দাদিমার পরনে জালাবিয়া; দাদিমা ধীরে ধীরে টিভির দিকে এগিয়ে যায়; এগোতে এগোতে এমন জায়গায় গিয়ে থামে যে টিভির পর্দা প্রায় তার আড়ালে পড়ে যায়। তারপর মাথাটা আরও এগিয়ে নিয়ে যায়, চোখে পুরু লেন্সের চশমা থাকা সত্ত্বেও চোখ পিটপিট করতে করতে বলে, ‘এই ছেলেমেয়েরা, কী শো হচ্ছে টিভিতে?’
আমাদের ধৈর্য শেষ, আমরা বলি, ‘মুভি হচ্ছে দাদি, মুভি হচ্ছে।’
মা সেলাই করছিল, তার চোখেমুখে হাসির আভা দেখা গেল। তার পা দুটো সেলাই মেশিনের প্যাডেলে, দুই হাত সুচের নিচে ছুটন্ত কাপড়ে; মা চোখের কোণে আমাদের দেখছিল। রান্নাঘরে যে সুবাস ঘন হয়ে উঠছিল, মায়ের নাক সেদিকে।
দাদিমা টিভির কাছ থেকে সরে গিয়ে বসে, আবার কোনো সময় হয়তো লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়; লিভিং রুমের জানালা দিয়ে পাশের বাসার ব্যালকনি দেখা যায়।
ভিডিও আর সিনেমার মধ্যে, ভিএইচএস আর সিক্সটিন মিলিমিটারের মধ্যে, ঝলমলে ফ্ল্যাট লাইটিং আর কনট্রাস্টিং–ডাইমেনশন লুমিনেন্সের মধ্যে বৈজ্ঞানিক পার্থক্যগুলো কী তা জানার বহু বছর আগে, যখন সবাই জানত, মুভি আর টিভি শোর মধ্যে পার্থক্য কী, তখন আমাদের দাদিমা তা জানত না দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগত। আমরা যখন টেলিমিসর চ্যানেল দেখার জন্য জড়ো হতাম, দাদিমা তখন ঘুরেফিরে ওই একই প্রশ্ন করত, ‘এই ছেলেমেয়েরা, কী শো হচ্ছে টিভিতে?’ কিংবা উল্টো করে, ‘এই ছেলেমেয়েরা, কী মুভি হচ্ছে টিভিতে?’
দাদি কানে কম শুনত বলে আমরা চিৎকার করে বলতাম, ‘শো হচ্ছে দাদি, শো হচ্ছে।’
***
এক সমুদ্র, দুই মহাদেশ, ৩০ বছর দূরে
২৮ তলার বাসায় সেন্ট্রাল হিটিং থাকা সত্ত্বেও আমার পরনে শীতের পোশাক (বরাবরের মতো)। কিন্তু অ্যান পরে আছে খাটো শর্টস, লিভিং
রুমের কাউচের এ–মাথা থেকে ও–মাথা পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে বসে টেবিল থেকে রেড ওয়াইনের গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিচ্ছে একটু পরপর।
লিভিং রুম অন্ধকার; এলসিডি টিভির স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। টিভিতে দেখা যাচ্ছে, উঁচু একটা পাহাড়, তার চূড়ায় প্রচুর ঘাস, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী
আর তার পাশে এক হাস্যোজ্জ্বল যুবক; তরুণী যুবকের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলল, তারপর হঠাৎ তাকে ধাক্কা মারল। যুবক একটা আর্তচিৎকার দিয়ে উল্টে পড়ে যেতে থাকল
নিচের দিকে।
আমি হাতের খবরের কাগজটা রেখে টিভির পর্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মুভিটা সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
উত্তরে অ্যান বলল, ‘সিরিজ, হানি, সিরিজ।’
আমি নিজের অজান্তে টিভির দিকে ঝুঁকে স্ক্রিনের কোনায় ছোট ছোট লেখা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। এক সেকেন্ডের এক শ ভাগের এক ভাগের মধ্যে টিভিতে চলমান দৃশ্যটার কাটগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আলো পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের সেই পুরোনো লিভিং রুমটা আমার চারপাশে মূর্ত হয়ে উঠল।
তাকলিয়ার (একধরনের খাবার) গন্ধ আর সেলাই মেশিনের ঘটঘট শব্দে ধীরে ধীরে ভরে উঠতে লাগল ঘরটা।
মোহাম্মদ খায়ের
গত ২১ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম–২০২২–এ অংশগ্রহণকারী হিসেবে ৩২টি দেশের ৩৩ জন লেখকের একজন মিসরের মোহাম্মদ খায়ের। ১৯৭৮ সালে কায়রোতে জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ খায়ের একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও গীতিকার। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ লেইল খারগি ২০০২ সালে মিসরের মিনিস্ট্রি অব কালচার অ্যাওয়ার্ড পায়। তাঁর দুটি গল্পগ্রন্থ আফারিত আল রেডিও ও রেমশ আল এইন ২০২১ সালে সাওয়িরিস কালচারাল অ্যাওয়ার্ড পায়।
মোহাম্মদ খায়ের লেখেন মাতৃভাষা আরবিতে, তবে তাঁর অনেক গল্প ও একটি উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
মোহাম্মদ খায়ের
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম