‘বলেছিলে না মুক্ত হব? এল তো মুক্তি, এখন আমি মাটি কাটছি’

প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিন ছিল ২৩ জুন। এ উপলক্ষে ২৯ জুন তিনি এক অনুষ্ঠানে ‘ফিরে দেখা’ শিরোনামে আত্মজৈবনিক বক্তৃতা দেন। নিজের জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এ ভূখণ্ডের সমাজিক ইতিহাস। সেই বক্তৃতার মূল অংশ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীছবি: প্রথম আলো

মানুষ পেছনে তাকিয়ে নিজের জীবনটাকে বোঝে। আমিও পেছনের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে বুঝছি, ঘটনাকে বুঝছি, অভিজ্ঞতাকে বুঝছি। আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে জীবনযাপনের—ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। এই তিন রাষ্ট্র আকৃতিতে, পতাকায়, নামে ভিন্ন। দুটি রাষ্ট্রই ভেঙেছে, আরেকটি জন্ম নিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর ভেতরে উন্নয়নের যে ধারাটা ছিল, সেটি ভাঙেনি। সেই ধারা হলো পুঁজিবাদী ধারা। এটাই বাস্তবতা।

ব্রিটিশ আমলে আমরা উপনিবেশ ছিলাম। পাকিস্তান আমলে তৈরি হচ্ছিল একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। তবে তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই সেই রাষ্ট্র হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত করেছে মানুষকে। তারপর বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি, সেখানেও থেকে গেছে পুরোনো ঔপনিবেশিকতা। এই রাষ্ট্রেও ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র অক্ষুণ্ন থেকে গেল। ঔপনিবেশিকেরা লুটপাট ও শোষণ করে, লুটপাট ও শোষণের মধ্য দিয়ে যা পায়, তা পাচার করে দেয় বাইরে। বাংলাদেশেও তা-ই চলছে।

এখানে যাঁরা ধনী, তাঁরা নিজেদের শ্রমে ধন উপার্জন করেননি; করেছেন যাঁরা শ্রম দিয়েছেন, তাঁদের শ্রমের উদ্বৃত্ত অপহরণ করে। আর সেটি ঘটেছে লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে—ব্যাংক লুট, ভূমিদস্যুতা, নদীদস্যুতা, বৃক্ষদস্যুতা—নানা ধরনের দস্যুতার মধ্য দিয়ে। আর সেই লুণ্ঠন ও দস্যুতার টাকা তাঁরা পাচার করে দিয়েছেন বিদেশে, ঠিক আগের শাসকদের মতো। আমাদের দেশের ধনীরা পুঁজিবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত। তাঁরা সেটি চর্চা করছেন উপনিবেশের মতো করেই।

ব্রিটিশদের উপনিবেশে

আমাদের শৈশব ছিল বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন, আক্ষরিক অর্থেই। যেখানে আমি বড় হয়েছি, সেই এলাকাকে আমরা এখন বিক্রমপুর বলে চিনি। বিক্রমপুরের অনেক খ্যাতি আছে। বহু মনীষী এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু এখানকার মানুষ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। এলাকাটি ছিল নিচু। ভালো ফসল হতো না। তাই চাকরিই ছিল মানুষের প্রধান উপার্জনের পথ। সে জন্য শিক্ষার খুব দরকার ছিল। চাকরির সন্ধানে বিক্রমপুরের লোক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সবাই শিক্ষা পায়নি। শিক্ষা ছিল অল্প মানুষের জন্য।

আমার শৈশব কেটেছে আমাদের এলাকার এক প্রান্তিক জায়গায়। আড়িয়ল বিলের কাছে, একেবারে শেষ জায়গাটিতে। বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা সেখানেই ছিলাম। আমার বয়স তখন ৬-৭ বছর। সে সময় পঞ্চাশের মন্বন্তর হয়। বলা হয়, তাতে ৩৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

প্রান্তিক মানুষ হিসেবে সে দুর্ভিক্ষে আমরা কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছি। আমাদের বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে তিনি কিছু টাকা পাঠাতে পারতেন। তাতে খুব সাধারণভাবে জীবন চলত। কোনো বিদ্যালয় ছিল না। আমরা আসার পর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

