কক্সবাজার যেবার টাঙ্গুয়ার হাওরের বিকল্প হলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী গত বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে না গিয়ে অনেকটা খেয়ালের বশেই একাকী চলে গেলেন কক্সবাজার। এরপর কেমন ছিল সেই ভ্রমণ? এক নারীর কক্সবাজার ভ্রমণের আখ্যান।

গত বছরের ঘটনা। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরতে তখন দুই দিন মাত্র বাকি। ফেরার মুখে কোথাও একটু ঘুরে আসা আমার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াল। এক সপ্তাহ আগে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাওয়া বাতিল হওয়ায় আমার তখন মন ভীষণ খারাপ। আমাদের যাওয়ার কথা ছিল ভরা বর্ষায়, ভরা পূর্ণিমায়। কখনো হাওর না দেখেও নৌকায় রাতে হাওরে জ্যোৎস্না কেমন হতে পারে কল্পনা করে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। যাত্রার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি জানতাম যে হাওরে যাওয়া হচ্ছে। কারণ, আমি বলেই দিয়েছিলাম, কম মানুষ হলেও অসুবিধা নেই। যদি কেউ না যায়, আমি একাই যাব! এত সদিচ্ছার পরও যাওয়া বাতিল হতে পারে, এটা আমার কল্পনায়ও ছিল না। আমার সঙ্গে যে দুজনের যাওয়ার কথা ছিল, তারা সকাল থেকেই জানে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাকে এটা জানাতে জানাতে ওদের সন্ধ্যা নেমে যায় যে দুজন মেয়ে নিয়ে একজন ছেলে একা অত দূর হাওরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। খুবই যুক্তিসংগত কারণ, কিন্তু আমি কোনোভাবেই মানতে পারলাম না। এক সপ্তাহ ধরে আমি অনেক ভাবলাম যে একাই চলে যাব কি না। তারপর একেবারেই অপরিচিত জায়গা বলে টাঙ্গুয়ার হাওর বাদ দিলাম।

তবে কোথাও ঘুরে আসতে হবে কিন্তু থাকা যাবে না, এমন জায়গার কথা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত নিকলী হাওর আর কক্সবাজারে এসে ঠেকলাম আমি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এক সন্ধ্যা ধানমন্ডির রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলাম। তার পরদিন দুপুরবেলা টিটিপাড়া কাউন্টারে গেলাম কক্সবাজারের রাতের টিকিট কনফার্ম করব বলে।
রাত দশটা পনেরোতে বাস, আমি নয়টায় হল থেকে বের হলাম। পকেটে দুটো ছোট নোটবুক, কাঁধের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতিসহ ব্যাগ। আমি যখন হলের গেট দিয়ে বের হলাম, তখনই অঝোরে বৃষ্টি নামল। ভিজতে ভিজতে শাহবাগে গিয়ে বাসের অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়ে উবার ডাকলাম। বাস মিস করে ফেলার দুশ্চিন্তা নিয়ে যখন কাউন্টারে হাজির হলাম, তখনো বাস ছাড়তে আধঘণ্টা দেরি। ওই আধঘণ্টা আমি ভাবলাম সারা দিন কক্সবাজারে করবটা কী! ভেবে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট করে ফোন বন্ধ করলাম। চব্বিশ ঘণ্টা চার্জ দিতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই।

শেষ বিকেলে বাঁধের ওপর থেকে সমুদ্র এমনরূপেই হাজির হয়েছিল। ছবি: লেখক
শেষ বিকেলে বাঁধের ওপর থেকে সমুদ্র এমনরূপেই হাজির হয়েছিল। ছবি: লেখক

