ব্রাবো থেকে বঙ্গবন্ধু
আমাদের দেশের মানুষ প্রায়ই চায়ের দোকানে যায় আয়েশ করে এক কাপ চা খেতে। গ্রামের মানুষ বসে টং দোকানে, নগরের মানুষ খোঁজে ফুটপাত বা পাড়ার রাস্তার মোড়ের দোকান। ব্যাপারটা বেশ স্বচ্ছন্দের। এই চা খাওয়ার মধ্যে একধরনের শান্তি আছে, আরাম আছে, কিঞ্চিৎ বিলাসিতাও আছে। দেশজীবনে আমার এই অভিজ্ঞতা খুবই স্বল্প। আমার বিদেশজীবনে প্রায়ই এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি আমি। সে আমার অ্যানটর্পের বিদেশজীবন। বেলজিয়ামের উত্তরের শহর অ্যানটর্প। আমার ১২ ফুট বাই ১২ ফুটের স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে হাতের ডানে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকতাম, সোজা। মিনিট ছয়-সাতেক এগোলেই অ্যানটর্প শহরের সিটি হল। সিটি হলের আশপাশের স্থানটির নাম—গ্রতে মার্কেট; রেস্তোরাঁ এবং ক্যাফেতে পূর্ণ। এখান থেকে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই শেল্ট নদী, যে নদী মিশেছে উত্তর সাগরে। আমি সিটি হলের সামনে একটা তুর্কি দোকানে গিয়ে বসতাম। পকেট থেকে বের করতাম ২ ইউরো। আমার পেটের চাহিদামাত্র একটা ‘মিন্ট টি’; বাংলায় বললে দাঁড়ায় পুদিনা চা।
কেমন যেন চোঙার মতো একধরনের চায়ের কাপ। কাপের গরম চায়ের ওপরে কয়েকখানা পুদিনাপাতা ভাসে। চায়ের চেয়েও বেশি আবেদনময়ী এই পুদিনাপাতার ঘ্রাণ। চুমুক দেওয়ার জন্য ঠোঁট সক্রিয় হওয়ার আগেই নাসারন্ধ্র উতলা হয় পুদিনার ঘ্রাণ নিতে। আমি কাপে চুমুক দিই, আমার অস্থির মন শান্ত হয়। কিন্তু সম্মুখে তাকালে মন আবার খানিক বিচলিত হয়। কারণ, সম্মুখে আমার এক বন্ধু। আমরা মুখোমুখি। মাঝে দশ-বারো হাত ব্যবধান বড়জোর। না, রক্ত-মাংসে গড়া বন্ধু তো নয় সে। সে আমার এক প্রাণহীন—নির্জীব বন্ধু। একটি ভাস্কর্য। একজন বীরের ভাস্কর্য । নাম তার সিলভিয়াস ব্রাবো। একটি রোমান পৌরাণিক চরিত্র। ব্রাবোকে বলা হয় স্থানীয় এক কিংবদন্তি। সে কিংবদন্তি অদ্ভুত এক কাণ্ড করছে। কবজি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি হাত নিক্ষেপ করছে। আমি পুদিনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুর দিকে তাকাই। বন্ধু উদাসীন, তার দৃষ্টি ঊর্ধ্বাকাশে। আমার বিস্ময় বাড়ে।
রোমান পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত আছে, সিলভিয়াস ব্রাবো একজন রোমান সৈনিক। যে ড্রিউন অ্যান্টিগুন নামের এক দৈত্য বা কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। কেন? জনশ্রুতি আছে, ড্রিউন অ্যান্টিগুন শেল্ট নদী পারাপারের যে ব্রিজ তার কাছাকাছি বসবাস করত। ড্রিউন অ্যান্টিগুন নৌকাচালকদের ও যাত্রীদের কাছ থেকে শেল্ট নদী পারাপারের সময় অর্থ দাবি করত। এমনকি যারা ব্রিজের ওপর দিয়ে পার হতো তাদের কাছ থেকেও পয়সা আদায় করত। তারা দিতে না পারলে বা দিতে না চাইলে ড্রিউন অ্যান্টিগুন তাদের হাত কবজি থেকে কেটে নদীতে ফেলে দিত। শেল্ট ব্রিজ ব্যবহারে অ্যান্টিগুনের নিষেধাজ্ঞা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। জনগণের মাঝে ছিল ক্ষোভ, কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ছিল না কেউই। মানুষের ক্রান্তিলগ্নেই দেখা যায় নেতৃত্বের অভাব। ইতিহাসে দেখা গেছে, মানুষকে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করে দিয়েছেন কোনো কালজয়ী নেতৃত্ব। তো সবাই যখন ড্রিউন অ্যান্টিগুনের অত্যাচারে অতিষ্ট, সেই সময়েই অ্যানটর্প শহরে এসেছিলেন সিলভিয়াস ব্রাবো। একসময় ব্রাবো অ্যান্টিগুনের অত্যাচারের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি অ্যান্টিগুনকে হত্যা করেন এবং তার নিপীড়নের উপযুক্ত জবাব হিসেবে অ্যান্টিগুনের হাত কবজি বরাবর কেটে নদীতে ফেলে দেন। এই কাহিনিকে কেন্দ্র করেই আমার সম্মুখের ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে এখানে। আর এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রাবো স্ট্যাচু’। সিটি হলের সামনের ভাস্কর্যটি পুরাণের সেই মুহূর্তটি ধারণ করেছে। এই পৌরাণিক কাহিনি এখনো প্রচলিত এই অ্যানটর্প শহরে।