একদিন শুনলাম, একজন ফাঁসি নিয়েছেন। আমাদের কৌতূহল হলো। ফাঁসি জিনিসটা কী, জানি না। আমরা গিয়ে দেখি গাছের সঙ্গে মানুষটি যেন পুতুলের মতো ঝুলছেন। নড়ছেন বাতাসে। সেটিই ফাঁসির প্রথম অভিজ্ঞতা। তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি, মানুষটি বেকার ছিলেন। অনাহারে অসহায় অবস্থায় হতাশ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

আমার কাছে ব্রিটিশ আমলের ছবি হলো ওই আত্মহত্যার ছবি। যদি ব্রিটিশ শাসনের কোনো প্রতীক দিতে চাই, তাহলে ফাঁসিতে ঝোলা আমাদের গ্রামের এই মানুষটির কথাই বলতে হয়।

তারপর আমরা স্বাধীন হলাম, পাকিস্তান হলো। পাকিস্তানের অর্থ দাঁড়াল দেশভাগ। দেশভাগ যে কতটা ক্ষতিকর হয়েছিল, তখন আমরা সেটা উপলব্ধি করিনি, পরেও নয়। এখন পেছনে তাকিয়ে উপলব্ধি করি, ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হলো স্বাধীনতার নামে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ।

১৯৪৭ সালে যখন হঠাৎ করে দেশভাগ হয়, আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের পরিবার রাজশাহী থেকে কলকাতায় গিয়েছিল। কলকাতায় তখন আমরা কেবল গুছিয়ে বসছি। আমার মা–বাবা একটি পাখির বাসার মতো বাসা তৈরি করছেন, অনেক দিন থাকবেন। এর আগে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ হয়েছিল। তার মধ্যেই স্বাধীনতা চলে এল। আমরা কলকাতা ছেড়ে চলে এলাম।

তিনি একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখতে পেলেন, এক লোক মাটি কেটে ঝাঁকায় ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন লোকটি তাঁর পরিচিত। গাড়ি থেকে নেমে সেই তরুণ বললেন, ‘চাচা, কী করছেন?’ চাচা বললেন, ‘বলেছিলে না মুক্ত হব? এল তো মুক্তি। এখন আমি মাটি কাটছি।

এই যে চলে এলাম, চলে আসার সময়ে মনে হয়েছিল, যে বন্ধুদের সেখানে ছেড়ে এলাম, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল অথবা রাজশাহীতে অনেক দিন থাকার সময় সেই যে আমার বন্ধু ছিল রূপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী—ওদের সঙ্গে তো আর কখনো দেখা হবে না। কখনো আর দেখা হয়ওনি।

নূরজাহান মুরশিদ—আমাদের নূরজাহান আপা—কলকাতায় খুব দাপটের সঙ্গে ছিলেন। দাঙ্গার সময়ে ওখানে ছিলেন। ওখান থেকেই এমএ পাস করেছিলেন। খুব চটপটে ছিলেন। নাটক করতেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি পেয়েছিলেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘তুমি কোন স্টেশনে যেতে চাও?’ তিনি বলেছিলেন, ‘যেকোনো স্টেশনে যেতে রাজি, শুধু ঢাকা ছাড়া।’ সেই ঢাকাতেই তাঁকে আসতে হয়েছিল। ঢাকায় এসে তিনি রাজনীতিতে সংযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এমএলএ হয়েছিলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও।

তো, নূরজাহান আপা ঢাকা ছেড়ে আবার পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে মুর্শিদাবাদে নিজের বাড়িঘর খুঁজেছিলেন। মুর্শিদাবাদের লোকেরা তখন তাঁকে বলল, ‘একবার তো গিয়েছিলে ধাক্কা খেয়ে। আরেকবার ধাক্কা খেয়ে চলে এসেছ?’

