মায়োকভস্কি: এক বিপ্লবের কবি

১৯ জুলাই ছিল বিপ্লবী রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়োকভস্কির জন্মদিন।

ভ্লাদিমির মায়োকভস্কি
ছবি: সংগৃহীত

মস্কোর সকাল সেদিন গুমোট কালো মেঘে ঢাকা। তুষার পড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতিতে তখন বসন্ত বিদায়ের তাড়া। মস্কোভা নদী কুড়িয়ে নিয়ে চলেছে শেষ উষ্ণ জলরাশি কাস্পিয়ান সাগরের বুকে। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। এক প্রতিবেশী ছুটে গিয়ে উঁকি মারলেন জানালা দিয়ে। নিথর দেহে পড়ে আছেন কবি। হায় নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাস!

১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন রাশিয়ার অন্যতম বিপ্লবী কবি ভ্লাদিমির মায়োকভস্কি। যিনি মনে করতেন, জীবন থেকেই জন্মলাভ করে কবিতা। জীবনের বন্ধুর পথের বাঁকে বাঁকে ঘাত-প্রতিঘাত, উৎকণ্ঠা-হতাশা, সংগ্রাম-সংকটের মধ্য দিয়ে কবিতা হয় পরিপুষ্ট। আর তখন তা হয়ে ওঠে বিপ্লবের সহচর, সংগ্রামের হাতিয়ার, নিঃসঙ্গতার একান্ত সঙ্গী। এই স্বল্পায়ুর জীবনে বারবার তাঁকে হাঁটতে হয়েছে প্রতিকূল-সংগ্রামী পথে।

জন্ম ১৮৯৩ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তভুর্ক্ত জর্জিয়ায়। অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে ১৯০৬ সালে মায়ের সঙ্গে পাড়ি জমান মস্কোতে। ভর্তি হন মস্কোর একটি স্কুলে। কিন্তু বেতন দিতে না পারায় বহিষ্কৃত হতে হয়। এ সময় কিছু বিপ্লবীর সঙ্গে তাঁর পারিচয় ঘটে। যোগ দেন রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কাস পার্টিতে। একই সঙ্গে মনোনিবেশ করেন করেন মার্কসীয় সাহিত্যে।

১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যে গোপন প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা, সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও এক জর্জিয়ান বিপ্লবী নারীকে জেল থেকে পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন পরপর তিনবার। কারাগারের এই গুমোট জীবন তাঁর জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এখানেই তাঁর কবিতার চর্চা শুরু। লিখে ফেলেন জীবনের প্রথম কবিতা, যে কবিতাকে পরবর্তী সময়ে তিনি উল্লেখ করেন ‘চমৎকার এক বিপ্লবী আবোলতাবোল কবিতা’ হিসেবে।

রাশিয়ার ফিউচারিজম আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মায়োকভস্কি। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শিল্প-সাহিত্যকে সব সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্ত করা। এ আন্দোলনের ইশতেহার ‘জনগণের রুচির মুখে চপেটাঘাত’–এর জন্য ছিল একটা স্লোগানও, ‘মডার্নিটির জাহাজ থেকে ফেলে দাও পুশকিন, দস্তয়ভস্কি আর তলস্তয়কে।’ তাঁরা বিশ্বাস করতেন সৃষ্টির জন্য এই ধ্বংস অনিবার্য। এ সময় থেকে মায়োকভস্কির কবিতা ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকে দৃঢ়, শাণিত, মেদহীন:
‘আমরা করেছিলাম আক্রমণ।
শেল আর মর্টার নিয়ে,
ভিনদেশে পলায়নরত,
শেষ শেতাঙ্গ সৈন্যদলের ওপর।’

১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত ‘ট্রাউজার পরা মেঘ’ কবিতাটি। এটা মূলত আত্মকথনমূলক কবিতা। যেখানে নানা রূপকে উঠে এসেছে ব্যক্তিজীবনের পাওয়া না পাওয়াজনিত বেদনা, সংকট-সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার আশাবাদ:
‘মারিয়া!
কীভাবে আমি জায়গা দেব নাজুক পৃথিবী এই স্ফীত কানে?
তার চেয়ে ঢের ভালো,
যে পাখি ভিক্ষা মাগে,
ক্ষুধার্ত কণ্ঠে,
কিন্তু আমি তো একটা মানুষ,
মারিয়া!’

