মতিউর রহমানের লেখা
অরুণ মিত্র: মিছিলের কবি, মিছিলের যাত্রী নন
আজ ২২ আগষ্ট কবি অরুণ মিত্রের মৃত্যুদিন। যশোরে জন্ম নেওয়া এই কবির সঙ্গে বাংলাদেশের ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। ফলে এদেশ আর এদেশের মানুষকে কখনোই ভুলতে পারেননি তিনি। এভাবেই একসময়ের বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী, এখনকার প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা হয় এই কবির। ২০০০ সালের ২২ আগস্ট কবির প্রয়াণের পর তাঁকে স্মরণ করে মতিউর রহমান লিখেছিলেন এই লেখা। এতে কবি অরুণ মিত্র যেমন হাজির, একইবাবে ব্যক্তি অরুণ মিত্রের অবয়বও ধরা আছে অনন্য কুশলতায়। লেখাটি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মতিউর রহমানের ‘আকাশভরা সূর্য তারা: গান–কবিতা–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
আকস্মিকভাবে জানতে পারি, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রবীণ কবি অরুণ মিত্র প্রয়াত। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট ২০০০ সাল) প্রত্যুষে খবরের কাগজ খুলে এ দুঃসংবাদ পড়ে ব্যথিত হই গভীরভাবে। বিরানব্বই বছর যাঁর বয়স হয়েছিল, তাঁর এ প্রস্থানকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। শেষ দিকে কিছুটা সময় অবশ্য কবি অসুস্থ ছিলেন। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে অরুণ মিত্রকে নিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বয়স যাঁকে ছুঁতে পারেনি’ নিবন্ধটির কথা। তিনি লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় ফিরে তাঁর কবিতার ফোয়ারা দেখে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে বড় জাতের কবিদের বয়স কখনো ছুঁতে পারে না।’
বাংলা কবিতার বয়োজ্যেষ্ঠ কবি অরুণ মিত্রের প্রয়াণ-সংবাদের পর সময় কেটেছে নানা বই উল্টেপাল্টে—অসাধারণ সব কবিতা, ‘প্রান্তরেখা’ থেকে ‘উচ্ছন্ন সময়ের সুখ-দুঃখ ঘিরে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলি, বাংলা কবিতা আর গদ্য সম্পর্কে তাঁর গভীর সব আলোচনা, ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ অনুসন্ধানী লেখা আর তাঁর ভালোবাসা-ভরা সেসব মহৎ কবি-লেখক লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার আর ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির অনুবাদ গদ্য ও কবিতা নিয়ে। নিজের সংগ্রহ থেকে অরুণ মিত্রের একমাত্র উপন্যাস ‘শিকড় যদি চেনা যায়’ কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। এই উপন্যাসের বিষয় ছিল যশোর থেকে কলকাতা-যশোরের বাল্যকাল আর কলকাতার জীবন-স্মৃতি। মনে হয়, যেন এক আত্মজীবনী। এই একমাত্র উপন্যাস সম্পর্কে অরুণ মিত্র আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের কাছে উপন্যাসটি ভালো লাগে। কোনো মডেল দেখে লেখাটি করিনি। হুবহু জীবনী নয়, তবে জীবনের বহু ঘটনা এসেছে, এসেছে কল্পনাও।’
আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, ১৯৮৭ সালের ২০ আগস্ট সকালে কলকাতার তিলজলায় কুষ্টিয়া হাউজিং এস্টেটের সরকারি আবাসনে ছোট দুই কামরার আস্তানায় কবি অরুণ মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। আমি যাব, সেটা আগেই বলে রেখেছিলেন নাচোলের সেই বিদ্রোহী নেত্রী ইলা মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পারুল বোন’। আমার পরিচয়, তখন আমি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘একতা’র সম্পাদক। বাংলাদেশের সাংবাদিক, তা-ও আবার বামপন্থী, সে জন্য হয়তো কিছুটা বাড়তি স্নেহ পেয়েছিলাম তাঁর কাছে। আমরা জানি, প্রথম জীবনে সাম্যবাদী ছিলেন তিনি। পরেও এ আদর্শ পরিত্যাগ করেছেন বলে শুনিনি।
