কবিতার পাঠক কি কমে যাচ্ছে 

এখন মহাকালের যুগ নয়, মুহূর্তের যুগ। প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের এই অন্তর্জালিক যুগে কবিতার পাঠক কি কমে যাচ্ছে?

কবিতা মাতৃভাষার জাত ফসল। ভাষা কবিতায় সংকেত আকারে ব্যবহৃত হয়। শব্দ-বাক্যে কিছু চিত্রিত হয় বটে, কিন্তু কবিতা অবস্থান করে লিখিত শব্দ-বাক্যের শরীরের বাইরেই। যেনবা গোপন মন্ত্র, যা পঠিত হচ্ছে অভিব্যক্তি তার থেকে ঢের বেশি। কথার কথা, একটি কবিতা হয়তো একটা এক হাজার টাকার নোট, যার মধ্যে অসংখ্য আলাদা আলাদা নোট লুকিয়ে আছে। তারপরও সাধারণ শিক্ষিত লোকের ভিড়ে কবিতার পাঠক অনেক কম—হয়তো সব দেশে, সব কালে, সব ভাষাতেই কম। গল্প বা উপন্যাস পড়তে পারেন বা পড়ে থাকেন, এমন পাঠকেরও কবিতা পাঠের প্রস্তুতি না–ও থাকতে পারে। আর কবিতার পাঠক আরেকটু নির্বাচিত, আরও একটু গভীরতর পাঠক। সে কারণে কবিতার বইয়ের বিকিকিনিও সাহিত্যের অনান্য শাখার চেয়ে কম। তবে অনেকে বলেন, কবিতা সেই ‘নির্বাচিত পাঠক’–এর কাছ থেকে গড়পড়তা পাঠকের কাছে যাওয়া ‘টেক্সট’ হয়ে উঠলে সেই লেখায় ‘কবিতা’ অনুপস্থিত হয়ে যেতে পারে বৈকি! সে ক্ষেত্রে ব্যাপক পাঠকের বোধগম্যতায় না পৌঁছানো কবিতার জন্যই মঙ্গল—এমন মতও প্রতিষ্ঠিত। চর্যাপদ–এ কুক্কুরীপাদ রচিত পুরোনো একটি কবিতা থেকেই উদ্ধৃত করি, ‘কোড়ি মাঝে একু িহঅহি সমাইল’, যার অর্থ—এমন বাক্য রচিবে, যেন কোটিতে একজনের বেশি না বোঝে। 

বলা হয়, কবিতার দেশ, ভাবের দেশ বাংলাদেশ। যদিও কবিতা ঠিক কাকে বলে, কবিতার সংজ্ঞা কী—তা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু পড়তে পড়তে অনুভব করি, হ্যাঁ, এটি একটি কবিতা; অর্থাৎ অনুভবের একটা বড় দায়িত্ব আছে কবিতা আস্বাদনে। কবিতা সেই দায়িত্ব নিয়েই পাঠকের সামনে হাজির হতে চায়। বুদ্ধিবৃত্তিক রচনাভঙ্গির চেয়ে অনুভববৃত্তিই মুখ্য হয়ে রস সঞ্চার করে পাঠে, পাঠকের মনে। কয়েকটি বাক্যেই এত কথা কীভাবে আত্মগোপন করে থাকে কবিতায়, সেই বিস্ময় কবিতা ছাড়া অন্য ‘টেক্সট’–এ কতটাই–বা পাওয়া যায় আর! একজন চিকিৎসক কয়েকটি নাম-তথ্য লিখে দেন প্রেসক্রিপশনে, রোগী সেই অনুযায়ী ওষুধ কিনে খেতে খেতে সুস্থ হয়ে যান। সংগত কারণেই চিকিৎসকের লিখে দেওয়া প্রেসক্রিপশন শুধু কয়েকটি নাম-তথ্য নয়; বরং তার চেয়ে বেশি কিছু—এ তো আমরা জানি। কবিতাও কবির লিখে যাওয়া কয়েকটি বাক্যের বেশি কিছু, সে কথা অবশ্য খুব বেশি লোক জানেন বলে মনে হয় না। তাই কবিতাপাঠ থেকে রস নিতে পারার ক্ষমতা পাঠকের থাকতেই হবে। যাঁর নেই, তিনি আর যা–ই হোন, কবিতা-পাঠক হবেন না। এতে অবশ্য দোষ নেই কিছুই, কিন্তু গুণ কম আছে। তরকারিতে নুন কম থাকার মতো গুণ কম থাকা পাঠকের জন্য কবিতা নয়। এতে আবার হাপিত্যেশেরও কিছু নেই। এটি একটি স্বাভাবিক মাত্রা। 

