বাবার ছায়ায় যেভাবে বেড়ে উঠি

বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের জন্মদিন ছিল ১৭ আগস্ট। আর তিনি মারা যান ১৫ আগস্ট। ব্যক্তিজীবনে কেমন মানুষ ছিলেন তিনি, বাবা হিসেবেই বা কেমন ছিলেন? শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যুদিন উপলক্ষে সে কথা জানিয়েছেন তাঁর বড় মেয়ে

মুর্তজা বশীরছবি: প্রথম আলো

আমার জন্মের আগেই অনুভব করেছিলাম এমন একজন বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, যাঁর কাছে আমি নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিতে পারি। আমি জানতাম, দুটি শক্তিশালী হাত আমাকে আলিঙ্গন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। তাই আমার ওপর বাবা ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন, যখন আমি আমার মায়ের পেটে। আগত সন্তানের জন্য অসীম ভালোবাসা এবং আগমনে উদ্‌গ্রীব না হয়ে থাকলে আমার জন্মক্ষণ থেকে এক বছর বয়স পর্যন্ত আমার বেড়ে ওঠার শৈশবের সুন্দর স্মৃতি বাবা ক্যামেরায় বন্দী করেছেন, যা আমি আজও লালন করে চলেছি।

আমার বয়স যখন ৩ বছর, বাবার কাছে শুনেছি—দাদা সব ছেলেকে নামাজ পড়তে ডাকতেন। তিনি নামাজের ইমামতি করতেন। হুট করে ঘরে ঢুকতেন না, আগে দরজায় টোকা দিতেন। বাবা বলেন, ‘সেদিন দরজায় যখন প্রথমবার টোকা দিলেন, আমি খাটের নিচে লুকিয়ে থাকলাম। আমার বড় মেয়েকে বললাম, “যাও, বলো, বাবা ঘরে নেই।” আমার মেয়ের বয়স তখন তিন বছর। ও দরজা খুলে বলল, “দাদা, বাবা ঘরে নেই।” পরে আমার খারাপ লাগল, মেয়েটাকে মিথ্যা কথা শিখালাম।’ বাবার এই নির্দ্বিধায় স্বীকারোক্তিতে তাঁর সততার পরিচয়ে আমি আজও মুগ্ধ হই। আমার ৪ বছর বয়সে খেলনার বিশাল সংগ্রহ ছিল। বাবা আমাকে বিভিন্ন বোর্ড গেম কিনে দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে বাগাডুলি খেলায় বাবা যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেরে যেতেন, তখন তা আমাকে পরবর্তী প্রতিযোগিতার অনুভূতি শিখিয়েছে এবং যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিতে যেতেন, সেটি আমাকে জীবনের নানা টানাপোড়েনে স্থির হতে শিখিয়েছে।

বাবা প্রচুর গান শুনতেন। আমাদের বাসায় ছোটবেলা থেকে রেকর্ড প্লেয়ার বাজানোর চল ছিল।

আমি উদয়ন স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। বাবা আমাকে রিকশায় করে স্কুলে নামিয়ে দিতেন এবং আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখতেন। আমাকে স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার সময় রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি গরমে ঘেমে উঠতাম। সেই সময় বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘টাকার বিবর্তন’ নামে ম্যুরাল করে যে টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে আমার জন্য ডাটসান গাড়ি কিনেছিলেন। গাড়ি কেনার পর বাবার মুখের হাসি আর প্রফুল্লতা সেই ছোট বয়সেই আমাকে শিখিয়েছে নড়বড়ে না হয়ে নতুন শুরুর দিকে এগিয়ে যেতে। বাবা প্রচুর গান শুনতেন। আমাদের বাসায় ছোটবেলা থেকে রেকর্ড প্লেয়ার বাজানোর চল ছিল। বাবা আমাকে কিশোর কুমার, রাহুল
দেব বর্মণ, মাইকেল জ্যাকসন, জন ট্রাভোল্টা, এলভিস প্রিসলি এবং মডার্ন টকিং, এবিবিএ, বনি এম, পঙ্কজ উদাসসহ আরও অনেকের মতো বিখ্যাত ব্যান্ডের মতো প্রতিভাবান শিল্পীদের চিরসবুজ গান শোনানো শিখিয়েছেন। এখনো বাসায় বাবার সংগ্রহে প্রচুর ক্যাসেট আছে। আমি বাবার কাছ থেকে সংগীতের একটি চূড়ান্ত ভালো স্বাদ আস্বাদন করার শিল্প আয়ত্ত করেছি।