এ প্রসঙ্গে সেদিন কথা তুলতেই গভীর বিশ্বাসে কবিতা আবৃত্তির মতো করে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘বর্তমান দুর্দশা দুর্গতি—যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে—সেসব দূর করা, সমস্ত মানুষ মুক্ত জীবনের স্বাদ পাবে বা নিজের জীবনের স্বাধীনতা পাওয়ার মতো পরিবেশ পাবে, সে রকম ভবিষ্যতের দিকে উন্মুক্ত হয়ে থাকার অর্থে আমি বামপন্থী।’ জীবনের সমগ্রতার স্পর্শে আমৃত্যু তাঁর কবিতায় আমরা সে বিশ্বাস দেখতে পাই।
আলাপ-পরিচয়ের পর্ব শেষ হতে না-হতেই গভীর মমতা নিয়ে অরুণ মিত্র কথা বলতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা গান থেকে আসে কবিতা, তারপর হয় গদ্য। ফরাসি আর বাংলা ভাষার জন্ম প্রায় একই সময়ে। বয়সে ফরাসি ভাষা বাংলার চেয়ে অল্প কিছু বড়। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের জন্মকাণ্ডটাই সৃষ্টিছাড়া। এমন কৃত্রিম জন্ম আর কোনো ভাষায় হয়েছে বলে জানি না।’
গভীর প্রাজ্ঞ এই আলোচনার মাঝখানে তাঁর শৈশব আর কিশোরজীবন সম্পর্কে জানতে চাইতেই উচ্ছ্বসিত কবি অরুণ মিত্র বলতে শুরু করেন আবেগে ও ভালোবাসায় অবিরল ঝরনাধারার মতো, ‘আমার জন্ম তো সেই কবে, ১৯০৯ সালের ২ নভেম্বর, যশোরে। ওই সময় নগর আর গ্রাম ছিল মেশামেশি। কুঁড়েঘর আর দালান লাগালাগি, পুকুর আর ডোবা পাশাপাশি। ঝোপঝাড়, বাঁশবন, নারকেল, সুপুরি, তাল, খেজুরগাছের একসঙ্গে জটলা। শহর থেকে পা বাড়ালেই গ্রাম। সে জন্য বলা কঠিন, আমরা গ্রামে ছিলাম, না শহরে। দল বেঁধে বেরিয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেতাম। শহরকেন্দ্রের আপিস-কাচারি, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো এলাকায় আর ফুটবল মাঠে। হয়তো চলে যেতাম পাশেই গ্রামের মধ্যে। গেঁয়ো আবহাওয়া আমাকে অভিভূত করত সব সময়ই। কেউ কেউ বলেছেন, আমার কবিতার অনেক জায়গায় নাকি বাংলার জল-মাটি ছড়িয়ে আছে, তা হতে পারে। আমার শৈশব, আমার কৈশোর তাদের সংগ্রহ করে রেখেছিল।’
অরুণ মিত্র বলেন, ‘আমি অবশ্য একটানা কখনো যশোরে থাকিনি, বালক বয়সেই সেখান থেকে চলে আসি। আমার লেখাপড়া জীবনযাপন বরাবর কলকাতায়। কিন্তু কলকাতায় এসে যশোরের সঙ্গে আমার বাঁধনটা আলগা হওয়ার বদলে আরও শক্ত হলো। তার প্রতি আমার টান বহুকাল পর্যন্ত ছিল অত্যন্ত তীব্র। কলকাতায় সেই নস্টালজিয়া আমার ওপর চেপে থাকত। যশোরে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির হয়ে থাকতাম।’ তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ছুটিতেই ছুটে যেতাম যশোরে। আমার সত্যিকার সঙ্গী-সাথি বলে যাদের মনে করতাম, তাদের সবার বাস ছিল সেখানে। যশোরে পৌঁছলেই আমার মনে হতো আমি নিজের জায়গায় এলাম। সেখানকার পরিবেশই আমার মন আর শরীরের গড়ে ওঠাকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল।’
কবি অরুণ মিত্রকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, এই যে পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ বললেন, এটা কীভাবে এসেছে?
