প্রযুক্তির উৎকর্ষের সীমারেখা কোথায় টানা উচিত

নেটফ্লিক্সের দারুণ আলোচিত সিরিজ ‘থ্রি বডি প্রবলেম’। গত মাসের শেষে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মটিতে সবচেয়ে বেশিবার দেখা হয়েছে সিরিজটি। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিনির্ভর এ সিরিজ অনেক দর্শকের মনেই জাগিয়েছে গুরুতর এক প্রশ্ন, যখন ক্রমাগত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ছে, অ্যালগরিদম নির্ধারণ করছে জীবনাচরণ, সেই সময়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সীমারেখা কোথায় টানা উচিত?

‘থ্রি বডি প্রবলেম’ সিরিজে এমন এক উন্নত প্রজাতি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে, যারা মানুষকে তুলনা করে পোকামাকড়ের সঙ্গেছবি: সংগৃহীত

১৯৬৬ সাল। বেইজিং শহর। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপক্ষে স্লোগান দিতে থাকা উত্তেজিত তরুণদের সামনে উন্মুক্ত মঞ্চে চলছে ‘স্ট্রাগল সেশন’ বা সংঘাত পর্ব। এই পর্বে ‘শ্রেণিশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের জনতার সামনে আনা হয়। নানাভাবে অপদস্থ করে তাঁদের নিজেদের কথিত ‘অপরাধ’ স্বীকার করানো হয়। এই অপদস্থ করার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন ‘অপরাধী’ হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির শিক্ষার্থী, সহকর্মী, সতীর্থ—এমনকি পরিবারের সদস্যরা। যে সংঘাত পর্বের কথা বলছি সেখানে দেখা যায়, পদার্থবিজ্ঞানের এক শিক্ষককে তাঁর শিক্ষার্থীরাই হেয় করছেন। একপর্যায়ে তাঁর স্ত্রীকেও ডেকে আনা হয়, যিনি নিশ্চিত করেন যে তাঁর স্বামী বিপ্লবের শত্রু। এ ঘটনার একপর্যায়ে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কারণ, ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র মিথ্যা—এ কথা বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। আর তাঁর এই অস্বীকৃতিকে চীনা কমিউনিজমের বিরোধিতা হিসেবে ধরে নেয় উত্তেজিত তরুণ বিপ্লবীরা।

‘টোটালিটারিয়ান’ বা চরম কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনসাধারণের সামষ্টিক চিন্তা যে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার এই নিদর্শন সমান্তরালে চলতে থাকা কয়েকটি দৃশ্যপটের মধ্যে একটি, যা দেখানো হয় নেটফ্লিক্সের আলোচিত সিরিজ ‘থ্রি বডি প্রবলেম’-এর প্রথম পর্বে। গত মাসের শেষে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মটিতে সবচেয়ে বেশিবার দেখা হয়েছে এই সিরিজ। অবশ্য একই নামের যে চীনা উপন্যাস থেকে সিরিজটি তৈরি করা হয়েছে, তা এই নির্মম হত্যার দৃশ্য দিয়েই শুরু হয়।

‘রিমেমব্রেন্স অব দ্য আর্থ’স পাস্ট’ উপন্যাসত্রয়ের প্রথম পর্ব ‘দ্য থ্রি বডি প্রবলেম’। চীনা কম্পিউটার প্রকৌশলী ও কল্পবিজ্ঞান কাহিনিকার লাশিন লিউ ২০০৮ সালে এই উপন্যাস বই আকারে প্রকাশ করেন। ২০১৪ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়ার পর থেকেই এই কল্পবিজ্ঞানধর্মী উপন্যাসটি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

‘থ্রি বডি প্রবলেম’ এমন এক উন্নত প্রজাতি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে, যারা মানুষকে তুলনা করে পোকামাকড়ের সঙ্গে। যারা চিন্তায় অভিন্ন, যাদের সব সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধ এবং যারা ব্যক্তিগত মত, অনুভূতি ও চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত নয়। ‘সোফন’ নামের এমন এক প্রোটনের আকৃতির একটি কম্পিউটার তৈরি করে তারা পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীতে। এই সোফনের নজরদারিতে গোটা পৃথিবী পরিণত হয় এক প্যানোপটিকনে।

উপন্যাসটিকে চিত্ররূপ দেওয়া মোটামুটি অসম্ভবই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, পদার্থবিদ্যার নানা জটিল সূত্র ও সমীকরণ, সমান্তরালে বয়ে চলা একাধিক সময়প্রবাহ, একের পর এক বিজ্ঞানীর মৃত্যুর রহস্য উদ্‌ঘাটন, ভিনগ্রহবাসী এক জাতির হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা—এমন নানা ঘটনার তালগোল পাকিয়ে থাকা গিঁট ছাড়িয়ে পর্দায় রূপায়ণ কী করে সম্ভব?

কিন্তু আট পর্বের সিরিজে তার সূচনা ঘটিয়েছেন আগেও অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানো ডেভিড বেনিওফ ও ডিবি ওয়েইজ। টেলিভিশনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনস’-এর নির্মাতা তাঁরাই। কিন্তু একটি জটিল বিজ্ঞাননির্ভর সিরিজের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিক ও দার্শনিক প্রশ্নই আমাকে—এবং হয়তো আরও কাউকে কাউকেও—বেশি নাড়া দিয়েছে।

‘থ্রি বডি প্রবলেম’ সিরিজের দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

লেখার শুরুতেই যে দৃশ্যের কথা বলছিলাম, সেটায় ফিরে আসি। এই দৃশ্যের অংশ হিসেবে ছিলেন ওই পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষকের মেয়ে ইয়া ওয়েনজিয়া। মানবজাতির নির্মমতা ও পরমত অসহিষ্ণুতার এই নজির তাঁর বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।