সব সময়ই এমন আলোচনা-শঙ্কা চালু থাকে যে কবিতার পাঠক কি কমে যাচ্ছে? কবিতা কি পাঠক বুঝতে পারছেন না? কবিতা কি পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ছে? কিংবা যন্ত্রযুগের আরও বিস্তৃতিতে কবিতার পাঠক-গ্রাহক কি আরও কমে যাবে? কবিতা কি পাড়াগাঁর নদীটির মতো মরে যাবে? কবিতা মরে গেলে কবির কথা কি আমাদের মনে থাকবে আর? 

আদতে সব সময়ই কবিতার বইয়ের কাটতি কম। কবিতার পাঠক কম। আমি মনে করি, এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কোনো আর্ট তথা শিল্পকলার কোনো কলাই যেমন সব ধরনের গ্রাহকের জন্য নয়, সব খাদ্যও ঢালাওভাবে সব মানুষ একই রকম পছন্দ করে না। এতে কিন্তু সেই খাদ্যের সংকট প্রমাণিত হয় না। স্বাদবৈচিত্র্যের ভিন্নতা আছে, পাঠবৈচিত্র্যের ভিন্নতাও থাকবে। যার যার সাধ ও সাধ্য, রুচি ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তার তার মধ্যে গ্রহণ–ক্ষমতা নিহিত; অন্য কথায় বলতে পারি, ক্ষমতা অনুযায়ী তা বিদ্যমান থাকে, সেই অনুযায়ী মানুষ খাদ্য খায়, পোশাক পরে, চলাফেরা করে। পাঠক হিসেবেও ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষ তার গ্রহণীয়তার দিকে যাবে। আর গড়পড়তা কবিতার গতিপ্রকৃতি নিয়েও কথা বলায় গলদ থাকে বিস্তর। কবি বলতে কি একই সময়ের সব কবিকেই একাকার করে দেখব আমরা? সব কবিতাকেই কি সমান ‘মূল্য’ দিয়ে আমরা দেখতে পারি? কাজেই কবিতার পাঠক এখন আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে—এ কথা একবাক্যে বলা যাবে না। ধরা যাক, গত শতাব্দীর ষাটের দশকের সমাপনীর দিকে আবুল হাসান বা নির্মলেন্দু গুণ কবিতা লিখতে শুরু করেন, সেই সময়ের বাস্তবতায় আরও যাঁরা লিখতেন বা কমবেশি লিখেছেন, যেমন মুস্তফা আনোয়ার বা নূরুল হক—তাঁরা সবাই তো একই সময়ের কবি। পাঠক কি তাঁদের সবাইকেই সমানভাবে গ্রহণ করেন? ফলে পাঠকেরও শ্রেণি বা পৃথক্​করণ না করলে এই আলোচনার কোনো গন্তব্য থাকবে না। এখন যদি বলি, ষাটের দশকে বাংলা কবিতায় জোয়ার বয়ে গেছে। সেই জোয়ারে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, নূরুল হক বা মুস্তফা আনোয়ারসহ সবাই একই রকমভাবে পৌঁছেছেন পাঠকের কাছে, ঠিক বলা হবে? 