তিনি বলেন, ‘ওই যে বললাম গ্রাম-শহরের মেশামেশি, সে রকম মেশামেশি ছিল শরীর ও মনের তৎপরতায়। আমার কাছে এ দুইয়ের কোনো শ্রেণীভাগ ছিল না। যেমন আজ আমার দৃষ্টিতে ও অনুভূতিতে সাহিত্যিক আর সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। সকলকেই মনে হয় সমান কাছাকাছি।
‘যশোরে যাদের সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে মিশতাম, তাদের মধ্যে যেমন ছিল দুর্ধর্ষ সাহসী ও সচ্চরিত্রবান, তেমনি ছিল যাদের বলা যেতে পারে মননপন্থী, যারা লেখক, সাহিত্যানুরাগী ও দেশকর্মী। তাদের সঙ্গে মিলে জলে ঝাঁপাঝাঁপি, সাঁতার কাটা এসবও করতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
‘এসবের সমান্তরালে অন্য এক ধারাও ছিল। আমার মামাবাড়িও যশোর শহরে। সে বাড়ির আবহাওয়া ছিল সাংস্কৃতিক। সেখানে ‘প্রবাসী’ পত্রিকা আসত, ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড, নানা রকম বই সেখানে—কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দাকাহিনি, প্রবন্ধ ইত্যাদি। সেসব নাড়াচাড়া করার অবাধ অধিকার ছিল। আমার স্বভাবগত আকর্ষণ ছিল সেদিকে। তাই ফাঁক পেলেই সেখানে গিয়ে আস্তানা গাড়তাম। এ বাড়ি ছিল তরুণদেরও এক মিলনকেন্দ্র। তাদের মধ্যে গেলে অনুভব করতাম বাইরের জগতের স্পন্দন। জাতীয় ভাবধারার স্পর্শে তরুণেরা তখন উজ্জীবিত। সন্ত্রাসবাদী, গান্ধীবাদী আর সাম্যবাদী সংগঠনের সঙ্গে ছিল এদের কারও কারও যোগাযোগ। তার ওপর কেউ কেউ ছিল সাহিত্যে উৎসাহী। এ রকম এক পরিবেশেই আমি বেড়ে উঠেছিলাম।’
অরুণ মিত্র বলেন, ‘আমি অবশ্য একটানা কখনো যশোরে থাকিনি, বালক বয়সেই সেখান থেকে চলে আসি। আমার লেখাপড়া জীবনযাপন বরাবর কলকাতায়। কিন্তু কলকাতায় এসে যশোরের সঙ্গে আমার বাঁধনটা আলগা হওয়ার বদলে আরও শক্ত হলো। তার প্রতি আমার টান বহুকাল পর্যন্ত ছিল অত্যন্ত তীব্র। কলকাতায় সেই নস্টালজিয়া আমার ওপর চেপে থাকত। যশোরে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির হয়ে থাকতাম।’
প্রশ্ন করি, আপনার সাহিত্য-সংস্কৃতির জীবনে এই পরিবেশের প্রভাব কতটুকু?
তিনি বলেন, ‘সাহিত্য তো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, নিছক শব্দের খেলা নয়। জীবনের অভিঘাতই যে কবিতা। যেকোনো সৃজনশীল শিল্পের ভিত্তিই আমার বিশ্বাস এ-ই বলে। আমার অজ্ঞাতসারেই সে সময়ে এ ধারণা গড়ে উঠেছিল। তারই সঙ্গে এ বোধেরও জন্ম হয় যে সাহিত্যিকেরা উচ্চতর কোনো শ্রেণী নয়, সর্বসাধারণেরই এক অংশ, যাদের একটা বিশেষ প্রবণতা ও ক্ষমতা আছে। যেমন অন্যদেরও বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। আমার সেই শৈশব-কৈশোরের মেলামেশায় সে বোধই নিজ থেকে রূপ নিয়েছিল।’
যশোরের সেই শৈশব, সেই কৈশোরকে অরুণ মিত্র কখনো ভুলতে পারেননি। সে জন্যই হয়তো আমার অটোগ্রাফ-খাতায় সেদিন তিনি এ কথাগুলো লিখে দিয়েছিলেন, ‘এই স্বাক্ষরের সঙ্গে আমার হৃদয়ের আত্মীয়তা লেখা রইল।’ আমি বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি সে কারণেই হয়তো—সেখানেই যে তাঁর প্রিয় গ্রাম-শহর যশোর।
কবি অরুণ মিত্রের প্রয়াণ-সংবাদ আমাকে নিয়ে গেল আমাদের তুমুল হইচই আর উত্তেজনাময় ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিনগুলোতে। তখনই আমরা, আমাদের বন্ধুরা, সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষা নিয়েছি। গোগ্রাসে গিলেছি সমাজবাদী তত্ত্বকথা। গোপন বৈঠক, নিষিদ্ধ পোস্টার আর মিছিলে মিছিলে এগিয়ে চলেছি, সুকান্ত-সুভাষের কবিতায় কবিতায় অবগাহন করছি, দেখছি কবির মতো স্বপ্ন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘যত দূরেই যাই’-এর উচ্চ স্বর নয়, স্বগতোক্তির মতো কবিতাগুলো তখন আমাদের কবিতার বোধ আর চিন্তাজগৎকে একদম নাড়িয়ে দিয়েছে। আর সে সময় হাতে আসে কবি বিষ্ণু দে সম্পাদিত ‘এ কালের কবিতা’ সংকলন গ্রন্থটি। স্পষ্ট মনে পড়ে, বিষ্ণু দে তাতে অরুণ মিত্রের পাঁচটি কবিতার জায়গা দিয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম, কবি এতে বিশেষভাবে প্রীত হয়েছিলেন। এর আগে বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র প্রথম সংস্করণে অরুণ মিত্রের কোনো কবিতা রাখেননি। তবে কবিকে চিঠি লিখে বুদ্ধদেব বসু এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে তাঁর একটা কবিতা অন্তভুর্ক্ত করেছিলেন। এতেও তিনি খুশি হয়েছিলেন।
এখনো মনে পড়ে ‘এ কালের কবিতা’য় অরুণ মিত্রের ‘সুকান্ত’ কবিতাটি, যার প্রথম লাইন ‘মৃত্যুর আগের দিন পড়ন্ত রোদের দিকে তাকিয়ে কী ভেবেছিল সুকান্ত?’ আর শেষ লাইনটি ছিল, ‘রোদের একটা ঝলক যদি সুকান্তর অন্ধকার অন্ত্র আর ফুসফুসের মধ্যে ঢুকতে পারতো।’ এই কবিতা পড়ে হু হু করে উঠেছিল বুকের ভেতরটা। সেই আবেগের কথা এখনো মনে আছে। আর কত দিন যে মনে মনে আউড়েছি, উচ্চ স্বরে পড়েছি ‘এ জ্বালা কখন জুড়োবে?’ কবিতাটি। এখনো বড় প্রিয় তাঁর শব্দ আর পঙ্ক্তিগুলো, ‘অনেক তো দেখা গেলো, অনেক প্রিয়জনের পাঁজর গুঁড়িয়ে গেলো আচমকা তোপে। আর কত। কবে আমার এই ধুলো পবিত্র বৃষ্টিতে ধোবে? এ জ্বালা কখন জুড়োবে? কখন?’ এই ছিল কবি অরুণ মিত্রের কবিতার কণ্ঠস্বর। একসময় সাম্যবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। পরে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে তিনি সরে এসেছিলেন। সে জন্য কোনো উচ্চকিত অঙ্গীকার তাঁর কবিতায় দেখা যায় না। নিচু স্বরেই কথা বলতে ভালোবাসতেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যেই শুনিয়ে দিয়েছেন বড় এক আশ্বাসের টান। মিছিলে একেবারে ভেসে যাননি তিনি, তবে মিছিলের নিবিড় হৃদয় উন্মোচিত করেছেন কবিতায়।
মনে পড়ে, প্রায় একই সময়ে সারা বিশ্বের সেরা কবিদের কবিতার অনুবাদ নিয়ে শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত বিশাল গ্রন্থ ‘সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত’ আমরা বন্ধুরা সংগ্রহ করেছিলাম। নানা আলোচনায় মগ্ন ছিলাম বইটি নিয়ে। আর স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মধ্যে সাম্যবাদী কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার আর পাবলো নেরুদার কবিতায় অভিভূত ছিলাম আমরা। বাংলায়, বিশেষ করে ফরাসি কবিদের কবিতা পড়তে পড়তে আবার পেয়ে যাই অরুণ মিত্রকে। তিনি আরও প্রিয় হয়ে ওঠেন আমাদের। তবে এর আগেই দীপ্তি কল্যাণ চৌধুরী অনূদিত লুই আরাগঁ’র কবিতা পড়ে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম। ‘এলসা, তোমায় আমি ভালবাসি’র লুই আরাগঁর জীবনসঙ্গিনী এলসা ত্রিয়োলে সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম সে সময়ই।
অরুণ মিত্রের কাছে সেদিন তাঁর প্রিয় কবি-লেখকের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেছিলেন, ‘বলতে গেলে ফরাসি লেখকদের মধ্যে যাঁদের কথা মনে আসে, বেশি করে যাঁরা টানেন, তাঁরা হলেন পল এল্যুয়ার, লুই আরাগঁ আর স্যাঁ-ঝন পের্স। উনিশ শতকের ফরাসি কবিদের মধ্যে আতুর্র র্যাঁবো বিপুলভাবে আচ্ছন্ন করেন। এল্যুয়ার আর পের্স তো ভাসিয়ে নিয়ে যান আমাকে। পের্স মারা যাওয়ার পর লুই আরাগঁ লিখেছিলেন, “ফ্রান্স তার বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকে হারাল। নানা কারণে অনেকে আমার সঙ্গে একমত না হতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি জানি কী নিয়ে কথা বলছি।”’