এ–ই ছিল দেশভাগ।

নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে

১৪ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই কলকাতা থেকে অনেকে ঢাকায় চলে এল। আমাদের এলাকার অনেকেই কলকাতা যত চিনত, ঢাকা ততটা চিনত না। ঢাকায় সবাই একসঙ্গে এসেছে। বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে আমি কোনো উৎসবমুখরতা দেখিনি। একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন, একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার যে প্রচণ্ড উল্লাস, সেটা দেখিনি। বরং দুশ্চিন্তা দেখেছি।

আমার বাবার কথাই ধরা যাক। তিনি সরকারি চাকরি করতেন, অপশন দিয়ে এসেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি কলকাতায় হেড অফিসে কাজ করতেন। সে কারণে সেখান থেকে তিনি ঢাকার হেড অফিসে এলেন। আমরা কোথায় উঠব, কোথায় থাকার জায়গা হবে, সেটা জানতাম না।

আমার সদ্য প্রয়াত প্রকৌশলী মেজ ভাই বলেছিল, ঢাকা শহরে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে প্রথমবার নেমে তাঁর এই ভেবে কান্না পেয়েছিল যে আমরা কোথা থেকে কোথায় এলাম। শিয়ালদহের সেই আলো, আলোর মানুষ, সেই প্রাচুর্য থেকে এসে ফুলবাড়িয়ার যেখানে এসে নামলাম, সেখানে টিমটিম করছে বাতি, আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি, ঘোড়ার গাড়ি, দুর্গন্ধ, ধুলা।

১৪ আগস্ট আত্মীয়স্বজনসহ আমরা ভাগ্যকূল স্টিমার স্টেশনে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্টিমার আসবে গোয়ালন্দ থেকে। দেখে মনে হচ্ছিল, পাকিস্তানই যেন আসছে স্টিমারে চেপে। স্টিমার এল। স্টিমারের সামনে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে পতপত করে। কাগজে বানানো ছোট ছোট পতাকা দড়িতে বাঁধা। ওখান থেকে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’—এসব স্লোগান ভেসে আসছে। প্ল্যাটফর্ম থেকেও একই স্লোগান ভেসে আসছিল।

সে সময়ই আমার মনে হয়েছিল—এখন আরও বেশি করে মনে হয় যে চারপাশে একটা বিষণ্নতা ছিল। কোথাও কোথাও চাপা কান্না ছিল। বিশেষ করে যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁদের মধ্যে তো কান্নাই ছিল সেদিন। স্বাধীনতা তাঁদের উল্লসিত করেনি। তারপরে যা ঘটল, সেটা আমরা জানলাম, বুঝলাম অভিজ্ঞতা দিয়ে।

আমাদের যেসব আত্মীয়স্বজন বেসরকারি চাকরি করতেন, তাঁরা বেকার হয়ে গেলেন। মেডিকেল কলেজে যিনি পড়াশোনা করছিলেন, তিনি এখানে এসে কোথায় পড়বেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলেন। আমারই সমবয়সী দুই ফুফাতো ভাই ছিল। একজন আমার সঙ্গেই স্কুলে পড়ত। সে চলে গেল হাওর এলাকায়, তাহেরপুরে। তার বাবা পুলিশের দারোগা ছিলেন, ওসি হয়ে চলে গেলেন। তারপর তার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। আরেকজনের বাবা চাকরি করতেন স্টিমার কোম্পানিতে। তিনি বেকার হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলে চলে গেল বরিশালে, আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়বে বলে। দেশভাগের কারণে এভাবে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।

আমার কাছে ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক যেমন ছিল ফাঁসিতে ঝোলা মানুষটি, পাকিস্তানের ২৩টি বছরের প্রতীক হিসেবে দুটি ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটে আছে।

একটি ঘটনা ছিল আমাদের প্রতিবেশী কৃষক পরিবারের সন্তান হায়াত আলী আর জমত আলীকে নিয়ে। হায়াত আলীকে আমার বাবা রাজশাহীতে পিয়নের চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। হায়াত আলীর অবস্থা সে কারণে খুব খারাপ হয়নি। জমত আলী ছিলেন নৌকার মাঝি। তাঁকে আমরা বলতাম তুফানি। তুফানি এই অর্থে যে তিনি তুফানের বিরুদ্ধে নৌকা চালাতে পারতেন এবং তুফানের বেগে চালাতে পারতেন। তাঁর নিজের নৌকা ছিল না, অন্যের নৌকা বাইতেন। আমি তখন এমএ পরীক্ষা দিয়ে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের প্রভাষক হয়েছি। কলেজের যেখানে আমি থাকি, এক বিকেলে সেখানে জমত আলী এসে উপস্থিত। চেহারা অত্যন্ত মলিন ও বিধ্বস্ত। তাঁকে আমরা চাচা বলতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, আপনি হঠাৎ এখানে?’

তিনি বললেন, ‘আমি শুনলাম তুমি এখানে পড়াও। সে জন্য দেখা করতে আসলাম।’

আমি বললাম, ‘কী জন্য এসেছিলেন?’

তিনি বললেন, ‘আমাকে ডাকাতির মামলায় আসামি করা হয়েছে।’

ডাকাতির মামলার আসামি হয়ে এসেছেন তুফানি। ঘটনাটা আমাকে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিল। মনে হলো, হতেই পারে যে তিনি ডাকাতিতেই যুক্ত ছিলেন। কারণ, তাঁর তো কোনো দিশা নেই, কোনো জমিজমা নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র তাঁকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ওই তুফানি চাচার সেই চেহারাও আমার কাছে পাকিস্তানের প্রতীক হয়ে আছে।

আরেকটা প্রতীক আরও ভয়ংকর। একাত্তরের গণহত্যা কেমন ভয়ংকর আর বীভৎস ছিল, তা আমাদের সবারই জানা। মেহেরুন্নেসা নামে এক নারী কবিতা লিখতেন। তাঁর কথা কেউ এখন আর মনে করে না। গণহত্যার শিকার হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। এই মেহেরুন্নেসার ইতিহাস আমার কাছে পাকিস্তানের ইতিহাস বলে মনে হয়; পাকিস্তানের যন্ত্রণার প্রতীক বলে মনে হয়।

মেহেরুন্নেসার বাবা থাকতেন খিদিরপুরে। খিদিরপুর কলকাতার একটি মুসলমান–অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের বাসাটিও ওখানেই ছিল। মেহেরুন্নেসার বাবার ভবানীপুরে দুটি দোকান ছিল। দাঙ্গার সময় দোকান দুটি লুট হয়ে গেল। মেহেরুন্নেসার বাবা তখন একটা কয়লার আড়ত দিলেন। মেহেরুন্নেসার আর পড়াশোনা হলো না। ছোট্ট মেহেরুন্নেসা তাঁর বাবার দোকানে বসে থাকতেন। বাবাকে সাহায্য করতেন।

তারপর ১৯৫০ সালে দুই পারে ভয়ংকর দাঙ্গা হলো। সে দাঙ্গায় মেহেরুন্নেসারা আর কলকাতায় থাকতে পারলেন না। যৎসামান্য সম্পত্তি আর দোকানপাট যা ছিল, বিক্রি করে তাঁর বাবা ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় তাঁদের থাকার কোনো জায়গা নেই। ধোলাইখালের পাড়ে একটুখানি জায়গা নিয়ে মেহেরুন্নেসার বাবা ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু ব্যবসা করতে তো পুঁজি লাগে। সেই পুঁজি তাঁদের ছিল না। এরই মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা গেলেন।

পরিবারে মেহেরুন্নেসাই তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম। টাকার জন্য তিনি বাংলা একাডেমিতে নকলনবিশি, মানে কপি করতেন। ফিলিপস কোম্পানিতে একটি চাকরি নিয়েছিলেন। আর কবিতা লিখতেন।

মেহেরুন্নেসারা মিরপুরে বিহারি–অধ্যুষিত এলাকায় থাকতেন। খুব তেজি মেয়ে ছিলেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতেন, মিছিল করতেন। বিহারিরা সব জানত। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমির মাঠে বিপ্লবী কবিদের একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। মেহেরুন্নেসা সেখানে কবিতা পড়েন। আমি শুনেছি, তাঁর সেই কবিতা ২৫ মার্চ বেগম পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

