ট্রাম্পের দ্রোহ আসলে কী প্রমাণ করল?
বহু ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে এই ক্ষমতা হস্তান্তর পরিক্রমা সহজ ছিল না। ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্পের উন্মত্ত সমর্থকেরা আক্রমণ চালিয়েছিলেন কংগ্রেস অধিবেশনে। এই পুরো ঘটনাকে ভিন্ন বাস্তবতা থেকে দেখেছেন বর্তমান দুনিয়ার জনপ্রিয় দার্শনিক স্লাভয় জিজেক। ১১ জানুয়ারি রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত আরটি টেলিভিশনের অনলাইন পোর্টালে এক লেখায় তিনি দেখিয়েছেন, জনতুষ্টিবাদের আশ্রয় নিয়ে ট্রাম্প যে নিজের সমর্থকদের প্ররোচিত করলেন, তা আদতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসারতাকে আঘাত করলেও শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প অনুসারী সাধারণ জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতারই আরেকটি নিদর্শন। অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য আরিফ।
ক্ষমতার প্রতি একরোখা মোহ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভুল কারণের জন্য সঠিক কাজটিই করেছেন। অবশ্যই অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চূর্ণ করা উচিত, কিন্তু ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকদের কিন্তু সেই ‘ভালো’ উদ্দেশ্য ছিল না। যখন জেলা বিচারক ভেনেসা ব্যারাইটসার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন, তখন অনেক বামপন্থী এবং স্বাধীন সমালোচকেরা যে উক্তিগুলো করেছিলেন, সেগুলো আমাদের টি এস এলিয়টের ‘মার্ডার ইন ক্যাথিড্রাল’-এর সেই বিখ্যাত সংলাপটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, ‘মহান রাজদ্রোহের প্রতি শেষ প্রচারণা/ভুল কারণের জন্য সঠিক কর্ম’। নাটকে বেকেট ভীত ছিল যে তার ‘সঠিক কাজ’ (রাজাকে প্রতিহত করা এবং নিজেকে আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত করা) আসলে ‘ভুল কারণে’ পরিচালিত হচ্ছে (পোপের আখ্যানের মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য তার দাম্ভিকতাপূর্ণ প্রয়াস)। হেগেল জনতুষ্টির মুখে আমাদের ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় কাজ করে, তার বিধেয়ের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি যদি একটি বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ করি, তা আসলে আমাদের স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণকেই নির্দেশ করে, যা আবেগপূর্ণ হতে পারে।’
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অ্যাসাঞ্জকে সমর্পণ করার দাবি প্রত্যাহার আসলে একটি ভিন্ন বিষয়: এটি আসলেই একটি সঠিক কাজ, কিন্তু জনসমক্ষে এই কাজ করার কারণ বেঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছিল। বিচারক অ্যাসাঞ্জের কর্মকাণ্ড সাংবাদিকতার জগতের বাইরে পরিচালিত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের বিবৃতিকে অনুমোদন দিয়েছেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপট থেকে ন্যায্য হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর অভিব্যক্তিতে চরম হতাশা ব্যক্ত হয়েছিল এবং কোনো কোনো সময় মনে হয়েছে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত।’ তিনি আরও যুক্ত করেছেন যে অ্যাসাঞ্জের উঁচু মাপের বুদ্ধিমত্তার অর্থই হলো তিনি তাঁর নিজের জীবন নিজেই সংহার করতে পারেন।
মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়া প্রকৃতই বিচার প্রদানের একটি অজুহাত—কিছুটা জটিল সমীকরণ সত্ত্বেও বিচারকের জনগণের প্রতি পরিষ্কার বক্তব্য ছিল, ‘আমি জানি যে অভিযোগটি ভুল, কিন্তু আমি এটিকে সঠিক বলতে প্রস্তুত নই, তাই আমি মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছি।’ (বাড়তি হিসেবে এখন কোর্ট অ্যাসাঞ্জের বেলের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি এই মুহূর্তে আবারও নির্জন গারদে কারাবাস করতে থাকবেন, যা তাঁকে আত্মঘাতী হতাশার দিকে ধাবিত করবে) অ্যাসাঞ্জের জীবন (হয়তোবা) বেঁচে গেল, কিন্তু তাঁর কাজ—গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের অধিকার এখনো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এটা একটি ইঙ্গিতবাহী উদাহরণ হয়ে থাকবে, যার মাধ্যমে আমাদের বিচারালয়ের মানবতাবাদের পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে।
কিন্তু এগুলো সবই সাধারণের বোধগম্য জ্ঞান—সাম্প্রতিক দুটি রাজনৈতিক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা যাকে বর্ণনা করতে গিয়ে টি এস এলিয়টের সংলাপগুলো ব্যবহার করতে পারি।
৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে যে হাস্যরসাত্মক ঘটনা মঞ্চস্থ হলো, সেটা কি আসলে শেষ একাঙ্কিকা? আর অ্যাসাঞ্জকে আসলেই কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণ করা উচিত ছিল না? এটা চীন থেকে হংকংয়ে পালিয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বীদের যোগ্য কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণের মতো ঘটনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে।
প্রথম ঘটনা: যখন ট্রাম্প তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে ইলেকটোরাল ভোট প্রত্যয়িত না করতে চাপ প্রয়োগ করলেন, তখন তিনি পেন্সকে ভুল কারণে সঠিক কাজ করতে বললেন। হ্যাঁ, অবশ্যই মার্কিন ইলেকটোরাল ব্যবস্থা কারচুপিপূর্ণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, এটা আসলে বড় ধরনের ভুয়া ব্যাপার, এটা নিয়ন্ত্রিত এবং সংগঠিত হয় ‘ডিপ স্টেট’ দ্বারা। ট্রাম্পের দাবির তাৎপর্য আসলে খুবই আগ্রহোদ্দীপক: তিনি পেন্সের সঙ্গে তর্ক করলেন যে সংবিধান নির্দেশিত পেশাদার ভূমিকার বদলে যদি অন্য প্রক্রিয়ায় যাওয়া যায়, তাহলে কংগ্রেসে ইলেকটোরাল কলেজের প্রমাণপত্রকে বিলম্বিত কিংবা ব্যাহত করা যেতে পারে।
যখন ভোট গণনা শুরু হলো, ভাইস প্রেসিডেন্ট সবেমাত্র ফল ঘোষণা করতে শুরু করেছেন, যাঁর প্রচারণাকে তিনি অগ্রসর করছিলেন—সেই ট্রাম্প চাইলেন যে পেন্স যেন এটা এমনভাবে করেন, যাতে মনে হয় এটাই প্রকৃত সিদ্ধান্ত…যা ট্রাম্প চাইছিলেন, তা আসলে বিপ্লব ছিল না, কিন্তু তা ছিল নিজেকে রক্ষা করতে পেন্সকে প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনা ব্যতীত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য বলপ্রয়োগ।
দ্বিতীয় ঘটনা: যখন ট্রাম্পপন্থীরা ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে আক্রমণ চালান, তখন তাঁরা ভুল কারণে সঠিক কাজটি করেছেন। তাঁদের মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সঠিক ছিল। কেননা, এই ব্যবস্থা এমন জটিলতাপূর্ণ প্রক্রিয়া, যার প্রধান লক্ষ্যই গণ-অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশকে হ্রাস করার অসম্ভব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। কিন্তু তাঁদের এই প্রচেষ্টা মোটেই ফ্যাসিবাদী ক্যু নয়—ক্ষমতা গ্রহণ করার প্রাধান্য হিসেবে ফ্যাসিস্টরা বড় পুঁজির সঙ্গে চুক্তিতে যায়, কিন্তু এখন ‘ব্যবসায়ীরা বলছেন যে ট্রাম্পকে তাঁর অফিস থেকে সরিয়ে দেওয়ার মূল লক্ষ্যই গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।’
তাহলে কি ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের বড় পুঁজির বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত করেছেন? প্রকৃতই তা নয়: মনে করে দেখুন, স্টিভ ব্যাননকে ট্রাম্পের কর পরিকল্পনার বিরোধিতা, সরাসরি ধনীদের ওপর ৪০ শতাংশ করারোপের জন্য ওকালতি এবং জনগণের অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলো উদ্ধারকে ‘ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র’ অভিধা দেওয়ার জন্য অপসারিত করা হয়েছিল।
এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো তিনি একজন ডানপন্থী নায়ক নন, বরং একজন কাপুরুষ। তাঁর সমর্থকেরা যে ইতিমধ্যে তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ উপাধি দিয়ে ফেলেছেন, এটাতে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নেই। তিনি ‘ওয়াশিংটনে’র ওপর বয়ে যাওয়া প্লাবন প্রশমিত করার জন্য আসলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। এটা অবশ্যই প্রমাণিত হয়েছে যে তাঁর সমর্থকেরা যে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন, তার মধ্যে কোনো প্রগতিবাদিতা ছিল না।
ট্রাম্প ওয়েলসের চিরায়ত চলচ্চিত্র ‘সিটিজেন কেন’-এর মতোই সাধারণ জনগণের পক্ষে ওকালতি করেন, যে সিনেমায় একজন ধনী ব্যাংকারকে দরিদ্র জনসমাবেশের জন্য দায়ী করা হলে তিনি তখন বলেছিলেন যে তাঁর সংবাদপত্র দরিদ্র সাধারণ জনগণের জন্য কথা বলে এই জন্য যে যেন এই সব সাধারণ জনগণের নিজেদের কথা বলার সত্যিকারের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ইয়্যুভাল ক্রেমনিটজাররা বলছেন, ট্রাম্প আসলে সেই জনতুষ্টিবাদী, যিনি নিজেই এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চান। যেকোনো জনতুষ্টিবাদের মতোই তাঁর লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করা, জনগণের পক্ষে সরাসরি কথা বলার ভান করেন—আসলে তা তিনি ‘ডিপ স্টেট’ এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকেই শক্তিশালী করার লক্ষ্যে করেন। তাঁর আসল বার্তা হলো: ‘যদি আমরা আমাদের হাতকে শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ না করতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের শত্রুদের চিরকালের জন্য বিতাড়িত করতে পারব না।’
যাহোক, পুরোনো কর্তৃত্ববাদী জনতুষ্টিবাদের মতো (ফ্যাসিবাদের মতো) প্রথাগত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রকে বিচূর্ণ করা এবং নতুন শাসনের জমানা সৃষ্টি করার তুলনায় আজকের জনতুষ্টিবাদের কোনো সুসংহত শাসনের জমানা তৈরির অভিপ্রায় নেই—এর মতাদর্শ ও রাজনীতি আসলে একধরনের বেমানান ব্রিকোলজি, যার প্রধান উদ্দেশ্য নিজেদের দরিদ্রদের উৎকোচ প্রদান করা, ধনীদের জন্য করের পরিমাণ হ্রাস করা, অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো এবং আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের জন্য আউটসোর্সিং চাকরির প্রচুর সুযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া ইত্যাদি। তাই বর্তমানের জনতুষ্টিবাদীরা প্রকৃতই চান না প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ওপরে ছরি ঘোরাতে এবং পুরোপুরি ক্ষমতা দখল করতে: ‘লিবারেল শাসনের শৃঙ্খল ছাড়া নতুন ডানপন্থীরা আসলেই কিছু প্রকৃত প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে’ এবং এটার মাধ্যমে অবশ্যই তারা তাদের কর্মসূচির শূন্যতা হ্রাস করে। বর্তমানের জনতুষ্টিবাদীরা ততক্ষণই তাদের লক্ষ্য পূরণের অনির্দিষ্ট স্থগিতকরণের মধ্যে কাজ করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ‘ডিপ স্টেটে’র উদারনৈতিক প্রতিষ্ঠাকে বিরোধিতা করে: ‘এই নতুন ডানপন্থীরা সেই চরম মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কাজ এই মুহূর্তে কিংবা কখনোই করে না, যার মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে এবং তারা এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালন যন্ত্রকে কখনোই বিলোপ করতে চায় না।’
