তারকাদের আমরা অনলাইনে গালি দিই কেন
যে তারকাদের একনজর দেখার জন্য বিশ্বজুড়ে ভক্ত–অনুরাগীরা ব্যাকুল হয়ে থাকেন, তাঁরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারকাদের নিয়ে কীভাবে ট্রল করেন? এই ট্রলিংয়ের পেছনে কাজ করে কোন মনস্তত্ত্ব?
সেলেনা গোমেজ বিশ্বের প্রথম নারী, ইনস্টাগ্রামে যাঁর অনুসারীসংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪০০ মিলিয়ন। অনুসারীর সংখ্যায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর লিওনেল মেসির পরের স্থানটিই তাঁর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি অনুসারী শুধু একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই। এ ছাড়া এক্স (টুইটার), ফেসবুক, টিকটকেও আছে তাঁর সরব পদচারণ। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের একনিষ্ঠ মনোযোগ ছেড়ে মাঝেমধ্যেই হাওয়ায় মিলিয়ে যান সেলেনা। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগের তার ছিন্ন করে দেন। এর কারণ—ট্রলিং।
‘ট্রল’—শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দত্যি বা দানো, ওই যে রূপকথার গল্পে যেমনটি পড়েছি। তবে মজার বিষয় হলো, ট্রল বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা অনলাইনে অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত বা উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে বিরূপ আর ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে চান। মূলত অপর পক্ষকে উসকে দেওয়ার মাধ্যমে আমোদ লাভ করেন ‘ট্রল’ নামক ওই ব্যক্তি । বেশির ভাগ সময়ই অর্ধসত্য বা মনগড়া তথ্য ছড়িয়ে যথাসম্ভব বেশি মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করাই তাঁর উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
শিশুশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা সেলেনা ট্রলিংয়ের শিকার হয়েছেন নানাভাবে। দৈহিক গড়ন, পোশাক, প্রেমের সম্পর্কে বিচ্ছেদ, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা কোনো ছবি নিয়েও ব্যাপকভাবে ট্রল করা হয়েছে তাঁকে। এ বছরের গোড়া থেকেই জাস্টিন বিবারের সাবেক স্ত্রী হেইলি বিবারের একটি পোস্টকে ঘিরে ট্রলিংয়ের জেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিরতি নিতে বাধ্য হন সেলেনা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ট্রলিং তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য কিছুটা হলেও বিগড়ে দিয়েছে। সেলেনার সমসাময়িক সংগীতশিল্পী ডেমি লোভাটো কিংবা মাইলি সাইরাসও বারবার ট্রলিংয়ের শিকার হয়েছেন এবং এটা তাঁদের বাস্তব জীবনকে কতটা বিপর্যস্ত করে তোলে, তা নিয়ে বিশদে কথা বলেছেন।
আমাদের দেশের সাকিব আল হাসান কিংবা তামিম ইকবালরাও পান থেকে চুন খসলেই নানাভাবে ট্রলিংয়ের শিকার হয়ে আসছেন। আর পরিমণী? তিনি তো নিয়মিতই অনলাইনে ট্রলিংয়ের শিকার হন। শুধু পরিমণী কেন, দেশের অধিকাংশ তারকাকে ট্রল করে বা গালি দিয়ে আমরা যেমন ঐশ্বরিক আত্মতৃপ্তি লাভ করি, তেমনি নিজেদের অবদমিত ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা মওকাও কি পাই না?
আমাদের দেশের সাকিব আল হাসান কিংবা তামিম ইকবালরাও পান থেকে চুন খসলেই নানাভাবে ট্রলিংয়ের শিকার হয়ে আসছেন। আর পরীমনি? তিনি তো নিয়মিতই অনলাইনে ট্রলিংয়ের শিকার হন। শুধু পরীমনি কেন, দেশের অধিকাংশ তারকাকে ট্রল করে বা গালি দিয়ে আমরা যেমন ঐশ্বরিক আত্মতৃপ্তি লাভ করি, তেমনি নিজেদের অবদমিত ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা মওকাও কি পাই না?
এখন প্রশ্ন ওঠে, যে তারকাদের একনজর দেখার জন্য বিশ্বজুড়ে ভক্ত–অনুরাগীরা ব্যাকুল হয়ে থাকেন, তাঁদের পারফরম্যান্সের সাক্ষী হতে যেকোনো কিছু করতে রাজি থাকেন, সেসব ভক্ত–অনুরাগীরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তারকাদের নিয়ে কীভাবে ট্রল করেন? তারকাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, দৈহিক গড়ন বা পোশাক নিয়ে নোংরা সমালোচনা কিংবা ব্যক্তিগত আক্রমণ তাঁরা করেন কেন? আর এই ট্রলিংয়ের পেছনে কাজ করে কোন মনস্তত্ত্ব?