এই ২৫ মার্চেই মেহেরুন্নেসাদের বাড়ি আক্রমণ করল অবাঙালিরা। বাড়িতে ছিলেন মেহেরুন্নেসা আর তাঁর মা ও ভাই। মা কোরআন শরিফ নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। আক্রমণকারীদের বললেন, ‘আমরা তো মুসলমান।’ অবাঙালিরা তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে উন্মত্ত। তারা তিনজনকেই হত্যা করল। এরপর ভাইয়ের মাথা কেটে নিয়ে চলে গেল। আর মেহেরুন্নেসাকে যা করল, সেটা আরও ভয়ংকর। তাঁকে তো মারলই। মেরে পাখার সঙ্গে ঝুলিয়ে পাখা ছেড়ে দিল। সে ঘুরতে থাকল। আমার কাছে এ–ই হলো পাকিস্তানের আরেকটি প্রতীক।

স্বাধীন বাংলাদেশে

এখন বাংলাদেশে আমরা কোন প্রতীকের কথা বলব? কাকে প্রতীক হিসেবে ধরব? ঘটনা তো অনেক। কোনটা বলব? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখনো তেলের জন্য, কাপড়ের জন্য আমাদের রেশন কার্ড খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে। আর পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখনো দুর্ভিক্ষের অবস্থা ছিল।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১৭ ডিসেম্বর আমি আর আমার এক আত্মীয় বেরিয়েছি। দেখলাম, লুণ্ঠন চলছে। যেন একটা উৎসব।

বিক্রমপুরের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আমাকে দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর তাঁর কমান্ডার তাঁকে বলেছেন, ঢাকায় যেতে হবে। তিনি তাঁর একটা দল নিয়ে ঢাকায় গেলেন। ওই তরুণ তখন বোঝেননি, ঢাকায় কেন যেতে হবে? পরে টের পেয়েছেন, কমান্ডার ঢাকায় এসে ইসলামপুরে সোনা, কাপড় ও ঘড়ির দোকানগুলোয় লুটপাট করেছেন।

তাঁর আরেকটা অভিজ্ঞতা হলো, তিনি একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখতে পেলেন, এক লোক মাটি কেটে ঝাঁকায় ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন লোকটি তাঁর পরিচিত। তাঁদের একটা ব্যান্ড পার্টি ছিল। তিনি ব্যান্ড বাজাতেন। গাড়ি থেকে নেমে এসে সেই তরুণ বললেন, ‘চাচা, কী করছেন?’

চাচা তাঁকে বললেন, ‘বলেছিলে না মুক্ত হব? এল তো মুক্তি। এখন আমি মাটি কাটছি।’

এসব ঘটনাও ঘটেছে। এখনো ঘটছে।

আবার আমি সেই আত্মহত্যার কথাই বলি। ছয়-সাত বছর আগে আমাদের গ্রামে একই পরিবারের তিনজন আত্মহত্যা করেন। মাছের ব্যবসা করবেন বলে ওই পরিবারের প্রধান ব্যক্তি বাবা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই ঋণ আর শোধ করতে পারেননি। সেটা নিয়ে যখন তাগাদা এসেছে, অসহায় বাবা ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। তা খেয়ে বাবা নিজে মরেছেন, মা মরেছেন এবং তাঁদের মেয়েটাও মরেছে। এই যে ব্রিটিশ আমলের সেই একজনের জায়গায় তিনজনের আত্মহত্যা, একেও কি আমি প্রতীক বলব?

আমরা প্রতিদিন আত্মহত্যার কথা শুনছি। কয়েক দিন আগে নোয়াখালীর সেনবাগে কামাল উদ্দিন মজুমদার নামের একজনের আত্মহত্যার কথা শুনলাম। খবর অনুযায়ী, তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর। তিনি আত্মহত্যা করেছেন নিজের বাড়ির কাঁঠালগাছে ঝুলে। আত্মহত্যার আগে ছোট ছোট কাগজে ছয় পৃষ্ঠার একটা চিরকুট লিখে গেছেন। সেখানে তিনি তাঁর দুঃখের কথা বলেছেন, ‘এই দুঃখ ঋণের দুঃখ, অভাবের দুঃখ।’ তিনি সামান্য লোক নন, সম্ভ্রান্ত লোক। স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর পরিবারে কোনো উপার্জনের মানুষ নেই, কিন্তু ঋণ আছে। একে আমি কিসের প্রতীক বলব?

