২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যে গ্রাম ভাসে রোদের ঢেউয়ে!

ইতালির তাস্কানি প্রদেশের ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম কর্টোনা। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম রোদের ঢেউয়ে কেন ভাসে? কেন সাদাসিধে বাঙালি কন্যা নিতান্তই ঝোঁকের বশে ইতালির এই গ্রামে গিয়ে হাজির হন?

‘আন্ডার দ্য তাস্কান সান’ সিনেমার দৃশ্যে অভিনেত্রী ডায়ানা লেন। ইতালির তাস্কানি প্রদেশের ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম কর্টোনার গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল ছবিটিছবি: সংগৃহীত

ভিনদেশি এক গ্রামে ভর দুপুরবেলায় হঠাৎ আমার মনে হলো, মার্কেজ বোধ হয় সত্যি। না... মানে...বলছি যে মার্কেজের অন্তত একটা ছোটগল্পকে আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখলাম। সেই গল্পের কথা বলছি, যে গল্পে দুই ভাই আলো দিয়ে পুরো ঘর ভর্তি করে ফেলল। এরপর আলোর ঢেউয়ে তারা নৌকা বাইছে। এদিকে শহরজুড়ে জলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে উদ্ভাসিত ঢেউ। যে গ্রামের কথা বলছিলাম, সেখানে রোদ এমন জলের মতো। মনে হয় রোদকে কেউ জলরং বানিয়ে ছবি এঁকেছে। রোদের তীব্রতা নেই, তবে ঝকঝকে আলোর খেলা আছে। সেই আলোয় ভাসছে ঘড়িসমেত গির্জার চূড়া, ঝুড়িভর্তি কমলালেবু আর পাথুরে চত্বরে বসে থাকা বাদামি বুড়োর নীলচে টুপি। অথচ মার্কেজের মতো জগদ্বিখ্যাত লেখককে স্মরণ বা অনুভব করতে আমি সে গ্রামে যাইনি। বরং আধা বিখ্যাত এক লেখকের আধা বিখ্যাত এক উপন্যাস আর আধা বিখ্যাত এক নির্মাতার আধা বিখ্যাত এক সিনেমার পথ অনুসরণ করতেই সেখানে যাওয়া। গ্রামটির নাম কর্টোনা। ইতালির তাস্কানি প্রদেশের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম।

যে আধা বিখ্যাত লেখকের কথা বলছিলাম, তাঁর নাম ফ্রান্সিস মায়েস। যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াতেন, নিয়মিত ব্যাকপ্যাক বেঁধে বেড়িয়ে পড়তেন ভ্রমণে। সঙ্গে চলত কবিতা আর ভ্রমণকাহিনি লেখা। তেমনই একটি ভ্রমণকাহিনি ‘আন্ডার দ্য তাস্কান সান’ ১৯৯৬ সালে চলে এল ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর বেস্ট সেলার লিস্টে। সে সম্পর্কে মায়েস নিজেই বলেন, ‘বিখ্যাত লেখক হব বলে তো কখনো লিখিনি। তবে এই বইয়ের কল্যাণে অন্তত দুটো বছর খ্যাতির অম্লমধুর স্বাদ পেয়েছিলাম।’ আদতে অবশ্য মাত্র দুই বছরমেয়াদী খ্যাতিতেই মায়েস থেমে থাকেননি। ২০০৩ সালে বইটি অবলম্বনে সিনেমা বানান অড্রি ওয়েলস। সিনেমাটি যে খুব দারুণ বিখ্যাত হলো, তা কিন্তু নয়। তবে এর খ্যাতির ধরনটা হলো খানিকটা অন্য রকম। ‘ভ্যানিটি’ ম্যাগাজিনের ভাষায়, ‘অল্প কিছু মানুষেরই হয়তো সিনেমাটি ভালো লেগেছে। তবে যাঁদের ভালো লেগেছে, তাঁদের বেশির ভাগই সিনেমাটিকে ভালোবেসে ফেলেছেন।’