আগেই প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘পাঠক’ শ্রেণির আড়ালে কি সবাই একই ওজনের রস আস্বাদনকারী? কোনো পাঠক বলতে পারেন, আবুল হাসানের কবিতায় মজা বেশি, নির্মলেন্দু গুণ অনেকটাই স্টেটমেন্ট লিখেছেন। স্টেটমেন্ট কতটুকু কবিতা আর কতটুকু–ই বা ‘কবিতার মতো’? কোনো পাঠক আবার স্টেটমেন্টকেই বলতে পারেন ভালো কবিতা—সেই স্বাধীনতা তাঁর শতভাগ আছে। কোনো পাঠক হয়তো বলবেন, ‘আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্য রকম’—এর কমতি কোথায়? সেই সময়ের বাস্তবতায় ‘হুলিয়া’ কি কম প্রভাববিস্তারি কবিতা? ‘হুলিয়া’ কি শুধু স্টেটমেন্ট? তবু মুস্তফা আনোয়ার বা নূরুল হকও যতটুকু পৌঁছেছেন পাঠকের কাছে, পৌঁছাতেই পারেননি; কিন্তু লিখে গেলেন, এলাকার কবি হিসেবে কোথাও কারও যে অবস্থান, তার মূল্যায়ন কীভাবে হবে? কাজেই একবাক্যে যেমন বলা যাবে না সব কবিই এক কবি নন, তেমনি সব পাঠকও এক পাঠক নন। তাই গড়পড়তা বলা কি সংগত হবে, আগে কবিতার পাঠক বেশি ছিল, এখন কম? 

তবে হ্যাঁ, কিছু বিষয় আমাদের সামনে এমন জলজ্যান্তভাবে হাঁ করে আছে যে তার থেকে আমরা কিছু নির্ণয় করার চেষ্টা করে দেখতে পারি। তাকাতে পারি আমাদের সমাজ–ইতিহাসের দিকে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ভৌগোলিকভাবে আমরা স্বাধীন ছিলাম না, জাতীয়তাবাদ আমাদের কাছে তখন আকর্ষণীয় কিছু তো ছিলই, তাই কবিতারও একটা প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ব্যবহার হয়েছে সে সময়। তখন টেলিভিশন ছিল না, পত্রপত্রিকাও ছিল কম, সামাজিক বিনোদনের জানালা–দরজা দিয়ে কি আর এমন ঢুকতে পারত! গত শতকের আশির দশকেও, তখন তো মানুষের কাছে আজকের মতো এত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম—ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ইন্টারনেট আসেনি। সেই সময়ে কবিতার রাজনৈতিক ব্যবহার ও প্রভাব আমরা দেখেছি। রাজাকে কটাক্ষ করে কবি কবিতা লিখলেন। রাজার হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিনি পালাতে চাইলেন। রাজার লোকেরা কবিকে ধরে আনল সমুদ্রতীরের জেলেপল্লি থেকে। দিনে দিনে রাজার বিরুদ্ধে কবিতার প্রতিবাদী সংগঠন গড়ে উঠল। রাজার বিরুদ্ধে প্রচুর কবিতা লেখা হলো। হয়তো সেগুলো বেশির ভাগই নিচুমানের রচনা। কিন্তু এই ‘নিচুমান’ বলার আমি কে? হ্যাঁ, পাঠক হিসেবে আমি হয়তো এটা বলছি, কিন্তু কে বলবে, এই মন্তব্য একধরনের পাণ্ডিত্য জাহিরি? এবং আশ্চর্য ব্যাপার, সেই রাজা নিজেও কবিতা লিখতেন। রাজা অবশ্য ‘দেশ’, ‘বন্যা’, ‘মানুষের পাশে এসে’ কিংবা পয়লা বোশেখে বৈশাখী কবিতা আর ফেব্রুয়ারিতে ‘মাতৃভাষা বাংলা বাংলা’ বলে কবিতা লিখেছেন। রাজা লিখেছেন, ‘কনক প্রদীপ জ্বালো’। সেই কাব্য নানান ভাষায় অনূদিত হয়। রাজার বিপক্ষে দাঁড়ানো কবিদের সেই সংঘ পরে অবশ্য অন্য রাজার দরবারে আতিথেয়তায় বুঁদ হয়ে দীর্ঘকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে এ প্রশ্ন তোলাই যায়, আশির দশকের সেই কবিতাগুলো তখন সামাজিক-রাজনৈতিক একটা জনপ্রিয়তা বা পরিচিতি পেয়ে গেলেও টিকে আর থাকল কি? বাংলা কবিতার দার্শনিক ভ্রমণে এসব কবিতা কোনো প্রভাব রাখতে পারল? 