ফ্রান্সে বাবা, আম্মা ও আমার ছোট বোন যূথীর সঙ্গে আমার শৈশব কেটেছে। ফ্রান্সে তিন বছর স্কুলের প্রকল্পগুলো সম্পূর্ণ করতে বাবা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও সৃজনশীল ধারণা সেই ছোট বয়সে আমাকে বাইরের জগৎ নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। ফ্রান্স! ভিনদেশ, ভিনপরিবেশ। ভাষাগত সমস্যা আমার আর আম্মার। যূথী অনেক ছোট। সেই পরিবেশে বাবা আমাদের সহায় ছিলেন। বাবা ফরাসি ভাষা বলতে পারতেন। বাবার সহযোগিতায় ৮ বছর বয়সী আমি ভিনদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে এবং লালন করতে শিখেছি।

দুই মেয়ে মুনীরা বশীর (ডানে) ও মুনিজা বশীরকে নিয়ে ২০০৩ সালে মুর্তজা বশীর এঁকেছিলেন ‘আত্মজা’ নামের এই ছবি

অঙ্ক খুব ভয় পেতাম। মুখস্থ করতাম। খারাপ নম্বর পেতাম। বাবা ভালোবাসা দিয়ে অঙ্কের প্রতি আমার ঘৃণাকে জয় করিয়েছেন। আমাকে ভয়ের মুখোমুখি হতে শিখিয়েছেন। ঘড়ির কাঁটা চেনাও বাবার কাছে, সময়ানুবর্তিতার পাঠও শিখেছিলাম তাঁর কাছে। ছোটবেলা থেকেই সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্য করার জন্য একটা আকুলতা ছিল এবং বাবার পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছি। আমি নিছক কথার চেয়ে কর্মের গুরুত্বে বিশ্বাস করি। তবে পরবর্তীকালে বাবা বলতেন, ‘যুঁই, তুই অনেক বোকা আর সরল! মিথ্যা কথা বলে অনেকে তোকে ঠকায়।’ বাবার অনেক শখ ছিল এবং তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের তালিকা বেশ দীর্ঘ। আমাকে আমার শখগুলো অনুসরণ করার জন্য ছোটবেলা থেকে তাগিদ দিয়েছেন, যা আমাকে বহুমুখী হতে শিখিয়েছে। বিভিন্ন লিঙ্গ, ধর্ম, এমনকি দেশের বন্ধুদের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে পত্রমিতালি করার ধারণা বাবার কাছেই পেয়েছি। আমি দেশের সীমানা পেরিয়ে মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছি।