অরুণ মিত্রের লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি, ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে কবি স্যাঁ-ঝন পের্সকে নিয়ে লেখাটি ছিল লুই আরাগঁর শেষ লেখা। ১৯৭০ সালে জীবনসঙ্গিনী এলসা ত্রিয়োলের মৃত্যুর পর আরাগঁর কণ্ঠ দ্রুতই নীরব হয়ে যায়, যদিও তিনি বেঁচে ছিলেন ১৯৮২ সাল অবধি।
স্যাঁ-ঝন পের্সের গদ্যকবিতার সঙ্গে অরুণ মিত্রের কবিতা রচনার দারুণ মিল আমরা লক্ষ করেছিলাম কবিতার জগতে ঢোকার সময়েই। এ প্রসঙ্গ তুলতেই অরুণ মিত্র সেদিন বললেন, ‘অনেকে বলেন আমার ওপর ফরাসি সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। ফরাসি কাব্যের প্রতি আমার অনুরাগ আছে। সেটা থাকতে পারে। হয়তো সেটা আঙ্গিকের ক্ষেত্রে। আমি প্রধানত গদ্যকবিতা লিখি। সেটা কারও প্রভাবে, তা নয়। তবে ফরাসি দৃষ্টান্ত আমাকে জোর দিয়েছে। স্যাঁ-ঝন পের্স তো গদ্যকবিতা ছাড়া লেখেননি।
যেকোনো ফর্মেই আমি লিখতে পারি। সেটা গদ্য বা পদ্য যেকোনো ফর্মে হতে পারে।’
সেই ষাটের দশকে স্লোগান, মিছিল আর কবিতা যখন আমাদের সেই দুরন্ত যুবা বয়সের দিনগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন ঢাকার সেই আজীবন সাম্যবাদী কবিতাপ্রেমী রণেশ দাশগুপ্তের কাছ থেকে কতই না আমরা শুনেছি রুশ বিপ্লবের কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি প্রতিরোধের দুই কবি লুই আরাগঁ ও পল এল্যুয়ারের কবিতা আর ফ্রান্সজুড়ে তাঁদের দৃপ্ত পদচারণের কথা। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে আমরা শুনেছি আর অনুপ্রাণিত হয়েছি চার দশক ধরে। রণেশদার সঙ্গে যত কথা বলেছি, যতই সময় কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে, বারবার ফিরে ফিরে এসেছে সাহিত্যের এই অসামান্য কীর্তিমানদের কথা। কেবল একজনই নন, রুশ, ফরাসি, স্পেনীয়, ইংরেজি, উদুর্সহ নানা ভাষার সেরা মানবতাবাদীদের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে অফুরান ছিল তাঁর কথার মালা। আমাদের মনের গভীরে সেই যে আকণ্ঠ পিপাসা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি, ফরাসি সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার অনেকটা নিবৃত্তি ঘটেছিল কবি অরুণ মিত্রকে পেয়ে।
প্রায় শতাধিক ফরাসি কবিতা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। আর কোনো অনুবাদক সরাসরি ফরাসি থেকে বাংলায় এতগুলো কবিতা অনুবাদ করেননি। তাঁর অনুবাদ করা কবিদের সময়কাল পনেরো শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি অনুবাদ করেছেন লেনিনের একমাত্র কবিতাটিও। পরে সেটি ‘সে এক ঝড়ো বছর’ নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশ করা হয়। তবে একক কবি হিসেবে পল এল্যুয়ারের কবিতাই তিনি অনুবাদ করেছেন সবচেয়ে বেশি। শুধু এল্যুয়ারের কবিতার অনুবাদগুলোই তিনি ঠাঁই করে দিয়েছেন একটা বইয়ের পরিসরে। এল্যুয়ারের প্রতি তাঁর বিশেষ মনোযোগ এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার তাঁর অনেক ধ্যানমগ্ন কবিতার সঙ্গে অরুণ মিত্রের অনেক কবিতার কণ্ঠস্বরের বেশ কিছুটা সাজুঘ্যও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কি অরুণ মিত্র এল্যুয়ারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
সেই সকালে আমাদের কথোপকথনের সময় পল এল্যুয়ারের প্রসঙ্গ উঠলে অরুণ মিত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, প্যারিসে থাকার সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেননি?