লন্ডনভিত্তিক দাতব্য সংগঠন ‘সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেইট’ বলছে, এত দিন মনে করা হতো, যাঁরা ট্রল করেন, তাঁরা অপ্রাপ্তবয়স্ক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে অনভিজ্ঞ এবং মানুষকে উসকে দিয়ে এই শ্রেণী একধরনের বিকৃত আমোদ বা ক্ষমতায়নের শক্তির স্বাদ পায়। কিন্তু বিষয়টি এতটা সরল নয়। বিশেষত লাখোকোটি অনুসারীর মালিক তারকাদের যখন টার্গেট করছে ট্রলরা, তখন এর পেছনের উদ্দেশ্যটাও জটিল।
তথ্য অনুসন্ধান, তথ্যপ্রাপ্তি এবং অন্য মানুষ কী ভাবছেন, তা জানার অন্যতম উৎস এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানুষ দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্ক্রল করে জেনে নিচ্ছেন তাঁর পরিবারে, সমাজে, সম্প্রদায়ে এমনকি গোটা দুনিয়ায় কী ঘটছে। একই সঙ্গে নিজের মন ও চিন্তাধারায় অন্যকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগও করে দিচ্ছেন। আর তথ্য ও চিন্তা আদান–প্রদানের এই প্রক্রিয়াকেই কাজে লাগাচ্ছে ‘ট্রল’ নামের ব্যক্তিগণ। সিসিডিএইচ তাদের নির্দেশিকা ‘ডোন্ট ফিড দ্য ট্রল’–এ বলছে, ট্রলরা এখন সুসংহত ও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। বিশ্বজুড়েই জ্ঞান, মতামত ও সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রলিং। অবশ্য শুধু ট্রলিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কাজেই এর পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে‘মিসইনফরমেশন’ বা ভুল তথ্য, উপস্থাপন করা হচ্ছে বিকল্প সত্য বা তথ্য। এছাড়া প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড তো রয়েছেই।
কিন্তু ট্রলিংয়ের মাধ্যমে যে ধারাবাহিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটছে, তা সূক্ষভাবে আমাদের সামষ্টিক অবচেতনের রূপরেখা পাল্টে দিচ্ছে। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি সম্পর্কে একটি কটু কথা বা বিরূপ মন্তব্যকে শুরুতে হয়তো আমরা গ্রহণ করছি না। তবে যখন আলোচনাটি বিস্তার লাভ করছে এবং বহুজনের মত এতে যুক্ত হচ্ছে, তখন তা একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, এটি ক্রমাগত মত উৎপাদন করে যাচ্ছে, যা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই থাকছে না। আর যদি তা হয় একটি দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি অনুসারীর কোনো তারকা সম্পর্কে, তখন তা ছড়িয়ে যাচ্ছে রকেটের গতিতে।
কীভাবে নিস্তার পাবেন ট্রলিংয়ের হাত থেকে
তবে ট্রলিংয়ের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায়ও রয়েছে।
প্রথমত, ট্রলদের বিরুদ্ধে কখনো আত্মরক্ষার চেষ্টা করা যাবে না। কারণ, তারা সেটাই চায়। এই ফাঁদে পা দিলেই আপনি এক অনন্ত তর্কের চক্রে বাঁধা পড়বেন। আর এতেই ট্রলের মনোযোগ পাওয়ার উদ্দেশ্য সফল হবে। কাজেই তর্কে জেতার কোনো চেষ্টাই করবেন না। ট্রলের অসত্য, ভুল, বিকৃত তথ্য সংশোধনের চেষ্টা করা মানে দত্যিকে খাবার দেওয়া। সে যত খাবে, তত বড় ও শক্তিশালী হবে।
দ্বিতীয়ত, কেউ আক্রমণাত্মক মন্তব্য করলেই ব্লক করে দিন। দরকার হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখুন।
তৃতীয়ত, আপনাকে আক্রমণ করা হয়েছে, এমন কোনো পোস্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ, এ ধরনের পোস্টে ট্রল আকৃষ্ট হবে এবং আবার ট্রলিংয়ের শিকার হতে পারেন আপনি। সবশেষে, প্রমাণ রাখুন এবং প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত পরিসর নির্ধারণের প্রক্রিয়া সহজ নয়। গতিশীল জীবনে প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে যোগাযোগ ও সামাজিকীকরণের পদ্ধতি। আর প্রতিনিয়তই পাল্টে যাওয়া এসব পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে আমাদের। এ ক্ষেত্রে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যক্তিপরিসর ও জনপরিসর সুনির্দিষ্ট রাখা প্রয়োজন। নতুবা ট্রলিংয়ের আগ্রাসনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।