বাসে উঠে বুঝতে পারলাম ভেজা জামাকাপড় নিয়ে এসি বাসে উঠে কত বড় ভুল করেছি! সারা রাত শীতে কাঁপতে কাঁপতে যখন কক্সবাজারে পৌঁছলাম, তখন সেখানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বালুবেলায় ঢুকতেই আমি সমুদ্রের ওপর এমাথা-ওমাথা একটা বিশাল রংধনু দেখে ফেললাম। শীত, দুশ্চিন্তা, ক্ষুধা—সবকিছুই তখন অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। দুই ঘণ্টা লাবণী পয়েন্টে বসে থেকে আমি নাশতা করলাম। এর মধ্যে পাঁচ-ছয়জন আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কী বৃত্তান্ত। এই সমস্ত কপালে আছে জেনেই বেরিয়েছিলাম, কিন্তু বলা বাহুল্য, আমি খুবই বিরক্ত হলাম। ফলে কোথায় গেলে মানুষের থেকে বাঁচা যাবে, তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইনানী সমুদ্রসৈকতের দিকে রওনা হলাম আমি।
কিন্তু বাঁচতে চাইলেই বাঁচা যায়, ব্যাপারটা তা নয়। একে তো আমি দেখতে খানিকটা ছোট, তার ওপর ছেলে না মেয়ে, হঠাৎ দেখে বোঝা যায় না, এমন মানুষ আমি একা একা অত দূর চলে এসেছি, কাজেই বাঁচার চেষ্টা বৃথা। তবু নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টায় কোনো ক্ষান্তি দিলাম না। খুঁজতে খুঁজতে আমাকে বেশ কয়েকবার উত্তর দিতে হলো কীভাবে এত দূর এসেছি আমি। তবে ঢাকা থেকে বাসে উঠে সরাসরি চলে এসেছি, এত সংক্ষিপ্ত উত্তর কারোরই পছন্দ হলো না। কাজেই আমাকে উত্তর দিতে হলো আমার ভয় করেছে কি না, আমি জানি কি না আমার কী কী বিপদ হতে পারে, আমার মা-বাবা কি এই দুনিয়ায় আদৌ আছে, নাকি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ইনানী পৌঁছে আমি প্রথমে পড়লাম ফটোগ্রাফার এক পিচ্চি ছেলের পাল্লায়। সে আমার ছবি তুলবেই, আর আমি তুলবই না। তাকে কিছু টাকা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি তুলনামূলকভাবে নিরুপদ্রব জায়গায় গিয়ে ভাবতে লাগলাম, এই যে সমুদ্রে বৃষ্টি বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে ঘনত্ব হারায়, তাতে কি আসলে তার তীব্রতা বাড়ে না কমে? এটা কি সমুদ্রের শাসন, নাকি বৃষ্টি, বাতাস আর সমুদ্রের ঐকতান? সমুদ্রের কাছে গেলে অবশ্য তার বিশালতাকে সবকিছুর ধারকই মনে হয়, অধিপতি মনে হয় না! বুদ্ধের হৃদয় বের করে সেখান থেকে অনিত্য অনাত্ম নির্বাণ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করার বাসনায় আমি যখন ব্যস্ত, সে সময় তাতে বিঘ্ন ঘটাতে দুই ভ্রাতা-ভগ্নি এসে হাজির হয়ে গেল। আমি জানলাম, তাঁরা আমাকে আধঘণ্টা ধরে অনুসরণ করছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম কী জানতে চান তাঁরা? আমি বয়সে তাঁদের থেকে দু-তিন বছরের বড় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জানতে পেরে ছাতা ছাড়া অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে কথা বলে মিনিটখানেকের মধ্যেই তাঁরা চলে গেলেন। এরপর আমি উল্টো দিকে হাঁটা দিয়ে অনেকটা দূরে এসে বসলাম একটা গাছের গুঁড়িতে। এতক্ষণে আরাম করে হেলান দিয়ে বসা গেল। এক-দেড় ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে আমি জোয়ারের পানির গুঁড়ি পর্যন্ত উঠে আসা দেখলাম। দেড় ঘণ্টা পর হাজির হলো দশ-এগারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। বলল, কাছেই তাদের বাসা। আমাকে সেখানে গিয়ে গোসল করার আমন্ত্রণ জানাল সে। আমার মনে কিসের এত দুঃখ, সেটাও জানতে চাইল। আমি যখন তাকে বললাম আমার মনে আসলে আনন্দ বেশি এবং এত বেশি আনন্দ রাখার জায়গা হচ্ছিল না দেখে সমুদ্রে আসতে হয়েছে, তখন সে অবাক, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল হাঁ হয়ে। যতক্ষণ না তার বাবা তাকে ডাকতে এসে আমাকে উদ্ধার করলেন, ততক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমাকে তার সব গল্পই শুনতে হলো।

কিন্তু বাঁচতে চাইলেই বাঁচা যায়, ব্যাপারটা তা নয়। একে তো আমি দেখতে খানিকটা ছোট, তার ওপর ছেলে না মেয়ে, হঠাৎ দেখে বোঝা যায় না, এমন মানুষ আমি একা একা অত দূর চলে এসেছি, কাজেই বাঁচার চেষ্টা বৃথা। তবু নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টায় কোনো ক্ষান্তি দিলাম না। খুঁজতে খুঁজতে আমাকে বেশ কয়েকবার উত্তর দিতে হলো কীভাবে এত দূর এসেছি আমি। তবে ঢাকা থেকে বাসে উঠে সরাসরি চলে এসেছি, এত সংক্ষিপ্ত উত্তর কারোরই পছন্দ হলো না। কাজেই আমাকে উত্তর দিতে হলো আমার ভয় করেছে কি না, আমি জানি কি না আমার কী কী বিপদ হতে পারে, আমার মা-বাবা কি এই দুনিয়ায় আদৌ আছে, নাকি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।