প্রকৃতই এর অর্থ হলো ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে সাধারণ জনগণ মারাত্মকভাবে উদারনৈতিক করপোরেট অভিজাত এবং ব্যাংকের বিরুদ্ধে তার বুদবুদ কার্যকলাপকে গ্রহণ করে তারই সত্যিকারের শিকারে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রকৃতই তাঁর জনতুষ্টিবাদী কারণগুলোর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাঁর উদারনৈতিক সমালোচকেরা তাঁকে সমর্থকদের প্রতি তাঁর পক্ষেই সহিংস লড়াই করার মানসিক উদ্দীপনা তৈরির জন্য দায়ী করছেন এবং বলছেন যে তিনি তাদের পক্ষে থেকেই লড়াইয়ের প্রচারণা দিয়েছেন। কিন্তু আসলেই তিনি তাদের পক্ষে ছিলেন না।
৬ জানুয়ারি সকালে তিনি তাঁর পক্ষের মিছিলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্যাপিটলে যাব এবং আমরা সেখানে গিয়ে আমাদের সাহসী সিনেটর, কংগ্রেসম্যান এবং নারীদের উদ্দেশে উল্লাসধ্বনি প্রকাশ করব। আমরা সম্ভবত তাঁদের কিছু অংশের ব্যক্তিদের উৎসাহ দিতে সেখানে যাচ্ছি না। কেননা, আমরা আমাদের দেশকে দুর্বল হওয়ার পথে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দিতে চাই না। আমাদের নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে হবে এবং আমরা আরও শক্ত হয়ে উঠব।’ কিন্তু যখন তাঁর পক্ষের জনসমাবেশ এটা করেই দেখাল এবং ক্যাপিটলে তাণ্ডব চালাল, ট্রাম্প তখন হোয়াইট হাউস থেকে পশ্চাদপসরণ করলেন এবং ক্যাপিটল ভবনের সহিংসতা টেলিভিশনে দেখতে লাগলেন।
ভুয়া গণতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন
আসলেই কি ট্রাম্প একটি ক্যুদেতার প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে চেয়েছিলেন? দ্ব্যর্থহীনভাবে, না। যখন জনগণের স্রোত ক্যাপিটলে অনুপ্রবেশ করছিল, তখন তিনি একটি বিবৃতি দিলেন: ‘আমি আপনাদের ব্যথা সম্পর্কে জানি, আমি আপনাদের আঘাত অনুভব করছি। আমরা এমন একটি নির্বাচন পেয়েছি, যেটা আমাদের কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে। এটি একটি ভূমিধসের নির্বাচন এবং প্রত্যেকেই এটা জানে, বিশেষ করে অন্যপক্ষ। কিন্তু আপনাকে এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আমাদের শান্তি বজায় রাখতে হবে। আমাদের আইন এবং শাসনপ্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে।’ ট্রাম্প তাঁর প্রতিপক্ষকে সহিংসতার জন্য দায়ী করলেন এবং সমর্থকদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে গিয়ে বললেন, ‘আমরা এই ধরনের মানুষের হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারি না।
আমাদের শান্তি বজায় রাখতে হবে। সুতরাং বাড়ি ফিরে যান। আমরা আপনাদের ভালোবাসি; আপনারা সত্যিই বিশেষ কিছু।’