তিনি বলতে থাকেন, ‘বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষির ইচ্ছে হয়নি। ধার করা আলোয় কাউকে উজ্জ্বল দেখানোর চেষ্টা হাস্যকর লাগে। তবে তাঁদের কারও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ যদি কোনোভাবে আমার দৃষ্টিতে আসে, তাহলে ব্যক্তিগত স্তরে তাঁকে আরও জানার বাসনা হয়। পল এল্যুয়ার সম্পর্কে আমি সে রকম আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম।
‘এ আকর্ষণ জন্ম নেয় এক জনসমাবেশে তাঁর ভাষণ শুনে। ১৯৪৯ সালে প্যারিসে যে ঐতিহাসিক বিশ্ব শান্তি কংগ্রেস হয়, সেখানে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। সে সভায় শুনেছিলাম লুই আরাগঁ আর পল এল্যুয়ারের ভাষণ। আরাগঁর ক্ষিপ্ত অঙ্গভঙ্গি আর দৃপ্ত বাক্যচ্ছটা সভায় উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল। এল্যুয়ারকে দেখলাম একেবারেই অন্য রকম। সৌম্য মুখমণ্ডল, তাঁর কথা বলার মধ্যে ছিল এক আত্মমগ্ন ভাব। তাঁর কবিতার চরিত্রের সঙ্গে যেন সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁর ব্যক্তিস্বরূপ। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “বক্তৃতা আমি দেব না। নিজের কথা তো আমি কবিতাতেই বলি। সুতরাং, আমি নিজের কবিতাই পড়ে শোনাই।” এরপর তিনি গম্ভীর কণ্ঠে পড়ে গেলেন তাঁর কবিতা। জীবনের সঙ্গে কবিতার মিশে যাওয়ার এমন মূর্ত রূপ আমি আর কখনো দেখিনি। তাঁর সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করল।’
অরুণ মিত্র বলেছিলেন, ‘একবার এক লাইব্রেরির একটা মেয়ে আমাকে পল এল্যুয়ারের আবাসের ঠিকানা দিয়েছিল। মেয়েটি ছিল এল্যুয়ারের মেয়ের বন্ধু। ঠিকানা নিয়ে বাড়িটা খুঁজে বের করলাম। অনেক ভাড়াটেই সেখানে থাকেন বলে মনে হলো। কিন্তু দ্বাররক্ষী বলল, এ ঠিকানায় পল এল্যুয়ার নামে কেউ থাকেন না। নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। আমি আবার সেই মেয়েটির কাছে গেলাম। বললাম সবকিছু। মেয়েটি আবারও বলল, “দ্বাররক্ষী বাজে কথা বলেছে। এল্যুয়ার সেখানেই থাকেন। আপনি আর না গিয়ে একটা চিঠি লিখুন।” পল এল্যুয়ারকে চিঠি লিখলাম। জানালাম, আমি ভারত থেকে এসেছি, আমার শিক্ষাজীবন শেষ, যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেতে চাই। আরও জানালাম, আমি একটু-আধটু কবিতা লিখি এবং তাঁকে আমার কবিতার একটা বই দিতে ইচ্ছুক। চিঠি ডাকে পাঠালাম। কিন্তু উত্তর আসে না। এদিকে আমার দেশে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। এমন সময় হঠাৎ এক টেলিগ্রাম এসে উপস্থিত। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের দরদইন থেকে পল এল্যুয়ার লিখেছেন, “প্যারিসে না থাকার জন্য আমি দুঃখিত। আপনার বই আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। ভারতবর্ষে আপনার প্রত্যাবর্তন-যাত্রা শুভ হোক। আমার প্রীতি জানবেন।” বুঝলাম, আমার চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছতে বেশ সময় লেগেছে।’
আমরা জানি, ফরাসি ভাষা আর সাহিত্যে নিরন্তর অনুশীলন ও সংযোগের পরিণামেই—সেই ১৯৪৮ সালে—অরুণ মিত্র বৃত্তি নিয়ে চলে যান প্যারিসে। প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিন বছর ফরাসি সাহিত্যের যে বিষয়টিতে গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন, তার শিরোনাম: ‘ল্য গ্রুপ দ্য লা রভ্যু ব্লাঁশ’, অর্থাৎ ‘শ্বেত পত্রিকার গোষ্ঠী’। এ গ্রুপের সঙ্গে ছিলেন শিল্পী তুলুজ লোত্রেক, সংগীতকার দরসি, সাহিত্যিক আঁদ্রে জিদ ও মার্সেল প্রুস্ত। ফরাসি সাহিত্যে এ গোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে অরুণ মিত্রেরই সেই গবেষণা। ভারতবর্ষে ফিরে এসে ড. অরুণ মিত্র বিশ বছর ফরাসি সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি কলকাতায় ফেরেন ১৯৭২ সালে।