১৩ বছর বয়সে বয়ঃসন্ধিকালে ভীতসন্ত্রস্ত আমাকে সতর্ক থাকার জন্য যে নির্দেশিকা বাবা দিয়েছিলেন, তা আমার মনকে যেভাবে প্রভাবিত করেছিল, তা মনে হলে আজও কৃতজ্ঞতায় বাবার প্রতি আমার মাথা নত হয়ে আসে। একটা মেয়ের কিশোরী থেকে যুবতীতে রূপান্তর হওয়ার সময় বাবা আমাকে নিজে সাহায্য করেছিলেন, কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়। বাবা আধ্যাত্মিকতা ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর যে ধারণা আমাকে দিয়েছিলেন, আমি তা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। আজও চোখ বন্ধ করলে তাঁর বলা কথাগুলো অনুভবে চলে আসে। আমি যা চেয়েছি, তার চেয়ে সব সময় আমাকে একটু অতিরিক্ত ‘পকেট মানি’ দিতেন এবং শেখাতেন কী করে তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। আমার জীবনে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও উদারতার একটি ভূমিকা ছিল, যা ১৫ বছর বয়সী আমাকে স্থির হতে শিখিয়েছে। আমার অন্যান্য সাফল্যের প্রতি বাবার প্রশংসার সঙ্গে সমালোচনা আমাকে নম্র থাকতে সাহায্য করেছিল। ১৬ বছরের আমি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও কলেজের রাস্তা পার হওয়ার সময় বাবা আমার হাত ধরে রাখতেন। এটা আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি সব সময় আমার বাবার ছোট রাজকুমারী হয়েই থাকব। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পাশাপাশি বাবার কাছ থেকে শিখেছি সময়ে–সময়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও বাধ্য হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ১৮ বছর বয়সে আমি যখন বাবার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা আমাকে স্কুল ও কলেজে নামানোর সময় যেভাবে রাস্তা পার হওয়ার জন্য হাত ধরে থাকতেন, এখন তা আর হবে না। কারণ, আমাকে নিজে থেকে যাতায়াত করতে উৎসাহিত করার জন্য এবং জীবনে একা কীভাবে চলতে হয়, তার শিক্ষা, প্রয়োজনে ভিড়ের বিপরীত দিকে হাঁটতে শেখার জন্য হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন।

১৯ বছর বয়সী আমাকে আমার নিজের পছন্দ করার ও দায়িত্ব নেওয়ার স্বাধীনতা বাবা দিয়েছেন। আমার ইতিবাচক আত্মসম্মানবোধ ও ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য গ্যাজেট ব্যবহার করার বিষয়ে বাবা আমাকে কিছু কৌশল শিখতে বলতেন। এটা আমাকে শিখিয়েছে যে শেখার কোনো শেষ নেই, সেটা আমার চেয়ে বড় বা ছোট যে কারও কাছ থেকে হোক। বাবা সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে আমাকে যে মূল্যবোধ, দক্ষতা ও জ্ঞান শিখিয়েছেন, তার কোনো শেষ নেই। কোনো দিন শেষ হবেও না। বাবার উপস্থিতি ও তাঁর অবয়ব আর দেখতে পাব না জানি। কিন্তু সব সময় অনুভব করা যায়, বাবা আমার সঙ্গে আছেন এবং আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত থাকবেন। হ্যাঁ, বাবা এটাই আমার জীবনে আপনার গুরুত্ব। আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তার জন্য কোনো কৃতজ্ঞতা আমি জানাব না, শুধু ভালোবাসাই জানাব, বাবা! প্রতিটি কন্যা বা পুত্রের পেছনে সত্যিই একজন আশ্চর্যজনক পিতা থাকেন, তাই আপনাকে ধন্যবাদ।

বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চার বছর হয়। সময় খুব দ্রুত চলে যায়। তিনি জ্ঞানী মানুষ ছিলেন; শক্তিশালী, নিঃস্বার্থ, সত্যবাদী ও কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি একজন মহান পিতা ছিলেন। তিনি আমাকে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনন্তলোক পাড়ি দেন। আমার যখন তাঁকে প্রয়োজন, তখন তিনি সর্বদা আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার পৃথিবী, আমার শক্তি, আমার আশা এবং আমার স্বপ্ন। যদিও তিনি শারীরিকভাবে এখানে নেই। তিনি চিরকাল আমার হৃদয়ে আছেন।

বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের জন্মদিন ছিল ১৫ আগস্ট। আর তিনি মারা যান ১৭ আগস্ট। ব্যক্তিজীবনে কেমন মানুষ ছিলেন তিনি, বাবা হিসেবেই বা কেমন ছিলেন? শিল্পীর জন্ম ও মৃত্যুদিন উপলক্ষে সে কথা জানিয়েছেন তাঁর বড় মেয়ে

 দুই মেয়ে মুনীরা বশীর (ডানে) ও মুনিজা বশীরকে নিয়ে ২০০৩ সালে মুর্তজা বশীর এঁকেছিলেন ‘আত্মজা’ নামের এই ছবি

মুর্তজা বশীর (১৭ আগস্ট ১৯৩২—১৫ আগস্ট ২০২০)। ছবি: প্রথম আলো