চারধারে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট। পরিস্থিতি আগের চেয়ে দারুণভাবে আলাদা। আগে একটি কবিতা ছাপানোর জন্য সাহিত্য সম্পাদকের বিবেচনা বা কখনো কখনো অনুকম্পা পেতে হতো। নইলে দলগতভাবে অত্যন্ত শ্লাঘার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন–প্রচেষ্টা ছিল। এখন ইন্টারনেট এসে সে ভূগোল পাল্টে গেছে। দিন দিন অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে গুগল। পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে বসে পড়ার দিন প্রায় শেষ হতে চলেছে। এমনকি প্রচলিত গণমাধ্যমের ক্ষমতা অনলাইন মিডিয়ার কাছে ক্রমে বাসি হয়ে উঠছে। গ্রাহকের হাতের ফোনেই তাঁরা পেয়ে যাচ্ছেন সব। প্রিন্ট মিডিয়ার কবিও অনলাইন মিডিয়ায় তাঁর বইয়ের খবর ছাপাচ্ছেন মনের আনন্দে। বাস্তবতা যখন এই, তখন ফেসবুক বা বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন আর ব্লগে বিস্তর কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। তবে সেগুলো সবই কি কবিতা? ভালো কবিতা? নাকি মনের ভাব প্রকাশমাত্র? এ রকম বিতর্ক চালু থাকবেই। তবু অনলাইনে প্রকাশিত লেখা দিয়েই ফি বছর বইমেলায় বই প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠক দেদার কিনছেন। আবার সেই পাঠক? কবিতার পাঠকও প্রায় কবি, হয়তো তাঁর শুধু লেখাই হয় না। লেখা একটা অনুশীলন, সেই অনুশীলন সবার থাকে না, সবার সমানভাবে থাকে না। তাই যাঁর যাঁর অনুভব প্রকাশ হয় যাঁর যাঁর বাক্যবন্ধনীতে। হয়তো একেই আমরা বলি কণ্ঠস্বর। একেকজন মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো একেকজন কবির কণ্ঠস্বরও পৃথক হতে থাকে। যে কারণে ১৮৯৯ সালে জন্ম নেওয়া দুজন বাঙালি  কবি—একজনের নাম কাজী নজরুল ইসলাম, আরেকজন জীবনানন্দ দাশ—কী দারুণভাবেই না তাঁদের কবিতার কণ্ঠস্বর আলাদা রকমের! দুই কবিরই পাঠক অনেক, প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে তাঁরা পঠিত হচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন, মহাকাল তাঁদের কোলে টেনে নিয়েছে। 

এখন মহাকালের যুগ নয়, মুহূর্তের যুগ। মুহূর্ত লিখে পাশে মহাকাল লেখা যায়? হা হতোস্মি! এই সময়ে মানুষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পেতে চায়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার ব্যবস্থা এসে গেছে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক বিকাশ ঘটার কারণে। এখন আর মহাকাল মনে রাখবে বলে বিদ্যমান কোনো পরিস্থিতি লক্ষণীয় নয়। খুব নামডাকঅলা কোনো কবি মারা গেলে ফেসবুকের নিউজফিডে কবির ছবি ঘুরবে দুই দিন। তিন দিনের মাথায় অন্য কারও ছবি চলে আসবে। কারণ, বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃত্যুও তো চলতেই থাকবে। আর সেই কবির সঙ্গে তোলা ছবি থাকলে—এখন তো প্রায় থাকেই—ওই ছবি আপলোড দেবেন পাঠক। তাৎক্ষণিকভাবেই পাঠকের পছন্দ, ভালোবাসার কথা জানা যাবে। মন্তব্যও জানিয়ে দিতে পারবেন সবাই। আগের চেয়ে এখনকার এই ব্যাপকতর পরিবর্তনের ফলে এ মন্তব্যও একবাক্যে করা কঠিন যে কবিতার পাঠক কি ক্রমে কমে যাচ্ছে বা আগের তুলনায় হ্রাস পাচ্ছে? জীবনযাপনের ফাঁকে নিজের জন্য পাওয়া সময় খরচ করার মাধ্যম এখন অনেক। এতে কবিতার সেই দাপুটে প্রভাব কিছুটা তো খর্ব হয়েছেই। কবিতার বাইরে অনেক রসতৃপ্ত উপাদান যদি থাকে, সেই ‘নির্বাচিত পাঠকের একজন’ হয়ে ওঠার সাধন-কসরত কেন কেউ করতে যাবে? 

কেউ কেউ যাবেই। যেমন সবাই কবি নয়, ‘কেউ কেউ কবি।’