কর্টোনা: যে গ্রাম ভাসে রোদের ঢেউয়ে
ছবি: লেখক

ভালোবাসার কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়। নইলে এই যে আমি, সাদাসিধে বাঙালি কন্যা, নিতান্তই ঝোঁকের বশে ইতালির এক দূর গ্রামে গিয়ে হাজির হব কেন? এই ‘কেন’র গল্পটা জানতে হলে অবশ্য ফিরতে হবে অন্তত পনেরো বছর পেছনে। আমি তখন ভরদুপুরে ইতালিয়ান গ্রামে জলের মতো রোদ দেখি না। বরং দুপুরের খাওয়া শেষে লক্ষ্মী (!) মেয়ের মতো জিজ্ঞেস করি, আম্মা, একটু টিভি দেখে তারপর ঘুমাই? সে রকম দুপুরবেলায়ই তাস্কান সানের সঙ্গে আমার পরিচয়। সিনেমাটা দেখে মনে হলো, এমনটা আমি আগে কখনো দেখিনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, বড় হয়ে এমন একা একা কর্টোনায় যাব। সঙ্গে থাকবে বাদামিরঙা ব্যাগ, ব্যাগে থাকবে সূর্যমুখী আঁকা পোস্টকার্ড। গ্রামের ঠিক মধ্যবর্তী যে চত্বরে বসে নায়িকা (ডায়ানা লেন) পোস্টকার্ড লিখলেন, সেখানে বসে আমিও কাউকে কিছু লিখেই ফেলব। তখন বয়স বড্ড কম, সিনেমার মূল শক্তিটা আমার চোখে পড়ল না। দেশি রক্ষণশীল সমাজে বড় হওয়া যেকোনো কিশোরীর মতো আমারও সব ভালো লাগা কেন্দ্রীভূত হলো একা ভ্রমণের অ্যাডভেঞ্চারে। এরপর বহুবার সিনেমাটি দেখেছি। কখনো মনে হয়েছে, পরিচালক আর দশটা হলিউডি সিনেমার মতো একা নারীর ভ্রমণকে ‘প্রেম সন্ধানী ভ্রমণ’-এ পরিণত করেননি বলেই সিনেমাটিকে আমি ভালোবাসি। কখনো মনে হয়েছে, অভিনেত্রী ডায়ানা লেনই পুরো সিনেমাটির প্রাণ।

এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতেই পেরেছেন যে ‘আন্ডার দ্য তাস্কান সান’ নারীর একক যাত্রার গল্প। অন্তত সিনেমায় তা–ই ছিল। সেখানে মূল চরিত্র সোনালি চুলের ফ্রান্সিস। সংসারের পাট চুকিয়ে, ভাঙা হৃদয় নিয়ে তিনি আমেরিকা থেকে ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছেন। কদিন ঘুরেফিরে ভাঙা হৃদয়ের পরিচর্যা করাই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু কী এক মায়ায় পড়ে, একদিন ভরদুপুরে কর্টোনা গ্রামে তিনি একটা আস্ত বাড়ি কিনে ফেলেন। পুরোনো, ভাঙা একটা বাড়ি। বাড়ির নাম ‘ব্রামাসোল’। সেই বাড়িকে আপন করে নেওয়ার গল্প নিয়েই সিনেমা। বইয়ের গল্পও বাড়িটিকে ঘিরে। তবে বইটি ছিল আত্মজীবনীমূলক। তাই সেখানে লেখিকা ফ্রান্সিস লিখেছিলেন তাঁর সঙ্গী এডওয়ার্ডের সঙ্গে ‘ব্রামাসোল’-এ ঘর বাঁধার গল্প। সিনেমা ও গল্পের অমিল আছে অনেক, তবে মিলেরও কমতি নেই। দুটোতেই প্রেম আছে, মায়া আছে, অভিমানে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জলের কথা আছে। বইয়ের ফ্রান্সিস যেমন বুনো লেবুপাতার ঘ্রাণ পেয়ে আচ্ছন্ন হয়, সিনেমার ফ্রান্সিসও তেমনি কুড়িয়ে পাওয়া জলপাই বড় ভালোবেসে ঘরে আনে। মোট কথা, দুটো গল্পই সংবেদনশীল নারীর গল্প। সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে এসে তারা দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে, জীবনকে ভালোবাসছে।

