিকায়ও। নিজের বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ফলে পুলিশ নিয়ে আঁকায় তাঁর কাছ থেকেও শুনতে হয়েছে কৌতুকীয় ভর্ৎসনা। এ সংকলনে এর অনেক কাজই জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সাদা-কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগের কাজও এতে আছে, এমনকি স্থান পেয়েছে অতি সম্প্রতি প্রথম আলোর প্রচ্ছদ হিসেবে আঁকা অনন্যসাধারণ কার্টুনপত্রসমূহও।
টোকাইসহ রফিকুন নবীর অন্য সব কার্টুন একসঙ্গে করে সম্প্রতি গ্যালারি চিত্রক প্রকাশ করেছে ‘টোকাই ও অন্যান্য’ নামে চার খণ্ডের অনবদ্য এক সংকলন।
ভূমিকায় রনবী তাঁর অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে চলা এই কার্টুনযাত্রার কথা বলেছেন আর সেই সঙ্গে বলেছেন সেই সময়ের দুরূহ ও সমস্যাসংকুল কাজের পরিবেশের কথা, তখন প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতায় আঁকতে হয়েছে সীমিত উপকরণ অবলম্বন করে, আঁকতে হয়েছে চটজলদি। টোকাইয়ের বড় অংশই ডেডলাইনের শেষ মুহূর্তে ক্রোক্যুইল নিবে আর কালিতে টানের ওপরে কোনো খসড়া ছাড়াই করতে হয়েছে আঁকার জন্য কষ্টসাধ্য খসখসে ট্রেসিং পেপারে। আর সব কষ্টের নামমাত্র যে সম্মানীর জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকতেন, তা বেশির ভাগ জায়গা থেকেই জুটত না তখন। তাঁর মতে, তখন আক্ষরিক অর্থেই কাজটা দেশের জন্যই করা ছিল। দায়বদ্ধতার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাঁর পিতার মৃত্যুদিনেও বিচিত্রার জন্য কার্টুন আঁকার কথা। তাঁর কথায়, মুক্তিযুদ্ধে অমানিশায় মানুষ বছর ধরে হাসতে ভুলে গিয়েছিল। সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে কেন্দ্র করে তাঁর কার্টুন মানুষকে আবার হাসানোর একটা চেষ্টা হিসেবেও এসেছিল তখন সুচিন্তিতভাবে।
সংকলনের একেক খণ্ডে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একেকজনের উদ্ধৃতি। প্রথম খণ্ডেই আছে বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর কথা। এরপর আছেন বুলবন ওসমান, আছেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ। আরেক খণ্ডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও কার্টুন গবেষক শুভেন্দু দাশগুপ্তের মতে, টোকাই কথা বলে নিজের সঙ্গে, আবার নিজের বয়সী সবার সঙ্গে, মাঝেমধ্যে উচ্চবিত্ত, মাঝেমধ্যে মধ্যবিত্তের সঙ্গে। সে প্রশ্নের উত্তর দেয় তার মতো করে। আর আমেরিকার বিখ্যাত কার্টুন জার্নালিস্ট, এনসাইক্লোপিডিয়া অব কার্টুনস-এর সম্পাদক জন এ লেন্ট টোকাই সম্পর্কে এ সংকলনের চতুর্থ খণ্ডে বলেছেন, বাংলাদেশের কার্টুন স্ট্রিপ যা দেখা যেত, তা প্রথম থেকেই মূলত বিদেশি কার্টুন কমিকসের অনুবাদ। ব্যতিক্রম টোকাই, যা পুরোপুরি এ দেশি।
আশি ও নব্বইয়ের দশকের তরুণ যুবক, যাঁরাই এ কাজ দেখে বড় হয়েছেন, তাঁদের জন্য এটা অসামান্য আকরগ্রন্থ, একনিমেষেই সময় পরিভ্রমণে যেন ফিরে যাবেন তাঁদের সেই সময়ে। আর নতুন গবেষকদের জন্যও এত এত কাজ নিয়ে এই পুরো সময়ে ছোট ছোট সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকা রনবীর কার্টুন অবশ্য পাঠ্য। আর একটা দারুণ তথ্য শেষে দেওয়া উচিত, সংকলনটির দুই সেট কেউ জোগাড় করলেই তিনি পাবেন স্বয়ং রনবীর হাতে আঁকা একটি অরিজিনাল টোকাই ড্রয়িং! ১৯৬৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আঁকা রনবীর চার খণ্ডের এই কার্টুনের সংলনটি পাওয়া যাবে ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে। প্রতি খণ্ডের দাম ৮০০ টাকা।