কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখালেখি করেই অন্নসংস্থান করতেন। নিজেকে বলতেন ‘কলম-পেষা মজুর’। তাঁর মতে, ‘হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না।’ রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার কোনো ম্যাজিক নেই। লেখককে অনেক কাল আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়, ‘লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’ সেই প্রস্তুতিটা কী? ‘লেখকের কথা’ বইয়ে মানিক লিখেছেন, ‘চারপাশের বাস্তব জীবনকে গভীরভাবে জানা এবং ব্যাপকভিত্তিক সাহিত্যপাঠই হলো সেই প্রস্তুতি।’
নিজেই চেয়েছিলেন বয়স ত্রিশের চৌকাঠ পেরোনোর আগে আনুষ্ঠানিক লেখালেখির উঠানে পা না রাখতে। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে একবার মাসিকপত্রের সম্পাদকের জ্ঞানগম্যি নিয়ে তর্কের সূত্র ধরে গল্প লিখে বসলেন। বয়স তখন ২০ হলে কী হবে! পেকে গিয়েছিলেন আগেই। ছোটবেলায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার, নজরুল পড়েছেন ঢের। পড়েছেন বিদেশি সাহিত্য এমনকি ফ্রয়েডও।
‘অতসী মামী’ নামে সে গল্প প্রকাশিত হলে কেবল শোরগোল পড়ে গেল না, স্বয়ং সম্পাদক মহোদয় বাড়িতে এসে হাজির হলেন। হাতে গল্পের সম্মানীর খাম, সঙ্গে আরেকখানা গল্প দেওয়ার অনুরোধ।
এর পরের ১২ বছরের মধ্যেই বের হলো উপন্যাস ‘জননী’ (১৯৩৫), ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘শহরতলী’ (১৯৪০-৪১)। সাহিত্য-আলোচকদের মতে, এসবই ছিল তাঁর যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার ফল। নইলে এত অল্প সময়ে এত এত বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম করা একপ্রকার অসম্ভব।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জীবন মাত্র ২৮ বছরের। বেঁচে ছিলেন মোটে ৪৮ বছর। এই কয় বছরে রচনা করেছেন অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও ২২৪টি গল্প।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষ এই বঙ্গের বিক্রমপুরের মানুষ। মানিকের বাবা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। পিতার কর্মস্থল বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে মানিকের জন্ম (১৯০৮-১৯৫৬)। মানিককে দুমকা, আড়া, সাসারাম, কলকাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বারাসাত, টাঙ্গাইল ও মেদিনীপুরের নানা স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। তা ওই বাবার বদলির চাকরির কারণেই। নতুন নতুন জায়গা তাঁর শিশু ও কিশোরকালকে দিয়েছিল নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। সব সময় তিনি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন। এই অনুসন্ধিৎসাই তাঁকে বানিয়েছে বড় কথাকার।
দুই.
একজন লেখক কেবল লিখে বা কলম পিষে কি জীবিকার বন্দোবস্ত করতে পারেন? মানিক নিজে অবশ্য তাই করেছেন। যদিও চরম দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল। আত্মীয়স্বজনও দু-চার কথা বলতে ছাড়েননি, ‘তোর দাদা লেখাপড়া শিখে দুই হাজার টাকার চাকরি করছে, তুই কী করলি বল তো মানিক? না একটা বাড়ি, না একটা গাড়ি।’
‘লেখকের কথা’ বইয়ে ‘লেখকের সমস্যা’ প্রবন্ধে লেখকসত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন মানিক। বলেছেন নিজের অভিজ্ঞতাও। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, তবে বইয়ের প্রবন্ধগুলো ১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে রচিত বলে ধারণা করা হয়।
মানিক লিখছেন, কোনো লেখক নামকরা না হলেও তাঁর একটি ভালো বই যখন হাজার হাজার কপি হু হু করে বিক্রি হয়ে যায়, তখন সে লেখককে জীবিকার জন্য চিন্তা করতে হয় না। বিশেষ করে লেখক যদি অন্য ভাষার লেখক হন। কিন্তু বাংলা ভাষার সাহিত্যিকের জীবিকার সমস্যা যেন মেটে না। কারণ, এখানে ‘বিখ্যাত লেখকের নামকরা বইয়ের বিক্রি এত কম এবং বিক্রিটাও ধীরে-সুস্থে এত দিন ধরে হয় যে চার-পাঁচখানা নামকরা বই লেখার পরেও লেখকের জীবিকার সমস্যা ঘোচে না।’