পনেরো বছর আগে যখন সিনেমা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তখনো বইয়ের সন্ধান পাইনি। বই খুঁজে পেলাম এই যে কয়েক মাস আগে বেলজিয়ামের এক পুরোনো বইয়ের দোকানে। স্তূপ করে রাখা ধুলায় জর্জরিত বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে যেদিন বইটি পেলাম, ইতালির টিকিট কাটলাম ঠিক তার পরদিন দুপুরবেলায়। ততক্ষণে বইয়ের অর্ধেক অংশ পড়ে ফেলেছি। বুনো লেবুপাতা আর জলপাইবাগানের ঘ্রাণ যে এখনই নিতে হবে, সে সম্পর্কে আমার আর কোনো দ্বিধাই রইল না। কর্টোনায় যাওয়ার পথ অবশ্য খানিকটা সময়সাপেক্ষ। অর্থকড়ির হিসাবটিসাব করে আমস্টারডাম থেকে প্রথমে গেলাম ইতালির পিসা শহরে। সেখান থেকে পরদিন সকালবেলায় তিন ঘণ্টার ট্রেন। ট্রেন থামল ‘কামুসিয়া কর্টোনা’ নামের ছোট্ট এক ট্রানজিট স্টেশনে। সেই স্টেশন থেকে বাসে চেপে কর্টোনা গ্রামে পৌঁছাতে হবে বলেই জানতাম। কিন্তু চারপাশে কোনো বাস বা বাসস্টপ কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। তবে ছোট স্টেশনের ততোধিক ছোট ক্যাফে ঠিকই খুঁজে পেয়েছি। সেখান থেকে সদ্য বেক করা করনেটোর ঘ্রাণ আসছে। ফরাসি ক্রসাঁর ইতালিয়ান রূপ হলো ‘করনেটো’। মূল পার্থক্য নাকি মিষ্টির মাত্রায়। আমার অবশ্য ধারণা, করনেটো আদতে স্বর্গীয় খাবার, পথ ভুলে ইতালিতে চলে এসেছে। যা হোক, স্টেশনের ক্যাফে থেকে স্বর্গীয় করনেটো আর বাসের সন্ধান দুটোই পাওয়া গেল। তবে মিনিট বিশেক পর বাস যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, আমি নিতান্তই বুরবাকের মতো প্রশ্ন করলাম, ইয়ে মানে, এটা কি বাস?

পাথুরে রাস্তা ধরে আবার হাঁটতে শুরু করি। হাতে বানানো সাবানের দোকান পেরোই। নাকে এসে লাগে বুনো লেবুপাতার ঘ্রাণ। দোকানের মালিক সিয়েনাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি পুরো দোকান ঘুরিয়ে দেখায়। শুকনা লেবুপাতা, জলপাইপাতা আর ল্যাভেন্ডারের গুঁড়া সেখানে থরে থরে সাজানো। প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম, কোনো জাদুঘর দেখব না, সাজানো গ্যালারিতে ঢুকব না। হাঁটব, গ্রাম দেখব, মানুষের সঙ্গে কথা বলব, পেট ভরে করনেটো আর পাস্তা খাব। সারা দুপুর সেসবই হলো। একটু হাঁটছি, একটু বুড়ো আন্দ্রিয়ার দোকানে জিলাটো খাচ্ছি আর বিকেল হতেই হেঁটে হেঁটে আমি ঠিক ব্রামাসোলের সামনে।