মেয়েটা যাওয়ার পর পানি বাড়তে থাকায় আমি রাস্তায় উঠে একটা বাঁধ খুঁজে বের করে সেটার ওপর বসলাম। রাস্তার ওপাশে একটা ছোটখাটো গ্রাম। সেই গ্রামের বেশ কয়েকজন আমাকে নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিল। আমি নোটবুক বের করে নানা কিছু লেখার চেষ্টা করতে থাকলাম। এমন সময়ে মাঝবয়সী এক লোক এসে একটু দূরে বসলেন। বসে প্রথমেই জানালেন, আমার কোনো ভয় নেই; তাকে এখানে সবাই সমীহ করে। আমি তাকে জানালাম, আমি আসলে ভয় পাচ্ছি না। তারপর অবধারিতভাবে নানা প্রশ্নের উত্তরে সারা দিনের প্যাঁচালের পুনরাবৃত্তি করলাম। রাতের বাসে চলে যাব জানানোর পর তিনি আমাকে তার বাড়িতে থাকার নিমন্ত্রণ দিলেন! আমার কেন চুল ছোট, আমি কি মুসলিম না হিন্দু না বুড্ডিস্ট—এই সবের ‘হ্যাঁ’-‘না’ করে নানা উত্তর দেওয়ার পর তিনি নিরস্ত হয়ে চলে গেলেন। সেই সময়ই আমি খেয়াল করলাম, ভাটা পড়ে যাচ্ছে। পানি যত সরে যাচ্ছে, ততই সেখানে ছাগল, কুকুর, মানুষের বাচ্চার খেলাধুলা বাড়ছে। ‘সিন্ধুসারস’ আছে, জেলেরাও আছে। কারও সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ নেই। শহরের রাস্তায় বা গ্রামের বসতবাড়িতে কুকুর আর ছাগলকে মানুষের বাচ্চার চেয়ে আলাদা মনে হয়। কিন্তু যখন বিশাল সমুদ্রের ধারে ছোট ছোট কিছু প্রাণী খেলাধুলা করে বা নিজের খাদ্য সংস্থানের চেষ্টা করে, তখন তাদের বৈচিত্র্যের চেয়ে ঐক্যই চোখে পড়ে বেশি।

গুঁড়ি ছাপিয়ে পানি না আসা পর্যন্ত জায়গাটা বেশ আরামদায়ক ছিল। ছবি: লেখক
গুঁড়ি ছাপিয়ে পানি না আসা পর্যন্ত জায়গাটা বেশ আরামদায়ক ছিল। ছবি: লেখক

আমরা নাকি যখন আকাশ দেখি, তখন আসলে মেঘ দেখি, নীল রং দেখি, কিন্তু সত্যি যেটা থাকে সেখানে, বিশাল শূন্য, সেটাই নাকি আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। সেদিন সমুদ্রের পাড়ে বসে এই সত্যি আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। মনে হলো, সমুদ্র বোধ হয় আকাশের থেকেও উদার। কারণ, শুধু তার কাছেই আকাশকে স্বমহিমায় পাওয়া যায়! পরে একসময় আমার শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন আকাশের হিসাবে সমুদ্র কতখানি? আসলে কে বেশি উদার! এই প্রশ্নটা আমি রেখে দিয়েছি কিন্তু উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করিনি; কেননা, মানুষে মানুষে দেখার পার্থক্য অনেকখানি।
গোটা দিনের অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গেল ইনানী থেকে ফেরার সময়ে পথে দায়িত্বপ্রাপ্তদের চেকিং। সিএনজি থামিয়ে কে কোথা থেকে আসছে, জিজ্ঞেস করার পর যখন তারা জানল আমি সিএনজির বাকি লোকদের সঙ্গের কেউ নই এবং আজই এসেছি, আজই ফিরে যাব, সে সময় আমার ব্যাগসহ আমাকে বেশ কড়া অর্ডারে নামানো হেলা। প্রথমেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রটি দেখালাম। ভেবেছিলাম তাতে বেঁচে যাব, কিন্তু এমনভাবে আমাকে চেক করা হলো যে আমি কিছুটা অপমানিত বোধ করতে শুরু করলাম। আমি মাদক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত কি না, এই প্রশ্নে আমি মোটামুটি স্থৈর্য হারিয়ে ফেললাম। চেকিং থেকে বের হয়ে সিএনজিতে ওঠার সময় আমাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো কেন এখানে এসেছি। সঙ্গে বিনা মূল্যে উপদেশও দেওয়া হলো, এভাবে যেন আর না আসি। আমি তাঁদের বললাম, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। একুশ বছর বয়স আমার, কেন আমি আসতে পারব না? তাঁরা কোনো জবাব দিলেন না। আমার স্পষ্টত মনে হলো, তাঁরা রেগে গেছেন।
এই বছর জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণ ঘটনার কিছুদিন পর আমার বান্ধবীরা যখন রাতের বাসে ভাটিয়ারি ঘুরতে বের হলো, সে সময় একজন পুলিশ সদস্য সরাসরি সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে ওদের বলেছিল, ও রকম কিছু ঘটলে ওরা কী করবে! আমার বন্ধু তখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমাদের রক্ষার দায়িত্ব কার?’ ওই ভদ্রলোকও কোনো উত্তর দেননি। এসব নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার এমন উপলব্ধি হয়েছে যে নিরাপত্তা দিয়ে স্বাধীন হওয়ার পথ প্রশস্ত করার ঝুঁকি নেওয়ার থেকে পরাধীন করে রাখা সহজ অবশ্যই; সুবিধাজনকও।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]