মঙ্গোলিয়ার গভীরে একটি শ্রমশিবিরে তাঁকে বাধ্য করা হয় শত শত বছরের পুরোনো গাছ কেটে ফেলতে। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে যখন মৃত্যু প্রায় অনিবার্য, তখন জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায় দক্ষতার কারণে তাঁকে পাঠানো হয় একটি রহস্যময় ও গুপ্তবিজ্ঞান প্রকল্পে। এরপরই মোড় ঘুরে যায় গল্পের।  আর এ পর্যায় থেকেই দর্শককে এক দার্শনিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

এই সিরিজ বারবার একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—মানবতা আসলে কী? হাজারো আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহের বাসিন্দাদের কাছে সংকেত পাঠাতে সফল হন ইয়া ওয়েনজিয়া? জবাবও আসে। তবে সে জবাব ছিল একজন শান্তিবাদীর, যিনি সতর্ক করে বলেন, এ গ্রহের বাসিন্দারা পৃথিবীর দখল নিতে চায়। ওয়েনজিয়া বলেন, মানুষ নিজেকে বাঁচাতে অক্ষম। মানবজাতি নিজেদের যে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, ভিনগ্রহবাসীর আগ্রাসন হয়তো তার চেয়ে ভালো কিছু হবে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপক্ষে স্লোগান দিচ্ছে চীনের তরুণেরা
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক প্রাণক্ষয়-পরবর্তী বাস্তবতায় ব্রিটিশ কবি টি এস ইলিয়ট লিখেছিলেন ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’। ধ্বংস, বিষাদ আর অবিশ্বাসে পরিপূর্ণ সেই বিরানভূমিতে মানবতা কেবল একটি প্রশ্ন হয়ে ঘুরপাক খায়। ইলিয়ট লেখেন—              
‘মানবসন্তান,
তুমি বলতে বা অনুমান করতে পারো না,
কারণ তুমি কেবল চেনো
ভাঙা চিত্রের স্তূপ।’
বাস্তবতার এই বিক্ষিপ্ত চিত্র আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। পারমাণবিক বোমার বিনাশী শক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটে মানুষের। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মানুষের ওপর মানুষেরই চালানো ধ্বংসযজ্ঞ মানবতার অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পারমাণবিক যুগের শুরু থেকেই প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ এবং দূষণে বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ। বিশ্বজুড়ে ভূতাত্ত্বিক, জলবায়ুগত ও বাস্তুতান্ত্রিক পরিবর্তনে মানুষই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এমনকি তাঁরা একটি ভূতাত্ত্বিক যুগের প্রস্তাবও করেছেন, যাকে বলা হচ্ছে ‘অ্যানথ্রোপোসিন’। নৃপ্রস্তর যুগের পর নতুন এই যুগ মানবসৃষ্ট এবং অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের প্রতি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নয়।

‘থ্রি বডি প্রবলেম’ সিরিজের দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

‘থ্রি বডি প্রবলেম’–এ এমন এক উন্নত প্রজাতি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে, যারা মানুষকে তুলনা করে পোকামাকড়ের সঙ্গে। যারা চিন্তায় অভিন্ন, যাদের সব সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধ এবং যারা ব্যক্তিগত মত, অনুভূতি ও চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত নয়। ‘সোফন’ নামের এমন এক প্রোটনের আকৃতির একটি কম্পিউটার তৈরি করে তারা পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীতে। এই সোফনের নজরদারিতে গোটা পৃথিবী পরিণত হয় এক প্যানোপটিকনে। উনিশ শতকে জেরেমি বেন্থাম কারাগার তৈরিতে এই নকশার প্রস্তাব করেছিলেন। যেখানে কারাগারটি এমনভাবে তৈরি হবে, যাতে একজন সর্বক্ষণ সব কয়েদির দিকে একসঙ্গে নজর রাখতে পারেন। পরবর্তীকালে ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো প্যানোপটিকনের ধারণার সহায়তায় ক্ষমতাকাঠামোকে ব্যাখ্যা করেন। ‘ডিসিপ্লিন’ গ্রন্থে ফুকো বলেন, ‘যিনি দৃশ্যমান কোনো স্থানে আবদ্ধ এবং যিনি তা জানেন, তিনি নিজেই ক্ষমতার কাছে বাধ্যতা স্বীকার করে নেন; তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজের ওপর তা প্রয়োগ করতে দেন; নিজেই ক্ষমতাকাঠামোতে নিজের স্থান নির্ধারণ করেন, যেখানে নিজেই দুটি ভূমিকাই পালন করেন; নিজের দাসত্বের কারণ নিজেই বনে যান।’

যেকোনো ইলেকট্রনিক তথ্য, বার্তা ও যোগাযোগ উদ্ধার করতে পারা এই সোফন মনে করিয়ে দেয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই দুনিয়ায় এমন সর্বগ্রাসী নজরদারির মধ্যেই আমাদের বসবাস। যেখানে ক্রমাগত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ছে। অ্যালগরিদম নির্ধারণ করছে আমাদের জীবনাচরণ। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার খেলায় মানবতার অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকছে? প্রযুক্তির উৎকর্ষের সীমারেখা কোথায় টানা উচিত?—এমন নানা প্রশ্নের ঘূর্ণাবর্তে আপনাকে ঠেলে দেবে ‘থ্রি বডি প্রবলেম’। তবে অবশ্যই চমকপ্রদ ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস, টান টান উত্তেজনাপূর্ণ প্লট টুইস্ট এবং ঠাস বুনটের গল্পের পরিপূর্ণ আনন্দ দেওয়ার পরই।