রওশন আরা আমিন
বিরুদ্ধ বাস্তবতায় চিত্রশিল্পী হয়েছিলেন যিনি
চিত্রশিল্পী রওশন আরা আমিন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের, প্রথম ছাত্রী ব্যাচের অন্যতম শিক্ষার্থী। ছোট থেকেই বড় শিল্পীদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছিল তাঁর। নিভৃতচারী এই শিল্পীর প্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা।
৮ মে ৮৮ বছর বয়সে অনন্তলোকে চলে গেলেন নিভৃতচারী চিত্রশিল্পী রওশন আরা আমিন। তিনি ছিলেন তৎকালীন সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রথম ব্যাচের অন্যতম শিক্ষার্থী।
বলা ভালো, সেই ১৯৫৪ সালে চিত্রবিদ্যা শিখতে তাঁর সঙ্গে ভর্তি হওয়া বাকি চারজনের অন্যতম হলেন শিল্পী তাহেরা খানম, যিনি প্রয়াত বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর স্ত্রী, তিনিও বেঁচে নেই। তাঁদের একজন শিল্পী আমিনুল ইসলামের স্ত্রী, অন্যজন যোবায়দা ইসলাম, শিল্পী নুরুল ইসলামের স্ত্রী। সময়ের সাহসী এসব মেয়ে সেদিন বিরুদ্ধস্রোতে পথ হেঁটে চিত্রবিদ্যা গ্রহণ করেছিলেন। এই পাঁচ শিল্পীর মধ্যে রওশন আরা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ছিলেন।
ঢাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে রওশন আরা আমিনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২২ এপ্রিল। তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষা ঢাকাতেই। আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬০ সালে তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে নকশাবিদ হিসেবে শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে যোগ দেন এবং দীর্ঘ বত্রিশ বছর সরকারি দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯২ সালে সহকারী প্রধান নকশাবিদ হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন প্রয়াত চিত্রশিল্পী এহসান উল আমিনের স্ত্রী, যিনি শিল্পী শফিকুল আমিনের ছোট ভাই। রওশন আরার আরেকটি পরিচয় হলো, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সহধর্মিনী জাহানারা আবেদিনের ছোট বোন। বেগম আবেদিন বেঁচে আছেন। তবে বয়সের ভারে তিনি আছেন স্মৃতি-বিস্মৃতির ঘোরে।
তাঁর শিল্পীমানস গড়ে উঠেছে লোককলা ও লোকায়ত জীবনের রূপ তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষায়। কর্মক্ষম থাকাকালে বেশ কতক ছবি তিনি এঁকেছেন। তাঁর আঁকা কিছু চিত্রকর্ম আমি দেখেছি। সেসব চিত্রকর্মে যে লোকজ ধ্যান এবং সেই ধ্যানকে আধুনিক প্রকরণের সঙ্গে সৃজনশীলভাবে মেলানোর যে প্রচেষ্টা আছে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁর এসব চিত্রকর্ম আমাদের এই অঞ্চলের ঐতিহ্যকেই তুলে ধরেছে।
ছোট থেকেই বড় শিল্পীদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছিল রওশন আরা আমিনের। কাছে থেকে শিল্পাচার্যসহ বড়দের কাজ দেখেছেন। নকশাকেন্দ্রে চাকরিসূত্রে অভিভাবকরূপে পেয়েছেন পটুয়া কামরুল হাসানকে। ফলে তাঁর শিল্পীমানস গড়ে উঠেছে লোককলা ও লোকায়ত জীবনের রূপ তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষায়। কর্মক্ষম থাকাকালে বেশ কতক ছবি তিনি এঁকেছেন। তাঁর আঁকা কিছু চিত্রকর্ম আমি দেখেছি। সেসব চিত্রকর্মে যে লোকজ ধ্যান এবং সেই ধ্যানকে আধুনিক প্রকরণের সঙ্গে সৃজনশীলভাবে মেলানোর যে প্রচেষ্টা আছে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁর এসব চিত্রকর্ম আমাদের এই অঞ্চলের ঐতিহ্যকেই তুলে ধরেছে।
আমি নকশাকেন্দ্র ও চারুকলায় কয়েকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি। কথা বলতেন অনুচ্চস্বরে, মুখে লেগে থাকত মৃদু হাসি আর কথা শুনতেন ভালো লাগার কেমন একটু কৌতূহল নিয়ে। মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তিনি সবার কাছেই ছিলেন বিশেষ একজন!
তিনি বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সংগঠনের কাজে নানাভাবে আমাদের সাহায্য করতেন। নকশাকেন্দ্রে কাজ করা চারুশিল্পীদের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন, চারুশিল্পী সংসদের আয়োজনে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালি গ্যালারিতে যে প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল, তাতে আমরা তাঁর কাজ দেখেছি। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চারুশিল্পশিক্ষার পঞ্চাশ বছর উদযাপনে চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে আয়োজিত বিশেষ প্রদর্শনীতেও রওশন আরা আমিনের চিত্রকর্ম ছিল। শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ বিশেষ প্রদর্শনীতেও স্থান পেয়েছে তাঁর চিত্রকর্ম।
নিভৃতচারী এই শিল্পী বিগত কয়েক বছর খুব একটা বাড়ির বাইরে বেরোতেন না। তাঁর দুই মেয়ে মেঘনা আমিন ও ইলোরা আমিন—দুজনই প্রবাসী। ইলোরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের কৃতি শিক্ষার্থী হিসেবে ‘কালিনান পুরস্কারপ্রাপ্ত’।
৮ মে পরিণত বয়সেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন রওশন আরা আমিন। তিনি অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
আমরা তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।