আমার বোধ হয় জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, এই বাস কর্টোনা গ্রামে যায় কি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নাম ‘বাস’ হলেও, আদতে সেটি একটি ঝা–চকচকে ট্রেলার ভ্যান। আমি আজীবন দেখে এসেছি, পাহাড়ি গ্রাম মানে অবহেলিত জনপদ আর দুর্গম রাস্তা। তাই বোধ হয় প্রথমবার পাহাড়ি গ্রামের অধিবাসীদের জন্য সরকার এমন আধুনিক ট্রেলার ভ্যানের ব্যবস্থা করেছে দেখে আমি চমকে যাই। তাও আবার বিনা পয়সার ভ্যান! পাহাড়ের অলিতে-গলিতে নানা স্টপেজে থামতে থামতে এগোয় আমাদের ভ্যান। ‘আমাদের’ বলছি, কেননা ততক্ষণে নানা বয়সী মানুষে ভর্তি হয়ে গিয়েছে পুরো ভ্যান। সামনের সিটে দুজন আমেরিকান ট্যুরিস্ট, তাঁরাও আমার মতো সিনেমা দেখেই এ তল্লাটে এসেছেন। পেছনে বসেছেন ঝুড়িভর্তি কমলালেবুসমেত এক বৃদ্ধা। পাশেই সাদা-নীল গাউন পরা দুজন নান, চট করে দেখলে হঠাৎ হলিক্রস আর সিস্টার পলিনকে মনে পড়ে। তার পাশে দুজন মাঝবয়সী লোক, তাঁদের পরনে লেদার জ্যাকেট, চোখে কালো সানগ্লাস। আজীবন হলিউডি সিনেমায় এরা স্টেরিওটাইপড গ্যাংস্টার, আর এখানে বৃদ্ধ সহযাত্রীকে কমলালেবুর ঝুড়ি নামাতে সাহায্য করা সাধারণ গ্রামবাসী।

স্টেশনের ক্যাফে থেকে স্বর্গীয় করনেটো আর বাসের সন্ধান—দুটোই পাওয়া গেল
ছবি: লেখক

আধঘণ্টার যাত্রা শেষে কর্টোনায় পৌঁছলাম। যেখানে বাস থেমেছে, তার পুরোটা রেলিংঘেরা এক চত্বর। নিচে তাকালে তাস্কানি সবুজ, পাহাড়ি রাস্তা, লাল টালির ছাদ দেওয়া ঘর। প্রথমে খানিকক্ষণ বিশ্বাস হয় না, যা দেখছি তার পুরোটা আসলে সত্যি ও বাস্তব। স্বপ্ন নয়, সিনেমা নয়, ল্যাপটপের ডিফল্ট স্ক্রিনসেভারও নয়। সত্যিই তাস্কানি সূর্যের নিচে ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত বিস্তৃত বুনো সবুজ। আন্ডার দ্য তাস্কান সান! ফ্রান্সিসের লেখা বই–ই আমার গাইড। তাঁর কথামতো ‘ভিয়া নাজিয়োনালে’র রাস্তা ধরে এগোলাম। ঝিমধরা দুপুরে এক পাহাড়ি গলি, তার দুপাশে ছড়ানো কিছু দোকান। কোনোটায় বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় শিল্পীর আঁকা ছবি, কোনোটায় হাতে বোনা টুপি। কোনো কোনো দোকানের শাটার অর্ধেক নামানো, সামনে বসে রোদ পোহাচ্ছেন দু–চারজন বৃদ্ধ। দূর থেকে ভেসে আসে রেডিওর শব্দ। ঠিক আগের রাতেই অনেকগুলো অস্কার জিতেছে ‘এভরিথিং এভরিহয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স’। রেডিওর খবরে এই সিনেমার নামটা অন্তত ইংরেজিতে বলে, তাই বুঝতে পারি, অস্কারের খবরই শুনছেন কেউ কেউ। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের মূল চত্বরে এসে দাঁড়াই। ‘পিয়াজ্জা দ্যেল রিপাবলিকা’—ঠিক এই নামই বইতে ছিল। এখানে বসেই ফ্রান্সিসের সঙ্গী ভাবতেন, পরজন্মে তিনি ইতালিয়ান শিশু হয়ে জন্মাতে চান। চত্বরটি সিনেমায়ও ছিল। প্রথমবার ডায়ানা লেন বাস থেকে নেমেই এই চত্বরে দাঁড়ালেন। অমনি ভীষণ সিনেম্যাটিক ভঙ্গিতে ঢং ঢং করে বেজে উঠল গির্জার ঘণ্টা। ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা। আমি গির্জার সিঁড়িতে বসি। তখনই আমার রোদকে মনে হয় জলের মতো স্বচ্ছ আর উজ্জ্বল। একটা ছবি তুলে ইনস্টাগ্রামে লিখলাম, ‘ফলোয়িং দ্য পাথ অব ফ্রান্সিস মায়েস’। আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন মায়েস। লিখলেন, ‘কর্টোনা তোমাকেও ভালোবাসুক।’

