অনেক দিন কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। হয় না যাওয়া, খুব দরকার না হলে, বা বেড়াতে না যেতে চাইলে। পথের কথা আগেও লিখেছি। পথ যে ভালো নয়। তবে সেদিন হঠাৎ মনে হলো, বাংলা একাডেমিতে গেলে হয়: হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে দেখা নেই অনেক দিন। কাছাকাছি বয়সের একমাত্র সিরাজীর সঙ্গেই আমার তুমি-সম্পর্ক। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই, যতদূর মনে পড়ে। ফোনটোন না করেই আমি ও রাকা রওনা হয়ে গেলাম। গিয়েই সিরাজীকে পেয়ে গেলাম। সামনে বসেছিলেন যিনি, তিনিও চেনা: ইকতিয়ার মোমিন চৌধুরী। কিছু কথাবার্তা হলো। নানা বিষয়ে সিরাজীর সঙ্গে কথাবার্তা হলো। অনেক আপন লাগল। পিয়াস মজিদের সঙ্গেও দেখা হলো। ভালো লাগল। সরকার আমিন-এর সঙ্গে দেখা হলো। খুব হাসিখুশি। সদা হাসিখুশি।
দুই.
মাঝখানে, এই তো সেদিন, বরিশাল যাওয়া হলো হঠাৎ। বরিশাল যাওয়া হয়েছিল, আর লেখা ও পড়ায় ছেদ পড়েছিল। বেশ অনেক দিন পরে কোথাও যাওয়া। বন্ধু, অধ্যাপক-লেখক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস ও পারভীন ইলিয়াসের উৎসাহে এবং আমার স্ত্রী রাকার প্রণোদনায় এই ভ্রমণে আমারও যোগ দেওয়া। আজ বেশ কিছুদিন ধরে এমন সব ভ্রমণে আমার তেমন আগ্রহ হচ্ছিল না। কোথাও যাওয়া মানেই, নিজেদের দেশে বিশেষত, নানান ঝামেলায় পড়া। বলা হলো, সাংবাদিক আবদুর রহমানের বাড়ি বরিশালে, তাঁরই উৎসাহে এই সফরের আয়োজন। সব ধরনের ব্যবস্থাপনায় তাঁর অংশগ্রহণ থাকবে। অতএব, এ ভ্রমণে আমার দ্বিধান্বিত হওয়ার কোনো অবকাশ থাকল না। বরিশালে যাওয়া মানেই জাহাজের ব্যাপারস্যাপার, আর আমার বালকবয়সে জাহাজঘটিত দীর্ঘ পথযাত্রার চমৎকার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে চাটগাঁ থেকে সমুদ্রপথে করাচি যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা কোনোদিন ভুলব না। ‘অ্যারোন্ডা’ ছিল জাহাজটির নাম, আমাদের কেবিনগুলো ছিল আরামদায়ক, আর একজন গোয়ানিজ বাটলার ছিলেন দারুণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, হাসিখুশি। খাবার সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। অবসর পেলেই আমাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প করতেন। যতদূর মনে পড়ে, ৯ দিনের ছিল সমুদ্রযাত্রাটি, ৪–৫ দিনে ভিড়েছিল সিলোন তথা শ্রীলঙ্কা বন্দরে, ১০-১২ ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে রওনা হয়েছিল করাচির উদ্দেশে। কেন করাচিযাত্রা, সে বিষয়ে দুটি লাইন: বাবা বদলি হয়েছিলেন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে থেকে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে। বছর চারেক সেখানে কাটিয়ে ফিরেছিলেন ফের চাটগাঁয়, পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়েতে।
যা হোক, আমাদের বরিশালগামী লঞ্চটিও একটু বড়সড়ই, জাহাজ বলা যায় কি, ছোটখাটো একটি জাহাজ বলতেই ভালো লাগছে। যথাসময় তথা ভোর ৬টায় জাহাজের যাত্রা শুরু হলো। ৬ ঘণ্টার ভ্রমণ। কখনো ডেকে বসে, কখনো ভেতরে চেয়ারে বসে গল্প করতে করতেই আমরা এই সময় কাটিয়ে দিলাম।