ব্রাবোর ভাস্কর্যটিতে দেখানো হয়েছে, ব্রাবো দৈত্যের হাত নদীতে ছুড়ে ফেলছে। ছেঁড়া হাত থেকে পানি পড়ছে, যা দিয়ে আসলে রক্তকে বোঝানো হয়েছে। ভাস্কর্যটির পদস্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছে মাছ, সিংহ, কচ্ছপ, ড্রাগনের মতো প্রাণীদের দিয়ে। আর সিলভিয়াস ব্রাবোর পায়ের নিচে রয়েছে দৈত্যাকার অ্যান্টিগুনের বিচ্ছিন্ন মাথা। ডাচ ‘হ্যান্ডওয়ার্পেন’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘হাত নিক্ষেপ’ বা ‘হাত ছোড়া’। ধারণা করা হয়, ‘হ্যান্ডওয়ার্পেন’ শব্দটি থেকে এই শহরের নাম ‘অ্যান্টওয়ার্পেন (Antwerpen)’ এসেছে। শুধু কি রোমান পুরাণ, গ্রিক পুরাণ আর রামায়ণ মহাভারতে তো আমরা কত কত বীরের উপকথা শুনি, যাদের প্রধান ব্রত ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
আমার পুদিনার চা ঠান্ডা হয়, আমি পুরাণ থেকে বর্তমানে ফিরি। আমি দেখেছি যুগে যুগে মানুষের মুক্তি এসেছে কেবল প্রতিবাদে। প্রতিবাদ প্রতিরোধে রূপ নিয়েছে নেতৃত্বের গুণে। পৌরাণিকই বলি বা প্রাচীন যুগের কথাই বলি কিংবা আধুনিক কাল; যুগে যুগে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে , জাতি-সমাজ-মানুষ কেবল তার নেতাকে খুঁজেছে নিজেদের ক্রান্তিকালে। সক্রেটিস খ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় পাঁচ শ বছর আগে এথেন্সের শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি তরুণদের বিপথগামী করেছেন এমন অভিযোগ এনে এই মহান দার্শনিককে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আমি শুনেছি সে গল্প যে গল্পে আফ্রিকার জনগণের জন্য ম্যান্ডেলা অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ২৭ বছর জেলে কাটিয়েছেন একটি বর্ণ-বৈষম্যহীন জাতি গঠনের তাগিদে। বর্ণবাদ নিপাতের চেষ্টায় শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন বারবার। বর্ণবাদের অবসান ঘটানোর ব্রত নিয়েছিলেন, প্রত্যয়ী ছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত; ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতীক। কৃষ্ণাঙ্গদের কিংবদন্তি মার্টিন লুথার কিং লড়েছেন আমেরিকায় কালোদের মুক্তির জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু রাজ্যে বাসের সামনের আসনগুলোতে কালোদের বসার অধিকার ছিল না। মার্টিন লুথার কিং লড়েছেন সে সমতার জন্য বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। কালো আর সাদাকে পাশাপাশি সমান দেখতে চেয়েছেন তিনি। পৃথিবীর জনমানুষের সংগ্রাম, বিপ্লব আর ইতিহাসের আরেক নাম আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। সম্পূর্ণ দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন কেবল মানুষের দুর্দশা, আর শ্রেণিবৈষম্যের সাক্ষী হতে; মানুষের মুক্তির নেশায়, সমাজ পরিবর্তনের আশায়।
সব মহাদেশ ঘুরে আমার মন যখন এই বাংলায় পা রাখে তখন আমি দেখি আমার নেতা, বাঙালির বাতিঘর বঙ্গবন্ধুকে। বাঙালিও পেয়েছে এমন এক নেতৃত্ব, যিনি গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, মানবতা শিখিয়েছেন বাঙালিকে, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এই বাংলায়। জনগণের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছেন জাতি গঠনের নিমিত্তে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শোষণ মুক্তির পথ দেখিয়েছেন বাঙালি জাতিকে। মানবতার মূর্ত প্রতীক তিনি; একাত্তরে বাঙালি জনগণের সমস্ত শক্তির উৎস তিনি। যাঁর সাত মার্চের ভাষণ ছিল পাকিস্তানের শাসন বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক প্রতিজ্ঞা।