পাথুরে রাস্তা ধরে আবার হাঁটতে শুরু করি। হাতে বানানো সাবানের দোকান পেরোই। নাকে এসে লাগে বুনো লেবুপাতার ঘ্রাণ। দোকানের মালিক সিয়েনাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি পুরো দোকান ঘুরিয়ে দেখান। শুকনা লেবুপাতা, জলপাইপাতা আর ল্যাভেন্ডারের গুঁড়া সেখানে থরে থরে সাজানো। প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম, কোনো জাদুঘর দেখব না, সাজানো গ্যালারিতে ঢুকব না। হাঁটব, গ্রাম দেখব, মানুষের সঙ্গে কথা বলব, পেট ভরে করনেটো আর পাস্তা খাব। সারা দুপুর সেসবই হলো। একটু হাঁটছি, একটু বুড়ো আন্দ্রিয়ার দোকানে জিলাটো খাচ্ছি আর বিকেল হতেই হেঁটে হেঁটে আমি ঠিক ব্রামাসোলের সামনে। এই ব্রামাসোল ফ্রান্সিস মায়েসের নিজের বাড়ি, তাঁর গ্রীষ্মকালীন আবাস। ফিকে কমলা রঙের দোতলা বাড়ি, তার উজ্জ্বল সবুজ জানালা, দেয়াল বেয়ে উঠেছে বুনো লতা। আর বুনো লতার ওপর জমে আছে বিকেলের সোনাঝুরি রোদ। ভ্রমই হবে হয়তো, কিন্তু রোদটুকু দেখতে দেখতে আমি বোধ হয় খানিকটা হলেও বুঝতে পারি, কোনো কোনো জায়গা, কোনো কোনো মুহূর্ত কীভাবে গল্পের জোগান দেয়। এ বাড়িতে পর্যটকের প্রবেশাধিকার নেই। তাই সামনে থেকে খানিকটা দেখেই ফেরার পথ ধরি।

ফেরার পথে পাওয়া গেল সান্তা মার্গারিটার চত্বর। বইতে ফ্রান্সিস লিখেছেন রোজ বিকেলে এখানে হেঁটে বেড়ানোর কথা। সিনেমায় এখানেই ডায়ানার বন্ধুত্ব হয় ক্যাথরিনের সঙ্গে। ক্যাথরিন তাঁকে শেখায় নিজেকে ভালোবাসতে, নিজের সঙ্গকে উদ্‌যাপন করতে। আর আমি এই চত্বরে দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। পুরো চত্বরে সারি সারি জলপাইগাছ। রোদ সেখানে তেমন সুবিধা করতে পারছে না, কেবল আলো-ছায়ার খেলাই খেলছে। আর বাগানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসে আছে জনা বিশেক কিশোর-কিশোরী। তাদের সামনে ক্যানভাস, হাতে রং–তুলি। তারা একমনে আঁকছে, হাসছে, কথা বলছে। একজন বৃদ্ধও আছেন, তিনি বোধ হয় শিক্ষক হবেন। তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন, কাউকে রং মিশিয়ে দিচ্ছেন, কারো সঙ্গে হাসছেন গলা খুলে। বিকেলবেলায় জলপাইবাগানে এমন স্বতঃস্ফূর্ত ছবি আঁকার দৃশ্য হয়তো এদের কাছে নিতান্তই নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু আমার চোখে তা অসাধারণ হয়েই ধরা দিল।

