শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জন্মদিন আজ
বাহাদুর শাহ জাফরের মেয়ের স্মৃতিকথা
শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জন্মদিন আজ। ১৮৫৭ সালে সিপাহি যুদ্ধের পর জাফরের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সেই দুর্ভোগ কালো ছায়া ফেলে তাঁর ছেলেমেয়ের জীবনেও। শেষ মোগল সম্রাটের জন্মদিনে আজ এখানে থাকল তাঁর মেয়ে কুলসুম যামানির স্মৃতিকথার একটি অংশ।
ভূমিকা
২০ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সাল। ইংরেজ বাহিনী দিল্লি পুরোপুরি কবজা করে নিল। পর্যুদস্ত হলো অল্প কয়েক দিনের ভারতীয় শাসন। সমাপ্ত হলো বিদ্রোহ। ইংরেজরা যাকে বলে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। যা আসলে সর্বভারতীয় ব্যাপ্তিতে প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম। সিপাহিরা দিল্লি ছেড়ে গেলেন। বিদ্রোহের অগ্রনায়কেরা বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করলেন। কিছু জায়গায় আরও কিছুদিন লড়াই জারি রইল।
এই সময় মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর লালকেল্লা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন! চারদিকে বন্ধু বলতে যারা ছিল তারা হয় নিহত, নয় তো আত্মগোপনে। নিরুপায় বাদশাহ গেলেন তাঁর পরাক্রান্ত পূর্বপুরুষের কাছে।
বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিতে। লালকেল্লা ছেড়ে বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের বের হয়ে যাওয়া ছিল ভারতে মোগলকালের অবসান। এর পরদিনই তিনি ইংরেজদের হাতে ধরা পড়বেন। কাগজে-কলমে সমাপ্তি ঘটবে মোগল শাসনের। সম্রাট মারা যাবেন রেঙ্গুনে।
শেষ সম্রাটের এই শেষ দুই দিন নিয়ে বেশ কিছু বৃত্তান্ত লেখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিখুঁত হচ্ছে খাজা হাসান নিজামির লেখা ‘বেগমাত কি আঁসু’। মানে বেগমদের অশ্রু। লেখা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুর দিকে। তখনো ১৮৫৭ সালের ঘটনা দেখেছেন নিজ চোখে, এমন বহু লোক সে সময়ও বেঁচে ছিলেন। তাঁদের মুখ থেকে শুনে খাজা হাসান নিজামি এগারো খণ্ড লিখেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘দাস্তানে গদর’। মানে ‘বিদ্রোহের গল্প’। এই ‘বেগমাত কি আঁসু’ সেই এগারো খণ্ডের একটি। কুলসুম যামানির বয়ান সেই খণ্ডে তুলে ধরা বয়ানগুলোর একটি। তিনি বাহাদুর শাহ জাফরের প্রিয় কন্যাদের একজন। ছিলেন খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার একনিষ্ঠ ভক্ত। দিল্লি পতনের আগে তিনি কেল্লা ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে কেমন করে গিয়েছিলেন, তার বৃত্তান্ত নিজের জবানিতে তুলে ধরা আছে এই কাহিনিতে। উর্দু থেকে অনুবাদের মাধ্যমে সেই কাহিনির কিছু অংশ আজ শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জন্মদিনে প্রকাশ করা হলো।
বাহাদুর শাহ জাফরের মেয়ের স্মৃতিকথা: ‘আপনাদের আশ্রয় দিয়ে পরিবারের সর্বনাশ করতে পারব না’
যে রাতে আমার বাবাজান তাঁর সাম্রাজ্য হারালেন, লালকেল্লায় এক দুর্যোগ নেমে এল। মনে হচ্ছিল যেন কেল্লার প্রতিটি দেয়াল কাঁদছে।
চার মাস ধরে চারদিকে বন্দুক আর কামান চলছে। সেই ধোঁয়া আর কালিতে মুক্তোর মতো শুভ্র মর্মর প্রাসাদ কালো হয়ে গেছে। গত দেড় দিন আমাদের কোনো খাবার জোগাড় হয়নি। আমার মেয়ে জয়নাবের বয়স দেড় বছর। সে দুধের জন্য কাঁদছে।
চারদিকে আজাব নেমে এসেছে। খাবার জুটছে না, দুশ্চিন্তা। আমার বা কোনো দাই মার বুকে দুধ নেই। আমরা অস্থির হয়ে ছিলাম। এমন সময় সম্রাট যিল্লে সুবহানির (বাহাদুর শাহ জাফর) বিশেষ সহায়ক আমাদের ডাকতে এলেন। তখন মাঝরাত। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। একটু পরপর সেই নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে কামান দাগার শব্দ।
আমরা দেরি না করে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে সম্রাটের সামনে গিয়ে হাজির হলাম।