অথবা ধরুন, সাম্প্রতিক কালে এক জল্লাদের মৃত্যুর খবর। তিনি কোনো পেশাগত জল্লাদ নন, একজন আসামি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন। তাঁকে দিয়ে ফাঁসির আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করানো হতো। অনেক লোকের ফাঁসি দেওয়ার কারণে তাঁর শাস্তি লাঘব করা হয়েছে। তিনি মুক্ত হয়েছেন।

মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেন। বিয়ে করেছিলেন। এর কয়েক দিন পরে থানায় গিয়ে তিনি ডায়েরি করলেন যে তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ি স্বর্ণালংকার ও টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। জল্লাদ বলেছেন, ‘আমি জেলখানাতে বরং ভালো ছিলাম, বাইরে এসে দেখি আমার এ রকম জীবন।’

কয় দিন আগে পড়লাম, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওই জল্লাদ মারা গেছেন, সম্ভবত সেই শোকেই। একে কী প্রতীক বলব?

এখন একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা যাক। তাঁকেও প্রতীক বলতে পারি। সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটিতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। পাকিস্তানিরা এক তরুণকে ধরে নিয়ে এসেছে। কারণ, তরুণটি মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর সঙ্গে অস্ত্র পাওয়া গেছে। ধরে আনার পর পাকিস্তানিরা ওই তরুণকে প্রশ্ন করেছে, ‘তোর সঙ্গে কে কে ছিল, নাম বল।’ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাটি কারও নামই বলেননি। এরপর পাকিস্তানিরা তাঁর বুকে বন্দুক চেপে ধরে বলেছে, ‘নাম না বললে গুলি করা হবে।’ তবু তিনি বলেছেন, ‘বলব না।’ এরপর তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে মাটি ছুঁয়ে দাঁড়ালেন। আর পাকিস্তানিরা তাঁকে গুলি করল। এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকেও আমরা বাংলাদেশের প্রতীক বলতে পারি।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রাণ দেওয়া নূর হোসেনকে আমরা প্রতীক বলতে পারি। প্রতীক বলতে পারি ডাক্তার মিলনকে।

তবে আমার কাছে প্রতীক বলতে একজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। সে একটি মেয়ে। একসময় আমাদের গ্রামে মেয়েদের কোনো বিদ্যালয় ছিল না। আমাদের মায়েদের প্রজন্মে, যাঁদের বাবারা সরকারি চাকরি করতেন, তাঁরাই কিছু লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন। যাঁরা গ্রামে থাকতেন, তাঁরা লেখাপড়ার সুযোগই পাননি। আমাদের গ্রামে মেয়েদের স্কুল হয়েছে, উন্নতি হয়েছে। সেই মেয়েদের স্কুল থেকে একটা মিছিলের ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। মিছিলে লেখা ছিল, ‘বখাটেদের রুখতে হবে’।

গ্রামে বখাটেরা খুব উত্ত্যক্ত করে মেয়েদের। মেয়েরা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে। যে মেয়েটি সামনে ছিল, সে ক্লাস টেনে পড়ে। প্রতিবাদে সে-ই সবচেয়ে মুখর। সবচেয়ে ভালো ছাত্রীও সে। সেই মেয়ে প্রতিবাদ করেছিল। পরে একদিন তারই চেনা এক যুবক তাকে এমন নোংরা কথা বলেছে যে সে নিজেদের বাড়িতে গাছের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে। এই মেয়েকেও আমরা প্রতীক বলতে পারি। মেয়েটি কিন্তু তার নিজের কারণে আত্মহত্যা করেনি। আত্মহত্যা করেছে সমষ্টির হয়ে প্রতিবাদ হিসেবে। তাকে উত্ত্যক্ত করছে যে ছেলে, যে ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে আগেও প্রতিবাদ করেছিল। শেষ প্রতিবাদটা করল নিজের প্রাণ দিয়ে।

এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী। কেন আশাবাদী, সেই কথাটা বলে শেষ করি। আশার কারণ হলো, মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন না দেখলে মানুষ মানুষ থাকে না। আমার একটা বই বের হয়েছে কিছুদিন আগে, নাম—স্বপ্ন ছিল, থাকবে। স্বপ্ন আছে বলেই আমরা এখনো আছি। স্বপ্নই টিকে থাকবে আজীবন। স্বপ্ন বলে যে মানুষের মনুষ্যত্ব অপরাজেয়।