কর্টোনা গ্রামের পথঘাট
ছবি: লেখক

এখানেই ছবি আঁকা দেখতে দেখতে তায়ো আর অ্যাশারের সঙ্গে কথা হয়। কফির দোকান খুঁজছি শুনে তাঁরা আমাকে যেখানে নিয়ে যান, সেটি তাঁদের ‘কাফে প্রেফেরিতো’। অর্থাৎ প্রিয় ক্যাফে। প্রিয় ক্যাফের কথা বলতে বলতে আমরা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’তে চলে যাই, গান আদান-প্রদান হয়। কিন্তু যে প্রশ্ন আমি সত্যিই করতে চাই, সেটি করার সাহস হয় না। আমি জানতে চাইছিলাম ‘আন্ডার দ্য তাস্কান সান’কে এরা কীভাবে নিয়েছেন? তাঁরা কি ফ্রান্সিস মায়েসকে চেনেন? অথবা অভিনেত্রী ডায়ানা লেনকে? আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, নটিং হিলের লোকেরা পর্যটক পছন্দ করেন না, হিউ গ্রান্টকেও করেন না বোধ হয়। পর্যটকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্কটিশ সরকার হ্যাগ্রিডের বাড়ি ভেঙে ফেলেছে বহু আগেই। জেমস বন্ড শুনলে খাঁটি (!) প্রাগবাসীরা নাক কোঁচকান ত্রিশ ডিগ্রি কোণে। আর আমার কবিতাপ্রেমী প্যারিসিয়ান বান্ধবী ‘ইনসেপশন’–এর কথা উঠলেই হতাশ হয়ে মাথা নাড়েন অন্তত ত্রিশ সেকেন্ড। সোজা কথা, হলিউডি সিনেমার কল্যাণে ইউরোপের যেসব অলি-গলি-রাস্তা-উঠান-ঘর-বাড়ি বিখ্যাত হয়েছে, সেসব জায়গায় মোটামুটি নিশ্চিতভাবে আপনি ‘তিতিবিরক্ত’ এলাকাবাসীর দেখা পাবেন। বিরক্ত হওয়ার কারণও যথেষ্ট। পর্যটকেরা প্রায়ই চূড়ান্ত মাত্রাহীনতায় ভোগেন। ছবি তোলা আর অহেতুক কৌতূহল দেখিয়ে তাঁরা এলাকাবাসীদের অতিষ্ঠ করে ছাড়েন।

তাই অমন আমেরিকান সাহিত্য আর হলিউডি সিনেমা নিয়ে প্রশ্ন করতে আমার খানিকটা অস্বস্তিই হয়। তবে শেষমেশ যখন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, দেখলাম, কর্টোনায় ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে হলিউডি অভিনেত্রী ডায়ানা লেনকে লোকে ভালোবাসে। আর আদ্যোপান্ত আমেরিকান লেখিকা ফ্রান্সিস মায়েসকে কর্টোনাবাসী ভাবে ‘নিজেদের লোক’। যে ক্যাফেতে আমরা বসেছিলাম, সেখানকার মালিক মাতিউ যেমন বললেন, বই লিখে ফ্রান্সিস কর্টোনাকে ভুলে যাননি। প্রতি গ্রীষ্মে তিনি এখনো এখানে আসেন, আগের মতোই জলপাই কুড়ান দল বেঁধে। আর ডায়ানা লেন? নাম শুনতেই চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল তায়োর। পাশে প্রেমিকা, তবু লজ্জিত কণ্ঠে জানালেন, তাঁর ২২ বছর বয়সী জীবনে সবচেয়ে মিষ্টি ঘটনা হলো, ডায়ানা লেনের সঙ্গে জিলাটো খাওয়া। ভাবলাম, শুটিংয়ের সময়কার গল্প হবে। কিন্তু না, ডায়ানা লেনও নাকি বারবার ফেরত আসেন কর্টোনায়। এখানে তিনি হলিউডি নায়িকার প্রটোকল নিয়ে ঘুরে বেড়ান না। ঝুড়ি হাতে ফ্রাইডে মার্কেটে চলে আসেন। এমনকি তায়োর ভাষ্যমতে, ডায়ানা নাকি টমেটো কিনতে এসে নির্দ্বিধায় দরদামও করেন।

আগেই বলেছি, ‘আন্ডার দ্য তাস্কান সান’ ১৯৯৬ সালের বই, ২০০৩ সালের সিনেমা। তাই লেখিকা ও অভিনেত্রীর নিয়মিত এমন দূর গ্রামে ফেরত আসার খবর শুনে অবাকই হই। আমাকে অবাক হতে দেখে অবশ্য তায়ো ও অ্যাশার পাল্টা অবাক হন। হড়বড় করে বলেন, ‘সিনিওরা! নন ভোলে তরনেরে কুয়্যি? (সিনিওরা, তুমি আবার এখানে ফেরত আসবে না)?’