যা বলছিলাম, অরুণ মিত্র ফরাসি থেকে অনুবাদ করে এলসা ত্রিয়োলের মায়াকোভস্কির স্মৃতিকথা উপহার না দিলে মায়াকোভস্কির প্রতি আমাদের ভালোবাসা কোনো দিন পূর্ণ হতো না। পূর্ণ হতো না, যদি একইভাবে আরাগঁর বন্ধু চলচ্চিত্র সমালোচক জর্জ সাদুলের লেখা আরাগঁর স্মৃতি তিনি বাংলায় তরজমা না করতেন। পল এল্যুয়ারের কাব্যগ্রন্থটির কথা তো আগেই বলেছি। সেসব বইয়ের পৃষ্ঠায় ডুবে আজও আমরা জীবনের জন্য কত না মণিমানিক্য খুঁজে পাই।
অরুণ মিত্র জানালেন, ১৯২৮ সালে প্যারিসে মায়াকোভস্কির সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে আরাগঁর সঙ্গে এলসার পরিচয়। আরাগঁ লিখেছেন, ‘জায়গাটা হঠাৎ প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে তখন এলসার দেখা। সেই থেকে আর আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়নি।’
রুশ কবি মায়াকোভস্কি এলসা ত্রিয়োলেকে বন্ধুর মতো ভালোবেসেছিলেন। এলসা তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘মায়াকোভস্কি আমার প্রেমের প্রত্যাশী ছিল।’ মায়াকোভস্কির কবিতা শুনে এলসা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। মায়াকোভস্কি সে সময় লিখেছিলেন ‘পাৎলুন-পরা মেঘ’। ম্যাক্সিম গোর্কিকে কবিতাটি মায়াকোভস্কি পড়ে শোনালে তিনি আবেগে ও আনন্দে কেঁদে ফেলেন। অরুণ মিত্রের অনুবাদ ‘এলসার মায়াকোভস্কি’ বইটি পড়ে এসব আমরা জেনেছি। মায়াকোভস্কি ভালোবাসতেন সংগীত, তিনি কেমন বেপরোয়া ছিলেন, কেমন করে মাথার মধ্যে লিখতেন কবিতা, মুখস্থ করে, দশ-বারোবার, একশবার বদলিয়ে, পরে কীভাবে সেটা লিখতেন—এসব আমরা জেনেছি এলসার ভালোবাসাময় নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে। রুশ মেয়ে এলসা ত্রিয়োলে পরে হয়ে ওঠেন আধুনিক ফরাসি সাহিত্যেরই এক উল্লেখযোগ্য নাম। মায়াকোভস্কি তাঁর অনেক বান্ধবী আর প্রেমিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন এলসার বড় বোন লিলি ব্রিককে।
অরুণ মিত্রের ‘আরাগঁ’ হাতে না এলে কবি আর কবিতার প্রতি আমাদের ভালোবাসা একেবারেই অপূর্ণ থেকে যেত। এ বই থেকেই আমরা জানতে পারি সমগ্র আরাগঁকে। অরুণ মিত্রের অনুবাদে জর্জ সাদুল আমাদের জানান, ১৯২৬ সালের মে মাসে লুই আরাগঁ তাঁকে নিয়ে যান কাপে সিরানোতে। আঁদ্রে ব্রেতোঁ, পল এল্যুয়ার ও অন্যদের সঙ্গে সেখানে তাঁর পরিচয়। আরাগঁ ঘুরে বেড়াতেন দেশে দেশে, মঁপারনাসে তাঁর সন্ধ্যারাতের অভিযান, চাকরি হারিয়ে বাক্স ভর্তি করে এলসার তৈরি মালা আর পোশাক বিক্রি করতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর অসীম সাহসী তৎপরতা, কারফিউয়ের রাতে প্যারিসে হাতে হাতে ঘুরত তাঁর কবিতা, পাওয়া যেত ফায়ারিং স্কোয়াডে নিহত শহীদদের পকেটে। অরুণ মিত্রের আরাগঁ বইটিতে এসব আমরা জানতে পাই।