আমার বিদেশজীবনে আমি যেমন বারবার ছুটে গিয়েছি পৌরাণিক বীর ব্রাবোর কাছে, আমার এই দেশজীবনেও আমি বারবার পৌঁছাই আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে। এ নগরে, নগরজীবনের ক্লান্তি যখন আমায় ছেয়ে ধরে, বিমর্ষ করে যখন, আমি ঘর থেকে বেরোই। মাত্র ছয়-সাত মিনিট হাঁটি আমার নেতার কাছে পৌঁছাতে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। একদিকে জাতির জনকের বাড়ি অন্যদিকে ধানমন্ডি লেক, বহু রক্তের সাক্ষী। বাড়ির উল্টো দিকে রাস্তার ধারে একটি রিসেপশন, পাশে বঙ্গবন্ধুর প্রকাণ্ড ছবি। বাঙালির মূর্ত প্রতীক দাঁড়িয়ে এখানে। ছবিতে তিনি দীর্ঘদেহী।
বাড়ির সম্মুখের পিচঢালা রাস্তা দিয়ে কেবল মানুষ হেঁটে যেতে পারে, কোনো যানবাহন নয়। না, মানুষ তো হেঁটে চলে যায় না। মানুষ প্রথমে দাঁড়ায়। নত হয় এই বীরের আঙিনায়। জাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন যিনি। ঐতিহাসিক নথি বলে, ১৯৬১ সাল থেকে এটি বাঙালির বাতিঘর। বাষট্টির আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের চিন্তা তো তিনি এ ঘরে বসেই করেছেন কিংবা ছেষট্টির ছয় দফার সূত্র প্রণয়ন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচন কিংবা একাত্তরের অসহযোগের বৈঠকের সাক্ষী তো এই বাড়ি। আনিসুল হক যার নাম দিয়েছেন ‘মেঘমহল’। এই রাস্তা আর এই হ্রদের বহমান জলধারা পরাধীন বাংলাদেশে বিশ্বনেতার শেষ রাত ২৫ মার্চের সার্বক্ষণিক সাক্ষী।
তিনতলা বাড়িটি এখন জাদুঘর। ইতিহাসের স্পর্শ পেতে এ রাজনৈতিক বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে। হাতের মোবাইল আর ক্যামেরা ফটকে জমা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। প্রবেশমুখে নিচতলার মেঝে সাদা-কালোয় গড়া দাবার বোর্ডের মতো দেখায়। নিচতলার ঘরের দেয়ালগুলোয় অনেক ছবি ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের ভয়াল রাতের তাণ্ডব দেখতে গেলে ভবনের দোতলায় উঠতে হবে। সিঁড়িতে স্বচ্ছ কাচে বাঁধানো সেদিনের রক্তের দাগ এখনো কথা বলে। কবি রফিক আজাদ তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘এ সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে’। সিঁড়ির প্রান্তে আছে বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধু আর্তনাদ করছেন, ডান হাত দিয়ে নিজে বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরেছেন, ছবিতে। কী নিষ্ঠুর,কী নির্মম, কী নির্দয়তার চিত্র!
আমার প্রবাসজীবনের বীর বন্ধু ব্রাবো অপশক্তিকে হত্যা করে অমর হয়েছেন। আমার দেশজীবনের বন্ধু বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন অপশক্তির হাতে। ঘরের পরতে পরতে কেবল হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কচিহ্ন। এটি সেই বাড়ি যে বাড়িতে দেশের সব শ্রেণির মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার ছিল। কারণ, এটি শেখ মুজিবের বাড়ি। বাঙালির সংগ্রামের প্রধান দপ্তর। আমার বাতিস্তম্ভ। এই বঙ্গবন্ধুই তো আমার প্রবাসজীবনের ব্রাবো। আমি হেঁটেছি ব্রাবো থেকে বঙ্গবন্ধু। আমার দুই জাতিস্মর; যাঁরা যুগে যুগে বারে বারে আসেন, বিরাজ করেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আমার কানে বাজে আনিসুল হকের কবিতাখানি:
‘আকাশের ওপারে আকাশ, তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—৩২ নম্বর মেঘমহল।’