তা ছাড়া কাগজের মালিক ও প্রকাশকদের মাধ্যমেও খাঁটি লেখক ঠকেন। মানিক লিখছেন, ‘কাগজের মালিকের চেষ্টা যত পারা যায় কম টাকা দিয়ে ভালো লেখা আদায় করা।’ আর প্রকাশক কতখানা বই ছাপছেন, সংস্করণ শেষ হওয়ার খবরটাও স্রেফ চেপে যাবেন। বইটার নতুন সংস্করণের জন্য পাওনা টাকাটা লেখক পাবেন অনেক দেরিতে।
তাহলে সমাধান কী? একজন খাঁটি লেখক কীভাবে সমাজে বেঁচে থাকবেন?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে লিখছেন, নিজেকে পেশাদার লেখকে পরিণত করলে সপরিবার মোটামুটি বেঁচে থাকার মতো অর্থ উপার্জন করা যায়। কিন্তু এ জন্য তাঁর ভাষায়, ‘সাহিত্যিকের পালনীয় প্রথম ও প্রধান নীতিটা’ বাতিল করতে হয়। অর্থাৎ এ জন্য সাহিত্যের আদর্শ বিক্রি করতে হয়, আত্মবিক্রয় করতে হয়। এই আত্মবিক্রয়ের সুযোগ কখন একজন সাহিত্যিকের জোটে? যখন সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লড়াই করতে করতে নাম হয়, তখনই আত্মবিক্রয়ের সুযোগ জোটে।
কিন্তু মানিক কি এই নীতি সমর্থন করেছেন? এককথায় উত্তর হলো, ‘না’। তিনি স্পষ্টভাবে বলছেন, ‘শিল্প–সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলে খাঁটি শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না।’ টাকার জন্য লিখলে লেখকের ক্ষমতা অনুসারে লেখার যে মান হওয়া উচিত, লেখা তার চেয়ে নিচু স্তরের হয়ে যাবেই।
সাহিত্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলে সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা অনেকখানি হারিয়ে ফেলেন। লেখায় যথেষ্ট সময় তিনি দিতে পারেন না। নিজের জীবনদর্শনের সত্যটিকে রূপায়িত করার স্বাধীনতাও সংকীর্ণ হয়ে যায়। কতটা সময় দিয়ে কতটা লিখলে পেট চলবে, এই হিসাব তো করতেই হয়, সঙ্গে তাঁকে যাঁরা টাকা দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁর বক্তব্য কীভাবে নেবেন, তা–ও ভাবতে হয়।
আর লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিলে বেশি লিখতে বাধ্য হন লেখক। যতই নামকরা লেখক হোন না কেন, নতুন চিন্তা আর অভিজ্ঞতার কতই–বা তাঁর পুঁজি। পুঁজি খরচ করে বই লিখে তবেই না নামকরা লেখক হয়েছেন। পুঁজি ফুরিয়ে গেলে উপায় কী! ভালো লেখা কোথা থেকে আসবে!
সাহিত্যকে পেশা করলে লেখককে কমবেশি মন জোগাতে হয় পাঠক-পাঠিকার! মানিকের মতে, ‘বাংলার পাঠক-পাঠিকারাই পেশাদার সাহিত্যিকের লেখার স্বাধীনতা হরণ করেন।’
মানিকের মতে, একজন লেখক, একজন কেরানি ও একজন মজুর। এর মধ্যে কেরানি ও মজুর তাঁদের মালিকের কাছে অর্থের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু লেখক মজুর বা অল্প বেতনের কেরানি নন, শ্রমটাই তাঁর একমাত্র পণ্য নয়। লেখকের পক্ষপাতিত্বের মূল্য এত বেশি যে তাঁর শ্রমের মূল্য বিচার তুচ্ছ হয়ে যায়।
নিজস্ব একটা জীবন-দর্শন ছাড়া সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়। টেবিলে বসে বসে কেবল লেখা আর প্রুফ সংশোধন করার শ্রম নয়, সব সময় সর্বত্র জীবনকে দর্শন করার বিরামহীন শ্রমও লেখককে চালাতে হয়। ‘পদ্মানদীর মাঝি’র লেখকের মতে, যত বড় প্রতিভাই থাক, এই বিরামহীন শ্রম বা সাধনায় ঢিল পড়ার অর্থই লেখক ও লেখার অধঃপতন।
লেখক বলতে মানিক সৎ ও আদর্শনিষ্ঠ লেখকদেরই ধরেছেন, ‘পুরস্কার বা সুবিধার বিনিময়ে অর্থাৎ সোজাসুজি ঘুষ খেয়ে যাঁরা নাম ও প্রতিভা, জনসাধারণের শোষকদের স্বার্থে স্বেচ্ছায় কাজে লাগান তাঁদের নয়।’
টাকার জন্য লিখলে সাহিত্যের ও সাহিত্যিকের মৃত্যু অবধারিত। মানিকের মতে, যে ‘পেশাদার’, সে সাহিত্যিক নয়। তার চেয়ে লেখক চাকরি করুন, জীবনবিমার দালালি করুন, জিনিসপত্র ফেরি করুন—বাঁচার জন্য কিছু একটা সাহিত্যিককে করতেই হবে। এ বাস্তবতা না মেনে উপায় নেই।