সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিলস দেখে আপনি যে বিপদ ডেকে আনছেন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত রিলস দেখার ফলে ব্রেইন রটের খপ্পরে পড়ছেন না তো!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিম আর রিলস দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিচ্ছেন? কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছেন না? আপনি সম্ভবত ‘ব্রেন রট’-এ আক্রান্ত। স্মার্টফোনে সীমাহীন স্ক্রলিং আর অনুভূতি ভোঁতা করে দেওয়া কনটেন্টের প্লাবন নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে অক্সফোর্ড বর্ষসেরা শব্দ নির্বাচিত হয়েছে ‘ব্রেন রট’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মস্তিষ্কে পচন’। ব্রেন রটকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, ‘একজন ব্যক্তির মানসিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার অনুমিত অবনতি, বিশেষত দেখা হচ্ছে এমন সব বস্তু অতিরিক্ত ভোগ করাকে (এখন বিশেষ করে অনলাইন কনটেন্ট), যেগুলো লঘু এবং চিন্তা উদ্দীপক নয়।’  

অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস–নির্ধারিত ৬টি শব্দের মধ্যে ৩৭ হাজারের বেশি ভোটে বিজয়ী হয়েছে ব্রেইন রট। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বলছে, ‘এই শব্দ ২০২৪–এ এসে নতুন করে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যেহেতু এটি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত মাত্রায় নিম্নমানের অনলাইন কনটেন্ট ভোগের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগকে ধারণে ব্যবহৃত হয়।’

অক্সফোর্ড ভাষা সভাপতি ক্যাসপার গ্র্যাথওল বলছেন, ‘ব্রেন রট ভার্চ্যুয়াল জীবনের যে বিপদগুলো আমরা অনুভব করি, তার একটি এবং কীভাবে আমরা আমাদের অবসর সময়কে ব্যবহার করছি, তার কথা বলে। এটা মানবতা এবং প্রযুক্তি নিয়ে সাংস্কৃতিক আলাপচারিতার ন্যায়সংগত–পরবর্তী অধ্যায় বলে মনে হচ্ছে।’

ক্যাসপার গ্র্যাথওল আরও বলেন, ‘আমার কাছে বিষয়টা আরও চমকপ্রদ যে ব্রেন রট শব্দটি জেন–জি এবং জেন–আলফা গ্রহণ করেছে, সেই সম্প্রদায়, যারা মূলত সেসব ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার ও তৈরির জন্য দায়ী—যেগুলোকে এই শব্দ নির্দেশ করে।’

শব্দটি শুরুর দিকে কেবল জেন–জি ও জেন–আলফা সম্প্রদায়েই ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছিল। তবে এখন মূলধারায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাপ্ত নিম্নমানের কনটেন্ট বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২৩–এর চেয়ে ২০২৪–এ ২৩০ শতাংশ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এ শব্দটি।

যদিও ব্রেন রটের প্রথম ব্যবহার নথিবদ্ধ হয়েছে ইন্টারনেটের জন্মের বেশ আগে ১৮৫৪ সালে, মার্কিন দার্শনিক হেনরি ডেভিড থারোর বই ‘ওয়াল্ডেন’-এ। জটিল ধারণার অবমূল্যায়নের সামাজিক প্রবণতা এবং কীভাবে তা মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সার্বিক অবনতির অংশ, তা তুলে ধরতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন থারো। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ইংল্যান্ড যখন আলুর পচন রোধে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন মস্তিষ্কের পচন রোধে কোনো উদ্যোগ কি নেবে না, যা আরও অনেক ব্যাপক এবং মারাত্মকভাবে আগ্রাসী।’

মনোবিজ্ঞানী এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু শিবিলস্কি বলছেন, ব্রেন রট শব্দটির জনপ্রিয়তা ‘আমরা যে সময়ে বাস করছি, তার উপসর্গ’। তিনি বলেন, ‘মস্তিষ্কের পচন আসলেই ঘটছে কি না, তার কোনো প্রমাণ নেই। বরং এটা অনলাইন–দুনিয়া নিয়ে আমাদের অসন্তোষকেই তুলে ধরে। আসলে এটা এমন একটা দুনিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ঘিরে আমাদের যেসব উদ্বেগ রয়েছে, সেগুলোকে জড়ো করতে যা আমরা ব্যবহার করি।’

অনলাইনে নিম্নমানের কনটেন্ট গ্রাসের এই প্রবণতা থারোর শঙ্কার ভয়াল প্রকাশ যেন। চিন্তার খোরাক জোগানো সৃজনশীল চর্চার পরিধি এবং স্থায়িত্ব কেবলই কমছে। স্মার্টফোন পকেটে নিয়ে জন্মানো এবং বেড়ে ওঠা জেন–জি ও জেন–আলফারা দিনে রাতে মুখ ডুবিয়ে রাখছেন স্ক্রিনে। মিম, রিলস, শর্টস, স্টোরিজ, পোস্ট—স্ক্রলিং চলছে তো চলছেই। মানহীন ও অর্থহীন কনটেন্ট অতিরিক্ত ভোগ মস্তিষ্ককে চিন্তা না করতে কন্ডিশন করছে ক্রমে। সেই সঙ্গে প্রদর্শন ও অনুকরণের আকাঙ্ক্ষায় এই কনটেন্টভোগীরা জন্ম দিয়ে চলেছেন একই ধরনের কনটেন্টও। ফলে পুনরাবৃত্তির এমন এক চক্র সৃষ্টি হচ্ছে, যার কোনো অন্ত নেই।