রাশিয়ার ফিউচারিজম আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মায়োকভস্কি। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শিল্প-সাহিত্যকে সব সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্ত করা। এ আন্দোলনের ইশতেহার ‘জনগণের রুচির মুখে চপেটাঘাত’–এর জন্য ছিল একটা স্লোগানও, ‘মডার্নিটির জাহাজ থেকে ফেলে দাও পুশকিন, দস্তয়ভস্কি আর তলস্তয়কে।’

ফিউচারিস্টদের একটা বড় অংশ সমর্থন করেছিল বলশেভিক বিপ্লবকে। আর এর নেতৃত্বে ছিলেন মায়োকভস্কি। কারণ, এ বিপ্লব ছিল মূলত তাঁর কাছে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ। কারণ, এর মাধ্যমে ইতিহাসের পুরাতন শৃঙ্খল ভেঙে গিয়ে উন্মোচিত হয় নতুন সামজিক ও রাজনৈতিক পথ। শিল্প-সাহিত্যের পালেও লাগে পালাবদলের হাওয়া। এ সময় মায়োকভস্কির কলমের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে বিপ্লবের মাহাত্ম্য আর জয়ধ্বনি:
‘মহান বিপ্লব আমার!
সেটা নয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কোনো,
রাখো বা না-ই রাখো সঙ্গে তোমার,
আমায় কিংবা মস্কোর ভবিষ্যৎবাদীদের।

বলশেভিক বিপ্লবের পর মায়োকভস্কির কবিতা হয়ে ওঠে আরও বেশি তীক্ষ্ণ ও জনজীবনঘেঁষা ‘ওদা রেভাল্যৎসি’ ও ‘লেভিই মার্শ’–এর মতো কবিতায় মিছিল, জনসভা, রাজপথ, শ্রমজীবী মানুষ মুখ্য হয়ে উঠতে থাকে, যা তাঁকে নিয়ে যায় খ্যাতির চূড়ায়।

তবে বিপ্লব–পরবর্তী সমাজে নতুন সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয় গৃহযুদ্ধ (১৯১৭-১৯২২)। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে হত্যা, ধ্বংস আর ঘৃণার লেলিহান শিখা। তখন মায়োকভস্কি নেমে পড়েন কবিতা, পোস্টার, নাটক নিয়ে নতুন বিপ্লবের আশায়। এ সময় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘১৫০০০০০০০’ কাব্যগ্রন্থটি। যেখানে তিনি উড্রো উইলসনের সঙ্গে আইভানের সখ্যকে তুলে ধরেছেন পুঁজিবাদের কাছে সমাজতন্ত্রের পরাজয় হিসেবে। তাঁর কবিতা কথা বলতে শুরু করে সমগ্র রাশিয়ান জনগণের হয়ে:
‘পনেরো কোটি কবি এই কবিতার।
যারা নৃত্যরত অস্ত্রের সঙ্গে,
গুলি ছুড়ছে তাদের বসতবাড়িতে,
আমার ঠোঁট কথা বলে পনেরো কোটি হয়ে।’

লেলিনের মৃত্যুর পর মায়োকভস্কির কবিতার আবার মোড় নেয় নতুনভাবে। যেখানে লেলিন আবির্ভূত হন চালকের আসনে:
‘লেলিন এখনো জীবন্ত সবকিছুর চেয়ে।
আমাদের জ্ঞানের চেয়ে।
আমাদের শক্তির চেয়ে।
আমাদের অস্ত্রের চেয়ে।’

বিপ্লবের সমান্তরালে এই কবির জীবনেও কড়া নেড়েছিল প্রেম। সুদর্শন, দীর্ঘকায়, মাথায় হ্যাট পরিহিত এই যুবকের সঙ্গে তাই নারীদের সহজেই হয়ে যেত সখ্য। ফলে তাঁর জীবনে নারীদের তালিকা বেশ লম্বা। তবে লিলিয়া ব্রিক, ভেরোনিকা পোলানস্কায়া ও এলসা ত্রিয়োলের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর যেখানেই প্রেম, সেখানেই পাওয়া না পাওয়ার উৎকণ্ঠা:
‘সে আমাকে ভালোবাসে, আবার বাসে না।
আমি আমার হাত তুলে ধরি,
আর আঙুলগুলো ভেঙে ছুড়ে ফেলি চারদিকে।’

মায়োকভস্কির আত্মহত্যা প্রসঙ্গে লিলি ব্রিকের সঙ্গে তাঁর হৃদয়ঘটিত টানাপোড়েনের বিষয়টি আলোচিত হলেও মূলত বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে সমাজতন্ত্রের অবিপ্লবী চেহারায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। যে দেশ ও পার্টির জন্য তিনি সারা জীবন লড়েছিলেন, সেই দেশ ও পার্টির কাছ থেকে একসময় তিনি পেতে শুরু করেছিলেন সীমাহীন অবজ্ঞা। যা তাঁকে ঠেলে দেয় আত্মহত্যার দিকে। সে অর্থে তাঁর আত্মহত্যা ছিল আরেক বিপ্লব।