যথাসময়ে বরিশাল বন্দরে পৌঁছালাম। কেমন সে বন্দর? যথারীতি অপরিচ্ছন্ন। অব্যবহৃত, নষ্ট সরঞ্জামাদি চারপাশে। মনে হয় না এসব জঞ্জাল কোনোদিন এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হবে। এমনটা দেখলে মন খারাপ হয় তো।
জাহাজ থেকে নেমে কাছেরই একটি রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়ে আমরা গেলাম আগে থেকে ঠিক করা বিআইডব্লিউটিএ গেস্ট হাউসে। দিন দুই ঘুরে ঘুরে কাটালাম বরিশাল শহরে। শহরের সবচেয়ে বড় দিঘিটির পাশে এক বিকেলে অনেক সময় কাটালাম। অনেক ছবি তোলা হচ্ছিল। তারপর কুয়াকাটার উদ্দেশে হবে আমাদের দীর্ঘ যাত্রা। ছবি তুলছিলাম আর মনজুড়ে ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কোথায় পাব তাঁরে? কেউ একজন দেখিয়ে দিলেন জীবনানন্দের সম্ভাব্য বাসগৃহের জায়গাটি। বোঝা যাচ্ছিল না তেমন। শুধু জায়গা দেখে, আশপাশ দেখে জীবনানন্দকে মনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছিল। বিএম কলেজটিও ঘুরেফিরে দেখছিলাম, আর তাঁর কবিতার কিছু পঙ্ক্তি আসছিল মনে। জীবনানন্দ দাশ একসময় এ শহরের পথ দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন ভাবতেও কেমন যে স্বপ্নাচ্ছন্ন লাগে, সত্যি!
বেশ অনেক সময় লাগল কুয়াকাটা পৌঁছাতে, রাস্তাও তেমন ভালো নয়। বস্তুত স্থলপথে যত ভ্রমণ হয়েছে আমার এ অঞ্চলে, পথ হয়েছে পীড়াদায়ক, উঁচুনিচু ও ভাঙা রাস্তার কারণে। বাস বা মাইক্রোবাসের মাঝখানে বসার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও।
কুয়াকাটা পৌঁছানোর পর সমুদ্র দেখে মন ভালো হয়ে গেল। না, সৈকত এখানে কক্সবাজারের সৈকতের ধারেকাছেও নয়। ফৌজদারহাট সমুদ্র সৈকতে যাওয়া হয়েছিল অনেক আগে, কুয়াকাটা সৈকতের চেয়ে পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছিল। এ সৈকত লোকে-লোকারণ্য, বিশেষত বিকেলে-সন্ধ্যায়, অধিকাংশ যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে কাউকে ভ্রমণার্থী মনে হলে (বা না হলেও) ভ্রমণে যেতে আগ্রহী কি না বারবার জিজ্ঞেস করছে। প্রথমটায় একটু বিরক্ত হলেও পরে বুঝেছি, এমনটাই স্বাভাবিক, মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে কাউকে সৈকতে বেড়াতে নিয়ে গেলে এদের যেমন কিছু উপার্জন হয়, অল্প অর্থের বিনিময়ে আগ্রহী অনেকে ঘুরে বেড়াবার শখও মিটিয়ে নিতে পারেন।
কুয়াকাটার মজার অভিজ্ঞতাটি ছিল, রোজ সন্ধ্যাবেলা সদ্য সদ্য সমুদ্র থেকে তুলে আনা মাছ রান্না হয় যে জায়গাটিতে, সেখানে পাতা টেবিল-বেঞ্চে বসে গরম রুটি বা ভাত দিয়ে সে মাছ খেতে পাওয়া।
রাখাইন পল্লি দেখতে যাওয়ার খুব শখ হয়েছিল, হলো না যাওয়া, শুধু পথের দুরবস্থার কারণে।
মোটের ওপর অপ্রীতিকর কথাটি তো এই যে কুয়াকাটার পথঘাট ভালো নয়, ভালো নয় পথঘাট। উঁচুনিচু, ভাঙাচোরা। আমাদের একজন সহযাত্রী, কুয়াকাটায় যার ঘুরে বেড়াবার খুব শখ ছিল, যাওয়ার ছিল নানা জায়গায়, খানিকটা পথ সাহস করে গিয়েও তাকে আহত হয়ে ফিরতে হয়েছে, হোটেলে ফিরে ব্যথার ওষুধ খেতে হয়েছে।
এত চমৎকার একটি জায়গা ভ্রমণের, অথচ অবহেলায় পড়ে আছে ভাবলে মন খারাপ হয় তো।