যখন জনসমাগম ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করল, ট্রাম্প তখন ক্যাপিটল ভবনে ঝড় তোলা ও তাণ্ডবলীলা চালানো সমর্থকদের রক্ষা করতে গিয়ে একটি টুইট করলেন, ‘যখন একটি বড় ধরনের ভূমিধস বিজয় অনিয়ম এবং অসুদপায়ের মাধ্যমে ছিনতাই করা হয়েছে, তখনই তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে।’ তিনি টুইটটি এভাবে শেষ করলেন, ‘মনে রাখবেন, এই দিনটিই চিরকালীন হয়ে থাকবে।’ হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা এটা মনে রাখব। কারণ, এটা মার্কিন গণতন্ত্রের অসারত্ব যেমন প্রদর্শন করেছে, তেমনি একইভাবে এর বিরুদ্ধে জনতুষ্টিবাদের ভুয়া প্রতিবাদকেও দেখিয়ে দিয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নির্বাচনের তাৎপর্য ছিল—এর মধ্যে ১৯৩৪ সালের ক্যালিফোর্নিয়ার রাজ্যপাল নির্বাচন: এই নির্বাচনে মিথ্যাচার ও ভুয়া অপবাদের শিকার হয়ে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী আপটন সিনক্লেয়ার পরাজিত হয়েছিলেন। (হলিউড এমন ঘোষণা দিয়েছিল যে যদি সিনক্লেয়ার জয়ী হয়, তাহলে এটাকে ফ্লোরিডায় স্থানান্তর করা হবে ইত্যাদি)
আবার ৭ জানুয়ারি ট্রাম্প তাঁর ছোট একটি ভাষণে নিজের আগের অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে ক্যাপিটলের ওপর হামলাকে আইন এবং শাসনতন্ত্রের প্রতি হুমকি হিসেবে প্রতিপন্ন করলেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
এটা তিনি সম্ভবত তাঁর নিজের পরিণতি সম্পর্কে ভীত হয়ে বলেছেন এবং প্রমাণ করলেন তিনি এই এস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষেরই একজন। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো তিনি একজন ডানপন্থী নায়ক নন, বরং একজন কাপুরুষ। তাঁর সমর্থকেরা যে ইতিমধ্যে তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ উপাধি দিয়ে ফেলেছেন, এটাতে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নেই।
তিনি ‘ওয়াশিংটনে’র ওপর বয়ে যাওয়া প্লাবন প্রশমিত করার জন্য আসলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। এটা অবশ্যই প্রমাণিত হয়েছে যে তাঁর সমর্থকেরা যে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন, তার মধ্যে কোনো প্রগতিবাদিতা ছিল না। তাঁরা তাঁদের ক্ষোভকে প্রকৃত ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদের পথে চালিত করেছেন। তাঁদের অনুযোগ সত্যের একটি অংশবিশেষ হলেও তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কর্মকাণ্ড দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকারে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের এই জোশকে সত্যিকারের আওয়াজে পরিণত করতে হলে তাঁদের উচিত হবে বার্নি স্যান্ডার্সের পক্ষে যোগদান করা।
এই উগ্র, অসন্তুষ্ট জনসমাগম পার্লামেন্ট আক্রমণ করেছে একজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনী কারসাজির মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য…আসলেই কি এই আওয়াজ যথার্থ? হ্যাঁ, এটা বলিভিয়া কিংবা ব্রাজিলে যদি সংঘটিত হতো এবং প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা এই জন্য যদি পার্লামেন্টে ঝড় তুলত এবং তাদের প্রেসিডেন্টকে পুনরায় স্থলাভিষিক্ত করত, তাহলে সেটা যথার্থ হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যা চলছিল, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আমরা আশা করব যে ওয়াশিংটনের ৬ জানুয়ারির ঘটনা অন্ততপক্ষে অন্য দেশের নির্বাচনের যথার্থতা বিচার করার মার্কিন অপাঙক্তেয় কর্মকাণ্ড বন্ধ করবে—এখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেই বৈদেশিক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। দেশটি নিজেই এক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র এবং এটা শুধু ট্রাম্প যখন থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তখন থেকেই নয়; চলতি গৃহযুদ্ধ (প্রায়) সেখানকার সব সময়কার ফাটলকেই প্রদর্শন করছে।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]