আরাগঁ বলেছিলেন, ‘যে ইসলামি মন আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল, তার ভেতরে আমি শেষ পর্যন্ত প্রবেশ করলাম স্পেনের মারফত।’ অরুণ মিত্রের ‘আরাগঁ’ বইটি থেকে আমরা আরও আবিষ্কার করি আরাগঁ নিবিষ্টভাবে আরব সভ্যতা, কাব্য, এমনকি আরবি ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন। অরুণ মিত্র অনূদিত আরাগঁর সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, যৌবনে তাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছিল গিয়োম আপোলিনেরের। আর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে প্রথমেই তিনি যাঁর নাম করতেন, তিনি পল এল্যুয়ার। অরুণ মিত্র মূল ফরাসি থেকে আরাগঁর গল্প, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার সবই অনুবাদ করেছেন। কিন্তু অরুণ মিত্রের ফরাসি কবিতার অনুবাদগ্রন্থ ‘অন্যস্বর’-এ আরাগঁর কোনো কবিতা নেই। তাঁর কোনো কবিতা তিনি অনুবাদ করেননি? কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আর পাওয়া যাবে না।
জর্জ সাদুলের ‘আরাগঁ’-এর শেষ পর্যায়ে আরাগঁ আর মাতিসের যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি আর চিত্রকরের ক্রমেই আরও দূরে ও গভীরে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে দুজনের সাফল্যের উজ্জ্বল পরিক্রমার কথাও আমরা পেয়ে যাই কিছুটা। বলা যায়, এ দুই মহৎ শিল্পীর যৌথ প্রচেষ্টায় কিন্তু আরাগঁর একক লেখনীতে রচিত হয়েছিল দুই খণ্ডে ৭৩০ পৃষ্ঠার সুবিশাল গ্রন্থ ‘অঁরি মাতিস: আ নভেল’। আরাগঁ নিজে বলেছেন, ‘ইট ইজ আ ক্যায়োস।’ বহু বছর অপেক্ষায় থেকে ১৯৯৭ সালে লন্ডনের পুরোনো এক বইয়ের দোকান থেকে ১৫০ পাউন্ডের বিনিময়ে অবিস্মরণীয় এই স্বপ্নের বইটি সংগ্রহ করে আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এটি আমার সংগ্রহের সেরা বই।
১৯৪৫ সালে মুদ্রিত ‘আরাগঁ: পোয়েট অব দ্য ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্স’ আর পল এল্যুয়ারের ‘সিলেক্টেড রাইটিংস’—নিজের সংগ্রহের এই ইংরেজি বই দুটো আমার বড় প্রিয়। বহুদিন ধরে এদের আমি সযত্নে রক্ষা করে চলেছি। পুরোনো এ বই দুটো আমাকে উপহার দিয়েছিলেন কলকাতায় বাংলাদেশের সুহৃদ, নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের স্বামী কমরেড রমেন মিত্র—তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। তাঁদেরই সূত্রে আমার পরিচয় হয়েছিল কবি অরুণ মিত্রের সঙ্গে। কমরেড রমেন মিত্র আর ইলা মিত্রের কাছে সে জন্য শুধু নয়, অনেক কিছুর জন্যই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। দুজনই আজ ইহজগতে নেই।
কবি অরুণ মিত্র সম্পর্কে কী আর বলার থাকতে পারে! তিনি তো নিরন্তর আলোকিত করেছেন আমাদের জীবন-মনন-সময়কে। তাঁর উচ্ছন্ন সময়ের সুখ দুঃখ ঘিরে কবিতার বইয়ের ‘স্বপ্নবাঁচার শেষে’ কবিতা থেকেই বলতে পারি:
আমাদের সেই বাঁচা সেই স্বপ্নবাঁচা নিয়ে আজ তুমি
এত দূর, কোনও বাতাসেই শুনে নিও ও গলার ঝুমঝুমি।
তাঁকে বিদায় জানাতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে আরেক কবি-শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর কথা, শেষ শঘ্যায় রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়ে যিনি লিখেছিলেন:
অরুণ মিত্রের কাছে যেতে কোনো ঠিকানা লাগে না
যে কোনো গাছের কাছে গেলেই তা জানা হয়ে যায়
যে কোনো বাতাস বলবে,
ঐ তো সূর্যের পাশে বসে জ্বলুনি-পুড়ুনি নিংড়ে হো হো হেসে চলেছেন।
প্রকাশকাল: ১ সেপ্টেম্বর ২০০০, প্রথম আলো
আকাশভরা সূর্য তারা: গান–কবিতা–শিল্পের ঝরনাধারায়
মতিউর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
দাম: ৮০০ টাকা
‘আকাশভরা সূর্য তারা: গান–কবিতা–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইটি সংগ্রহ করতে অর্ডার করুন prothoma.com