হুজুর (বাহাদুর শাহ জাফর) বসে ছিলেন তাঁর জায়নামাজে। হাতে তসবিহ। আমি তাঁর সামনে প্রথামতো তিনবার কুর্নিশ করলাম। তিনি মমতা ভরে আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘কুলসুম, তোমাকে খোদার হাতে সঁপে দিচ্ছি। যদি ভাগ্যে থাকে, আবার দেখা হবে। দেরি না করে তোমার স্বামীসহ এখনই বের হয়ে পড়ো। আমিও বের হচ্ছি। এই অবস্থায় নিজের সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা হতে মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু আমার সমস্যায় তোমাকে জড়াতে চাই না। আমার সঙ্গে থাকলে তোমাদের বিনাশ নিশ্চিত। একা হলে, খোদা তোমাদের সামনে বাঁচার কোনো পথ খুলে দিতেও পারেন।’
কাঁপা কাঁপা হাত তাঁর প্রার্থনায় মেলে ধরে তিনি বলে উঠলেন, ‘হে খোদা, এই এতিম মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। অপূর্ব প্রাসাদে বড় হয়ে এখন তারা অন্ধকার অরণ্যের পথে চলেছে। কোনো বন্ধু নেই, নেই কোনো রক্ষক। তৈমুরি বংশের এই রাজকন্যাদের সম্মান রক্ষা কোরো, হে খোদা। হিন্দুস্তানের হিন্দু-মুসলমান সবাই আমার সন্তান। বিপদ তাদের ঘিরে ধরেছে। আমার কাজের জন্য তাদের যেন কষ্ট পেতে না হয়। সব বিপদ থেকে তাঁদের বাঁচিয়ে রেখো।’
যখন আমাদের গরুর গাড়িতে উঠলাম, তখন ভোর হয়ে এসেছে। শুধু ভোরের একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। আর সব তারা নিভে গেছে। শেষবারের মতো রাজপ্রাসাদের দিকে তাকালাম। আমাদের আনন্দভরা জীবনের নিবাস স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। সবার চোখে জল। নওয়াব নুর মহলের ওড়নার প্রান্ত অশ্রুভেজা, তাতে ঝলমল করছে ভোরের তারার আলো।
প্রার্থনা শেষ করে তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমার স্বামী মির্জা জয়নুদ্দিনের হাতে কয়েকটা রত্ন পাথর তুলে দিলেন। এরপর বাদশাহের বেগম নুর মহল সাহেবার সঙ্গে আমাদের বিদায় দিলেন।
ভোরের আগে কেল্লা ছেড়ে বের হলাম আমরা। সঙ্গে আমার স্বামী আর বাদশাহের শ্যালক মির্জা উমর সুলতান। আমরা তিন নারী—নওয়াব নুর মহল, হাফিজা সুলতানা আর আমি। হাফিজা সুলতানা ছিলেন সম্রাটের এক পুত্রের শাশুড়ি।
যখন আমাদের গরুর গাড়িতে উঠলাম, তখন ভোর হয়ে এসেছে। শুধু ভোরের একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। আর সব তারা নিভে গেছে। শেষবারের মতো রাজপ্রাসাদের দিকে তাকালাম। আমাদের আনন্দভরা জীবনের নিবাস স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। সবার চোখে জল। নওয়াব নুর মহলের ওড়নার প্রান্ত অশ্রুভেজা, তাতে ঝলমল করছে ভোরের তারার আলো।
চিরদিনের মতো লালকেল্লা ছেড়ে আমরা পৌঁছলাম কুরালি গ্রামে (দিল্লির পাশের এক গ্রাম)। সেখানে আমাদের গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের বাড়ি। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হলো। গাড়োয়ানের বউ আমাদের বাজরার রুটি আর ঘি খেতে দিলেন। এত খিদে পেয়েছিল যে খাবারটা বিরিয়ানির চেয়ে বেশি স্বাদের মনে হলো।
সেই রাত নির্বিঘ্নেই গেল। পরদিন জাঠ আর গুজ্জাররা করালি গ্রাম লুট করতে এল। তাদের সঙ্গে এল কয়েক শ নারী। তারা আমাদের ডাইনির মতো ঘিরে দাঁড়াল।
আমাদের কাপড়, গয়না নিল লুট করে। গলা থেকে টান দিয়ে খুলে ফেলল গয়না। এক বেলা খাবার কেনার সামর্থ্যও রইল না আর আমাদের। সামনে কী হবে, জানা নেই।
জয়নাব খিদের জ্বালায় কাঁদতে শুরু করল। এক জমিদার যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘ভাই, বাচ্চাটার জন্য একটু পানি দেন।’ ভালো মানুষটা একটা মাটির পাত্রে কিছু পানি এনে দিলেন। বললেন, ‘আজ থেকে আপনি আমার বোন, আমি আপনার ভাই।’
তিনি ছিলেন ওই গ্রামেরই মানুষ। নাম বাস্তি। তিনি নিজের গাড়ি এনে বললেন, আমরা যেখানে যেতে চাই, তিনি পৌঁছে দেবেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ইজারা যাব। সেখানে মির ফয়েজ আলী থাকেন। তিনি ছিলেন শাহি চিকিৎসক। তবে পৌঁছে হতাশ হলাম। তিনি সোজা বললেন, ‘আপনাদের আশ্রয় দিয়ে আমার পরিবারের সর্বনাশ করতে পারব না।’
কোথায় যাব, কী করব—কিছুই আর মাথায় এল না। আমরা গৃহহীন, কপর্দকশূন্য। পেছনে লেগে আছে ব্রিটিশ সৈন্য। একসময় যারা আমাদের চোখের সামান্য ইশারায় হুকুম তামিল করত, তারা এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু এই বাস্তি! তিনি আমাদের সঙ্গ ছাড়লেন না। বোন বলে ডেকেছেন, ভাই নামের মর্যাদা রাখলেন। ইজারা ছেড়ে হায়দরাবাদ রওনা হলাম আমরা।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]